বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বাপ-দাদার বসতভিটা রাতারগুল এলাকায়। জন্ম থেকেই দেখছে বাপ-চাচারা রাতারগুল বুনোজলে নৌকা চালায়। বংশ পরম্পরায় তারা মাঝি। তাই নিজেকেও প্রস্তুত করেছে সেভাবে। গড়ে তুলেছে নিজেকে দক্ষ মাঝি হিসেবে।
জাবেদের প্রতিদিনের রুটিন বেশ হিসাব কষা। সকাল ৭টার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘাটে হাজির। কারণ দিতে হয় সিরিয়াল। আগে অবশ্যই এমন নিয়ম ছিল না। ইদানীং ঘাটে সিরিয়াল দেয়ার নিয়ম হয়েছে। তাই আগেভাগে সিরিয়াল না দিলে দিনে ২ বা ৩টা ট্রিপ দেয়া সম্ভব হয় না। তবে গড়ে প্রতিদিন একটির বেশি ট্রিপ হয় না বললেই চলে। তারপরও শুক্র-শনি বা ভ্রমণের সিজনে দিনে দুই বা তিনবার ট্রিপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এ ছাড়া রাতারগুল বুনোজলের নৌকার মাঝিদের সবার রেট এখন একই। সাড়ে ৭শ’ টাকা। মোটামুটি ২ ঘণ্টা ঘুরিয়ে, ওয়াচ টাওয়ারের ঘাটে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বিরতি। পাঁচতলাসম উঁচু পর্যবেক্ষণ বা ওয়াচ টাওয়ারের চূড়ায় ওঠার জন্য সিঁড়িও রয়েছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ একসঙ্গে বেশ কয়েক পর্যটক উঠলে দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
এ ছাড়া যদি কারো ইচ্ছা থাকে ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখবে পুরো রাতারগুল তাও করতে পারে। আর চূড়ায় গিয়ে পুরো জলারবনের ছবিও তোলা যাবে। চূড়ায় বসেই উপভোগ করতে পারবেন জলারবনের রূপ। ওয়াচ টাওয়ারে কিছু সময় কাটিয়ে আবারো নৌকায়। ফেরার পথে কিংবা যাওয়ার পথে পর্যটকরা ইচ্ছা করলে রাতারগুলে নেমে প্রকৃতির ছবিও তুলতে পারেন। এটা আসলে যারা যায় তাদের ওপর নির্ভর করে। জাবেদের বয়স খুব বেশি হবে না। ১৩ থেকে ১৪ এর মধ্যে। যখন তার বয়স ৭ তখন থেকে হাতে তুলে নিয়েছে নৌকার বৈঠা। সন্ধ্যা পর্যন্ত চিরচেনা রাতারগুলের বুনোজলে নৌকা নিয়ে থাকে। পর্যটকদের সঙ্গে নানা ধরনের গল্প করে। এরপর সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে যায়। খুব কম পর্যটক আছে যারা বায়না করে রাতারগুলে রাতে ঘোরা কিন্তু জাবেদের সেটা একেবারে পছন্দ নয়। তাই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে। মায়ের হাতের বানানো নাস্তা খেয়ে বাজারে যায়। বন্ধু সোহাগের সঙ্গে দেখা করে আড্ডা মারে। এভাবেই চলে জাবেদের দিন। শুধু জাবেদ নয়, রাতারগুল এলাকায় যে কতজন মাঝি আছে প্রত্যেকেই এক একটি জাবেদ। তাদের প্রতিদিনের রুটিন কাছাকাছি।
মাঝি জাবেদ হোসেন জানায়, ছোটবেলা থেকেই বাপ দাদাকে দেখে দেখে নৌকা চালানো। তবে রাতারগুল না এলে ভালো লাগে না। প্রতিদিন নানা জেলার নানান কিসিমের মানুষদের নিয়ে রাতারগুল ঘুরতে হয়। সবাই এক রকম হয় না। তবুও পর্যটক নিয়ে ঘোরাঘুরি তার পছন্দ। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনার পর ভালো না লাগার কারণে আর স্কুলে যায়নি। কিন্তু ছোট ভাই বোন পড়াশোনা করে। ওরা যতদূর পড়তে চায় জাবেদ তাদের পড়াশোনা করাবে।
শেষে রাতারগুল প্রসঙ্গ। তবে রাতারগুল নিয়ে বলার বিশেষ কিছু নেই। কারণ নামের সঙ্গে রুপের দারুণ মিল। সিলেটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘রাতারগুল’। জলের ওপর জঙ্গলে পরিবেশ তৈরি করেছে এক ধরনের বুনো সৌন্দর্য। এর আবেদন অন্য রকম। গা ছমছম করবে ঠিকই, কিন্তু সে রকম ভয় ধরাবে না। রোমাঞ্চের শিহরণ জাগাবে, আবার নিবিড় মমতায় জড়াবে। তাই রাতারগুলের বুনোজলের হাতছানিতে মাতে অন্তরের টান। রাতারগুল মূলত জলারবন। সোয়াম্প ফরেস্ট। বর্ষায় এতে ৮-১০ ফুটের মতো পানি থাকে, শীতে শুকিয়ে যায়। ৫ একর জায়গাজুড়ে এ বন।
জলারবনে হিজল, করচ, বনজাম, জংলিবট আর মুরতা নামের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছড়াছড়ি। জলমগ্ন গাছগুলো যেন গলাগলি করে থাকে। গাছের ডালপালা ছাপিয়ে যাওয়া লতা-গুল্ম মিলে বিশাল এক সবুজ চাঁদোয়া যেন গড়ে তোলে। স্বচ্ছ জলে এই চাঁদোয়ার ছবি ফুটিয়ে তোলে অপরূপ এক দৃশ্য। রাতারগুলের বুনোজল বা জলারবনে ঘুরে বেড়ানোর বাহন নৌকা।
সূত্রঃ মানবকণ্ঠ