ঢাকা , বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোথা থেকে এলো ‘রোহিঙ্গা’

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি ম্রোহং শব্দ থেকে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আরাকানের বিতাড়িত রাজা নরমিখলা ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের প্রত্যক্ষ সহায়তায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি রাজধানী লংগিয়েতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামু বা টেকনাফ থেকে শত মাইলের মধ্যে লেম্ব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এটাই ছিল আরাকানের শেষ অবধি (১৭৮৫ খ্রি. পর্যন্ত) রাজধানী

‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উৎপত্তি সর্ম্পকে নানা মত আছে। কেউ কেউ বলেন, আরবীয় মুসলমানরা ভাসতে ভাসতে কূলে ভিড়লে ‘রহম-রহম’ ধ্বনি দিয়ে স্থানীয় (আরাকান) জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে। বলা বাহুল্য, ‘রহম’ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ দয়া করা। কিন্তু (আরাকানি) জনগণ মনে করে এরা রহম জাতীয় লোক। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা মনে করে থাকেন। (রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস : ১৭)।
এ বিষয়ে মোটাদাগে একটি ধারণা দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ। তিনি তার আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস বইয়ে লেখেন, ‘মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের একচক্ষুনীতি অবলম্বন করে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করলেও মূলত রোহিঙ্গারাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী আরব মুসলমান। অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দীতে আরাকানে চন্দ্রবংশীয় রাজা মহৎ-ইঙ্গ-চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০ খ্রি.) কয়েকটি আরব মুসলিম বাণিজ্য বহর রামব্রি দ্বীপের পার্শ্বে বিধ্বস্ত হলে জাহাজের আরোহীরা রহম (দয়া), রহম বলে চিৎকার করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে আরাকানের রাজার কাছে নিয়ে যায়। আরাকান রাজা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত আচরণে মুগ্ধ হয়ে আরাকানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের অনুমতি দান করেন। আরবি ভাষায় অনভিজ্ঞ স্থানীয় লোকজন তাদের ‘রহম’ গোত্রের লোক মনে করে ‘রহম’ বলে ডাকত। ক্রমশ শব্দটি বিকৃত হয়ে রহম>রোঁয়াই>রোয়াই>রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা নামে খ্যাত হয়।
কেউ কেউ মনে করেন, রোহিঙ্গারা আফগানিস্তানের অন্তর্গত ‘ঘোর’ প্রদেশের রোহা জেলার অধিবাসীদের বংশধর। মূলত তারা তুর্কি কিংবা আফগানি। কেননা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজিসহ বাংলার মুসলমান বিজেতা ও শাসকরা ইসলাম প্রচার ও প্রসারের নিমিত্তে আফগানিস্তানের রোহার অঞ্চলের কিছু ব্যক্তিকে আরাকানে পাঠিয়েছিলেন। ওই রোহার অঞ্চলের মুসলমানরা আরাকানের নামকরণ করেছিলেন রোহাং। এ রোহা ও রোহাং শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা নামকরণ হয়েছে বলে তারা মনে করেন। তারা আরও উল্লেখ করেন, আরাকান ও চট্টগ্রামে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষায় সাধু ভাষার শ, ষ, স, মৌখিক উচ্চারণে ‘হ’ উচ্চারণ শোনা যায় এবং ‘হ’কে শ, ষ, স, উচ্চারণ করে থাকে। এ পদ্ধতিতে হয়তো রোহাং>রোসাঙ্গ হয়েছে। রোহার অঞ্চলের মুসলমানরা যেহেতু নিজেদের রোহাইন বলে পরিচয় দেয়, তাই আরাকানে এ রোহাইন শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা হয়েছে বলে তারা মনে করেন। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, বাংলা থেকে অপহৃত দাসরা স্থানীয় মগ রমণী বিয়ে করে আরাকানে বসবাস করে এবং তাদের ঔরসে ও মগ মহিলাদের গর্ভজাত বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীও রোহিঙ্গা। (প্রাচীন আরাকান রোয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়–য়া বৌদ্ধ অধিবাসী)।
স্থানীয় ইতিহাস বিশারদ আবদুল হক চৌধুরী মনে করেন, প্রধানত আরাকানে বসতি স্থাপনকারী চট্টগ্রামের বাবার ঔরসে ও আরাকানি মগ মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী আরাকানি ও চট্টগ্রাম উপভাষী মুসলমান বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীই হলো আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্র। কালক্রমে আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্রের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পরে নতুন নতুন চট্টগ্রামী বসতি স্থাপনকারীদের আগমনের ফলে তাদের সংখ্যা অধিক হয়। তখন নিজেদের গোত্রের মধ্যে মুখ্যত বিয়ে-শাদি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে তারা চট্টগ্রামী উপভাষাকে আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্রের পারিবারিক ভাষা হিসেবে চালু রাখতে সক্ষম হয়।
রাখাইং শব্দ থেকে রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও মন্তব্য পাওয়া যায়। তারা মনে করেন, রাখাইং শব্দ থেকে রোয়াং হয়েছে এবং এ রোয়াং শব্দটি বিকৃত হয়ে রোয়াইঙ্গা শব্দের গঠন হয়েছে। (ইতিহাস, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, ঢাকা, পঞ্চবিংশ বর্ষ, ১ম-৩য় সংখ্যা, বৈশাখ-চৈত্র ১৩৮৯, পৃষ্ঠা ১১৭)। তাদের মতে, রোয়াং তিব্বতি বর্মী শব্দ, যার অর্থ বোঝায় আরাকান। এজন্য অদ্যাবধি চট্টগ্রাম জেলায় রোয়াং বলতে আরাকান এবং রোহিঙ্গা বলতে আরাকানের অধিবাসীকে বোঝায়। যদি এ মতকে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় তবে রোঁয়াই-চাটি শব্দদ্বয়ের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দারা নিজেদের চাটি ও আরাকান থেকে আসত এবং এ অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারীদের রোঁয়াই বলে সম্বোধন করে থাকেন। তবে রোহিঙ্গা শব্দটি রাখাইন শব্দ থেকে উৎপত্তি ধরা না হলেও রোঁয়াই বলতে আরাকান অঞ্চল বোঝায়, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি ম্রোহং শব্দ থেকে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আরাকানের বিতাড়িত রাজা নরমিখলা ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের প্রত্যক্ষ সহায়তায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি রাজধানী লংগিয়েতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামু বা টেকনাফ থেকে শত মাইলের মধ্যে লেম্ব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এটাই ছিল আরাকানের শেষ অবধি (১৭৮৫ খ্রি. পর্যন্ত) রাজধানী। এ ম্রোহং শব্দটি মুসলমানদের মুখে এবং লেখায় রোহাং উচ্চারিত হয়। এভাবে রোয়াং>রোহাং>রোহিঙ্গা নামকরণ হয়েছে। (পুঁথি পরিচিতি : ৩১৬)। উল্লেখ্য, সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল এবং আহমদ শরীফ প্রমুখ মনে করেন, রাজধানীকে কেন্দ্র করে লেখকরা রাজ্যের নাম লিখেছেন। যেমন রোমান সাম্রাজ্য, দিল্লি সাম্রাজ্য প্রভৃতির মতো রাজধানী ম্রোহংয়ের নামেই আরাকানকে চিহ্নিত করা হতো। তবে ম্রোহং শব্দটি সাধারণ উচ্চারণে রোহাং হয়েছে, আবার পূর্ববাংলার কথ্য ভাষায় ‘স’, ‘হ’ উচ্চারণের রূপান্তরের কারণে রোহাং শব্দটিও রোসাঙ্গ হয়েছে। যেমন ম্রোহং>রোয়াং>রোহাং>রোসাঙ্গ ইত্যাদি। এ কারণেই রোহাঙ্গ রাজ্যকে রোসাঙ্গ রাজ্য বলে লেখকরা অভিহিত করে থাকেন। এক কথায় বলা যায়, আরাকানের শেষ রাজধানী ম্রোহং; এর সাধারণ উচ্চারণ রোহাং। এ রোহাংয়ের মুসলিম অধিবাসীদের রোহিঙ্গা বলা হয়। সুতরাং এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, ম্রোহংয়ের অধিবাসী হওয়ার কারণে আরাকানের মুসলমানদের রোহিঙ্গা বলা হয়ে থাকে। অতএব আরব বণিক, নাবিক, ইসলাম প্রচারক, রোহার থেকে আসত ইসলাম প্রচারক, গৌড়ীয় মুসলিম সৈন্য, বাংলায় অপহৃত দাসরাসহ অধিকাংশ মুসলমানই রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাহলে সমসাময়িক লেখকদের লেখায় রোহিঙ্গা শব্দটি পাওয়া যায় না কেন?
উত্তরে বলা যেতে পারে, বাংলার অধিবাসী হওয়ার কারণে যেমন বাঙালি বলা হয় অথচ বাঙালির হাজার হাজার বছর আগের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা হলেও বাঙালি শব্দের প্রয়োগ সমসাময়িক লেখকদের লেখায় পাওয়া যায় না। বলা চলে, বাঙালি কথাটিও আধুনিককালের প্রয়োগ। অথচ আধুনিককালের প্রয়োগ হলেও যেমন বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের, তেমনি রোহিঙ্গা শব্দটি আধুনিককালের হলেও রোহিঙ্গাদের ইতিহাসও হাজার বছরের চেয়েও পুরনো। এরা পরিচয়হীনভাবে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠী নয়। মূলত রোহিঙ্গারাই আরাকানের স্থায়ী ও আদি মুসলমান। (আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস : ১৫৭)।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

কোথা থেকে এলো ‘রোহিঙ্গা’

আপডেট টাইম : ০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি ম্রোহং শব্দ থেকে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আরাকানের বিতাড়িত রাজা নরমিখলা ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের প্রত্যক্ষ সহায়তায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি রাজধানী লংগিয়েতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামু বা টেকনাফ থেকে শত মাইলের মধ্যে লেম্ব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এটাই ছিল আরাকানের শেষ অবধি (১৭৮৫ খ্রি. পর্যন্ত) রাজধানী

‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উৎপত্তি সর্ম্পকে নানা মত আছে। কেউ কেউ বলেন, আরবীয় মুসলমানরা ভাসতে ভাসতে কূলে ভিড়লে ‘রহম-রহম’ ধ্বনি দিয়ে স্থানীয় (আরাকান) জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে। বলা বাহুল্য, ‘রহম’ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ দয়া করা। কিন্তু (আরাকানি) জনগণ মনে করে এরা রহম জাতীয় লোক। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা মনে করে থাকেন। (রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস : ১৭)।
এ বিষয়ে মোটাদাগে একটি ধারণা দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ। তিনি তার আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস বইয়ে লেখেন, ‘মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের একচক্ষুনীতি অবলম্বন করে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করলেও মূলত রোহিঙ্গারাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী আরব মুসলমান। অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দীতে আরাকানে চন্দ্রবংশীয় রাজা মহৎ-ইঙ্গ-চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০ খ্রি.) কয়েকটি আরব মুসলিম বাণিজ্য বহর রামব্রি দ্বীপের পার্শ্বে বিধ্বস্ত হলে জাহাজের আরোহীরা রহম (দয়া), রহম বলে চিৎকার করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে আরাকানের রাজার কাছে নিয়ে যায়। আরাকান রাজা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত আচরণে মুগ্ধ হয়ে আরাকানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের অনুমতি দান করেন। আরবি ভাষায় অনভিজ্ঞ স্থানীয় লোকজন তাদের ‘রহম’ গোত্রের লোক মনে করে ‘রহম’ বলে ডাকত। ক্রমশ শব্দটি বিকৃত হয়ে রহম>রোঁয়াই>রোয়াই>রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা নামে খ্যাত হয়।
কেউ কেউ মনে করেন, রোহিঙ্গারা আফগানিস্তানের অন্তর্গত ‘ঘোর’ প্রদেশের রোহা জেলার অধিবাসীদের বংশধর। মূলত তারা তুর্কি কিংবা আফগানি। কেননা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজিসহ বাংলার মুসলমান বিজেতা ও শাসকরা ইসলাম প্রচার ও প্রসারের নিমিত্তে আফগানিস্তানের রোহার অঞ্চলের কিছু ব্যক্তিকে আরাকানে পাঠিয়েছিলেন। ওই রোহার অঞ্চলের মুসলমানরা আরাকানের নামকরণ করেছিলেন রোহাং। এ রোহা ও রোহাং শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা নামকরণ হয়েছে বলে তারা মনে করেন। তারা আরও উল্লেখ করেন, আরাকান ও চট্টগ্রামে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষায় সাধু ভাষার শ, ষ, স, মৌখিক উচ্চারণে ‘হ’ উচ্চারণ শোনা যায় এবং ‘হ’কে শ, ষ, স, উচ্চারণ করে থাকে। এ পদ্ধতিতে হয়তো রোহাং>রোসাঙ্গ হয়েছে। রোহার অঞ্চলের মুসলমানরা যেহেতু নিজেদের রোহাইন বলে পরিচয় দেয়, তাই আরাকানে এ রোহাইন শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা হয়েছে বলে তারা মনে করেন। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, বাংলা থেকে অপহৃত দাসরা স্থানীয় মগ রমণী বিয়ে করে আরাকানে বসবাস করে এবং তাদের ঔরসে ও মগ মহিলাদের গর্ভজাত বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীও রোহিঙ্গা। (প্রাচীন আরাকান রোয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়–য়া বৌদ্ধ অধিবাসী)।
স্থানীয় ইতিহাস বিশারদ আবদুল হক চৌধুরী মনে করেন, প্রধানত আরাকানে বসতি স্থাপনকারী চট্টগ্রামের বাবার ঔরসে ও আরাকানি মগ মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী আরাকানি ও চট্টগ্রাম উপভাষী মুসলমান বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীই হলো আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্র। কালক্রমে আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্রের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পরে নতুন নতুন চট্টগ্রামী বসতি স্থাপনকারীদের আগমনের ফলে তাদের সংখ্যা অধিক হয়। তখন নিজেদের গোত্রের মধ্যে মুখ্যত বিয়ে-শাদি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে তারা চট্টগ্রামী উপভাষাকে আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্রের পারিবারিক ভাষা হিসেবে চালু রাখতে সক্ষম হয়।
রাখাইং শব্দ থেকে রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও মন্তব্য পাওয়া যায়। তারা মনে করেন, রাখাইং শব্দ থেকে রোয়াং হয়েছে এবং এ রোয়াং শব্দটি বিকৃত হয়ে রোয়াইঙ্গা শব্দের গঠন হয়েছে। (ইতিহাস, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, ঢাকা, পঞ্চবিংশ বর্ষ, ১ম-৩য় সংখ্যা, বৈশাখ-চৈত্র ১৩৮৯, পৃষ্ঠা ১১৭)। তাদের মতে, রোয়াং তিব্বতি বর্মী শব্দ, যার অর্থ বোঝায় আরাকান। এজন্য অদ্যাবধি চট্টগ্রাম জেলায় রোয়াং বলতে আরাকান এবং রোহিঙ্গা বলতে আরাকানের অধিবাসীকে বোঝায়। যদি এ মতকে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় তবে রোঁয়াই-চাটি শব্দদ্বয়ের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দারা নিজেদের চাটি ও আরাকান থেকে আসত এবং এ অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারীদের রোঁয়াই বলে সম্বোধন করে থাকেন। তবে রোহিঙ্গা শব্দটি রাখাইন শব্দ থেকে উৎপত্তি ধরা না হলেও রোঁয়াই বলতে আরাকান অঞ্চল বোঝায়, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি ম্রোহং শব্দ থেকে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আরাকানের বিতাড়িত রাজা নরমিখলা ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের প্রত্যক্ষ সহায়তায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি রাজধানী লংগিয়েতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামু বা টেকনাফ থেকে শত মাইলের মধ্যে লেম্ব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এটাই ছিল আরাকানের শেষ অবধি (১৭৮৫ খ্রি. পর্যন্ত) রাজধানী। এ ম্রোহং শব্দটি মুসলমানদের মুখে এবং লেখায় রোহাং উচ্চারিত হয়। এভাবে রোয়াং>রোহাং>রোহিঙ্গা নামকরণ হয়েছে। (পুঁথি পরিচিতি : ৩১৬)। উল্লেখ্য, সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল এবং আহমদ শরীফ প্রমুখ মনে করেন, রাজধানীকে কেন্দ্র করে লেখকরা রাজ্যের নাম লিখেছেন। যেমন রোমান সাম্রাজ্য, দিল্লি সাম্রাজ্য প্রভৃতির মতো রাজধানী ম্রোহংয়ের নামেই আরাকানকে চিহ্নিত করা হতো। তবে ম্রোহং শব্দটি সাধারণ উচ্চারণে রোহাং হয়েছে, আবার পূর্ববাংলার কথ্য ভাষায় ‘স’, ‘হ’ উচ্চারণের রূপান্তরের কারণে রোহাং শব্দটিও রোসাঙ্গ হয়েছে। যেমন ম্রোহং>রোয়াং>রোহাং>রোসাঙ্গ ইত্যাদি। এ কারণেই রোহাঙ্গ রাজ্যকে রোসাঙ্গ রাজ্য বলে লেখকরা অভিহিত করে থাকেন। এক কথায় বলা যায়, আরাকানের শেষ রাজধানী ম্রোহং; এর সাধারণ উচ্চারণ রোহাং। এ রোহাংয়ের মুসলিম অধিবাসীদের রোহিঙ্গা বলা হয়। সুতরাং এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, ম্রোহংয়ের অধিবাসী হওয়ার কারণে আরাকানের মুসলমানদের রোহিঙ্গা বলা হয়ে থাকে। অতএব আরব বণিক, নাবিক, ইসলাম প্রচারক, রোহার থেকে আসত ইসলাম প্রচারক, গৌড়ীয় মুসলিম সৈন্য, বাংলায় অপহৃত দাসরাসহ অধিকাংশ মুসলমানই রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাহলে সমসাময়িক লেখকদের লেখায় রোহিঙ্গা শব্দটি পাওয়া যায় না কেন?
উত্তরে বলা যেতে পারে, বাংলার অধিবাসী হওয়ার কারণে যেমন বাঙালি বলা হয় অথচ বাঙালির হাজার হাজার বছর আগের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা হলেও বাঙালি শব্দের প্রয়োগ সমসাময়িক লেখকদের লেখায় পাওয়া যায় না। বলা চলে, বাঙালি কথাটিও আধুনিককালের প্রয়োগ। অথচ আধুনিককালের প্রয়োগ হলেও যেমন বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের, তেমনি রোহিঙ্গা শব্দটি আধুনিককালের হলেও রোহিঙ্গাদের ইতিহাসও হাজার বছরের চেয়েও পুরনো। এরা পরিচয়হীনভাবে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠী নয়। মূলত রোহিঙ্গারাই আরাকানের স্থায়ী ও আদি মুসলমান। (আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস : ১৫৭)।