ঢাকা , শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আশুরা ও কারবালার চেতনা

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আশুরার দিন তিনি সেনাপতির মতো শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যূহ রচনা করেন। আক্রান্ত হলে একে একে সাথি যোদ্ধাদের রণাঙ্গনে পাঠানোর পর নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বা তার এমন কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি, যা রাসুলে পাকের আদর্শের বাইরে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কাজেই চিন্তা করলে বোঝা যাবে, ইমাম হোসাইন (রা.) অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে নানাজানের দ্বীন রক্ষার জন্য শাহাদতের পথ বেছে নিয়েছিলেন। রাসুলের নাতি হয়েও ইসলামের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ প্রমাণ করে ইসলাম মানে বিলাসিতা ও আরামদায়ক জীবনে সন্তুষ্ট থাকা নয়। ইসলাম মানে ত্যাগের পরাকাষ্ঠা

আশুরা ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্ত ঘটনার স্মারক। এ ঘটনায় ইরাকের কারবালা প্রান্তরে যিনি অসম যুদ্ধে অসহায়ভাবে প্রাণ হারান তিনি ছিলেন রাসুল (সা.) এর অত্যন্ত স্নেহের নাতি হজরত আলী ও মা ফাতেমার আদরের দুলাল ইমাম হোসাইন (রা.)। এই মর্মান্তিক ঘটনা ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হওয়ার মূলে রয়েছে ইমাম হোসাইনকে শাহাদতের নজরানা পেশ করতে হয়েছিল তার নানাজানের আদর্শ রক্ষার জন্য আর যারা তাকে নির্মমভাবে শহীদ করেছে তারা ছিল তার নানার আদর্শের দাবিদার মুসলমান।

নবীজির ইন্তেকালের মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে তাঁর নাতি মজলুমভাবে শহীদ হওয়া মানুষের বিবেক কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এ কারণে যুগে যুগে কারবালা মানব হৃদয়ে শোকের মাতম তুলেছে আর সেসব হৃদয়কে এখনও কাঁদায়, যারা প্রত্যেক নামাজের শেষ বৈঠকে দরুদ পড়ে আলে মুহাম্মদ বা আহলে বাইতের প্রতি দরুদ ও সালাম জানায়।

হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ১০ বছর মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনার পর দশম হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। এর পর খোলাফায়ে রাশেদিনের চারজন সত্যনিষ্ঠ খলিফা দীর্ঘ ৩০ বছর আল্লাহ ও তার রাসুলের সঠিক নীতি আদর্শের ওপর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.) বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদতবরণ করলে তার রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার দাবিতে সিরিয়ার গভর্নর আমির মুয়াবিয়া (রা.) চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) এর সঙ্গে বিরোধ ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। হজরত আলী (রা.) খারেজি আততায়ীর হাতে শাহাদতবরণের পর তার ছেলে ইমাম হাসানকে খলিফার পদে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু তিনি আমির মুয়াবিয়া (রা.) এর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা ও মুসলিম উম্মাহর অব্যাহত অনৈক্যের কথা চিন্তা করে খেলাফতের দাবি ত্যাগ করেন। এরপর ৬০ হিজরি পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর আমির মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামি জাহান শাসন করেন। তার হাতে ইসলামের বিজয় অভিযান চলতে থাকে অব্যাহতভাবে। ইউরোপসহ সারা দুনিয়ায় ইসলাম পৌঁছে যায়। ৫৫ হিজরিতে পূর্ববর্তী খলিফাদের নিয়ম ভেঙে নিজ পুত্র এজিদকে তিনি খলিফা মনোনীত ও জনগণের বায়াত আদায় করেন।

পিতার ইন্তেকালের পর ৬০ হিজরিতে এজিদ দামেস্ককেন্দ্রিক ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফার পদে বসে। এর পরই মদিনার গভর্নরের কাছে পত্র লেখে, যাতে তার পক্ষে হোসাইন (রা.) এর বায়াত আদায় করা হয়। রাসুলে খোদার নাতি হয়ে হোসাইন (রা.) একজন অপদার্থ ও ইসলামি শরিয়তের রীতিনীতির প্রতি প্রকাশ্যে বিরুদ্ধাচরণকারী খলিফার হাতে বায়াত বা আনুগত্যের শপথ নিতে পারেন না। তাই রাতের অন্ধকারে তিনি মদিনা থেকে সপরিবারে মক্কায় চলে আসেন হিজরি ৬০ সালের রজব মাসে।

এজিদের প্রতি বিদ্রোহী ছিল কুফার জনগণের মন। কুফা বর্তমান ইরাকের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) যখন মদিনায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সপরিবারে কুফায় চলে যান। কারণ, কুফার লোকেরা ছিল হজরত আলী (রা.) এর সমর্থক ও অনুরক্ত। ইমাম হাসান (রা.) খেলাফতের দাবি ত্যাগ ও পরে বিষপ্রয়োগে শাহাদতবরণ করলে ইমাম হোসাইন (রা.) আহলে বায়াতের সদস্যদের নিয়ে মদিনায় চলে আসেন। কাজেই কুফার লোকেরা ইমাম হোসাইনের (রা.) এর পূর্বপরিচিত ছিল এবং কুফাবাসীও হোসাইন (রা.) কে ভালোভাবে চিনত। এজিদ দামেস্কে খেলাফতের মসনদে বসার পর হোসাইন (রা.) মক্কায় চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে কুফার গণ্যমান্য লোকেরা একের পর এক চিঠি পাঠাতে থাকে হোসাইনের কাছে। সবার বক্তব্য ছিল, আমরা কিছুতেই এজিদের মতো অপদার্থের হাতে বায়াত নেব না। আপনি আমাদের মাঝে চলে আসুন, আমরা আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করে প্রয়োজনে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।

রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ এই ৫ মাস হোসাইন (রা.) বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, সবার সঙ্গে পরামর্শ করেন। অধিকাংশ লোকের পরামর্শ ছিল কুফার লোকেরা বিশ^াসঘাতক, কাজেই আপনি যাবেন না। তিনি দেখেন যে, এজিদ নাছোড়বান্দা। প্রয়োজনে মক্কা আক্রমণ করবে। তখন কাবাঘর ও মক্কা নগরীর পবিত্রতা লুণ্ঠিত হবে। ‘আমার কারণে মক্কার অমর্যাদা হোক’ তা হোসাইন সহ্য করতে পারেন না। তাই সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন কুফায় যাবেন। তিনি মাহে রমজান ও হজের মৌসুমে মানুষকে ইসলামি খেলাফত বিপথগামী হওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন। ওদিকে সর্বশেষ পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠান। মুসলিম ইবনে আকিল রিপোর্ট দেন, এ পর্যন্ত কুফার ১৮ হাজার মানুষ আপনার পক্ষে আমার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনি নিশ্চিন্তে চলে আসতে পারেন।

ইসলামি খেলাফতের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝানোর জন্য কুফার উদ্দেশে যাত্রার যে দিনটি নির্ধারণ করেন তা ছিল ৮ জিলহজ, যেদিন হাজীরা ইহরাম পরে মক্কা থেকে মিনা ও আরাফাতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ওই দিনই তিনি মক্কা থেকে রওয়ানা হয়ে পথিমধ্যে জানতে পারেন কুফাবাসী বিশ^াসঘাতকতা করেছে। নতুন গভর্নর ইবনে জিয়াদের ষড়যন্ত্রে শরিক হয়ে মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা করেছে। এ সংবাদে যারপরনাই মর্মাহত হয়ে একবার মক্কায় ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন। কিন্তু সফরসঙ্গী মুসলিম ইবনে আকিলের ছেলেরা পিতার রক্তের বদলা নেওয়ার যে সংকল্প দেখায় তাতে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই হুর ইবনে এজিদের নেতৃত্বে কুফার গভর্নরের প্রেরিত বাহিনী অন্য কোথাও যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয় এবং কারবালা প্রান্তরে উপনীত হতে বাধ্য করে। ইতিহাসের বিস্ময়কর তথ্য হলো, পথিমধ্যে নামাজের সময় হলে পথরোধকারীরাও ইমাম হোসাইন (রা.) এর ইমামতিতে নামাজ পড়ে। নামাজ শেষ হলে আবার তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। এভাবে কুফার সামরিক অধিনায়ক হুর ইবনে এজিদ হিজরি নববর্ষ ৬১ সালের মহরম মাসে ইমাম ও তার পরিবারকে কারবালায় গিয়ে শিবির স্থাপনে বাধ্য করে।

কুফার গভর্নর দামেস্ক অধিপতি এজিদের পক্ষে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ২২ হাজার বা ৩০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করে। সে বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করে মুহাম্মদ ইবনে সাদকে। তিনি ছিলেন কাদেসিয়া বিজয়ী হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ছেলে। শেষ পর্যন্ত কারবালা প্রান্তরে শান্তি স্থাপনের জন্য যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইমাম শিবিরের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। চরম মুহূর্তে সেনাপতি হুর ইবনে এজিদ ইমামের শিবিরে পালিয়ে আসে এবং পরে ইমামের পক্ষ নিয়ে বীরবিক্রমে লড়াই করে শাহাদতের পেয়ালা পান করেন, যা প্রমাণ করে ইমাম হুসাইন (রা.) ছিলেন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আর এজিদ ও ইবনে জিয়াদের বাহিনী যুদ্ধ করেছিল মিথ্যার পক্ষে।

আশুরা এলে আমরা বলি ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সেই ন্যায় ও সত্য কি ছিল তা পরিষ্কার হয়ে গেছে, যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। বস্তুত সে সত্য ও ন্যায় ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামি নেতৃত্ব। ইসলামি খেলাফতের আসনে এজিদের মতো পাপিষ্ঠকে কোনো মুসলমান মেনে নিতে বা সমর্থন করতে পারে না ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ধর্ম ও রাজনীতি ইসলামের দুটি হাত বা পা। একটি অচল হলে অপরটি অকেজো হয়ে যায়। কাজেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কোনো পাপাচারীর হাতে তুলে দিয়ে ধর্মকর্ম নিয়ে বুজুর্গ হয়ে বসে থাকার সুযোগ আল্লাহর রাসুলের নাতি উম্মতের জন্য রাখেননি।

একশ্রেণির কলুষিত মনের লোক মানুষকে বোকা বানানোর জন্য বলে, ইমাম হোসাইন (রা.) পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। তার মানে কারবালার ঘটনা একটি রাজনৈতিক দুর্ঘটনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু আমরা যখন দেখব, এজিদের হাতে বায়াত এড়ানোর জন্য ইমাম হোসাইন (রা.) মদিনার বাড়িঘর ত্যাগ করে মক্কায় চলে এসেছেন। রাসুলের নাতি হিসাবে মক্কায় সর্বোচ্চ ধর্মীয় মর্যাদার মধ্যে দীর্ঘ ৫ মাস সলাপরামর্শ করেছেন। আমরা দেখি, সবাই হজে আরাফার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার দিনটি তিনি কুফা যাত্রার জন্য বেছে নিয়েছেন। এর আগে পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় প্রেরণ করেছেন। পথিমধ্যে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে বহুবার বৈঠক ও মতবিনিময় করে শান্তি স্থাপন ও যুদ্ধ এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।

আশুরার আগের রাতে সঙ্গীদের ডেকে অন্ধকারের ঢাল ব্যবহার করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ মৃত্যু আসন্ন জেনেও ইমামকে ছেড়ে যেতে তারা কেউ রাজি হয়নি। আশুরার দিন তিনি সেনাপতির মতো শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধের ব্যূহ রচনা করেন। আক্রান্ত হলে একে একে সাথি যোদ্ধাদের রণাঙ্গনে পাঠানোর পর নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বা তার এমন কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি, যা রাসুলে পাকের আদর্শের বাইরে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কাজেই চিন্তা করলে বোঝা যাবে, ইমাম হোসাইন (রা.) অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে নানাজানের দ্বীন রক্ষার জন্য শাহাদতের পথ বেছে নিয়েছিলেন। রাসুলের নাতি হয়েও ইসলামের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ প্রমাণ করে ইসলাম মানে বিলাসিতা ও আরামদায়ক জীবনে সন্তুষ্ট থাকা নয়। ইসলাম মানে ত্যাগের পরাকাষ্ঠা।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

আশুরা ও কারবালার চেতনা

আপডেট টাইম : ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আশুরার দিন তিনি সেনাপতির মতো শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যূহ রচনা করেন। আক্রান্ত হলে একে একে সাথি যোদ্ধাদের রণাঙ্গনে পাঠানোর পর নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বা তার এমন কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি, যা রাসুলে পাকের আদর্শের বাইরে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কাজেই চিন্তা করলে বোঝা যাবে, ইমাম হোসাইন (রা.) অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে নানাজানের দ্বীন রক্ষার জন্য শাহাদতের পথ বেছে নিয়েছিলেন। রাসুলের নাতি হয়েও ইসলামের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ প্রমাণ করে ইসলাম মানে বিলাসিতা ও আরামদায়ক জীবনে সন্তুষ্ট থাকা নয়। ইসলাম মানে ত্যাগের পরাকাষ্ঠা

আশুরা ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্ত ঘটনার স্মারক। এ ঘটনায় ইরাকের কারবালা প্রান্তরে যিনি অসম যুদ্ধে অসহায়ভাবে প্রাণ হারান তিনি ছিলেন রাসুল (সা.) এর অত্যন্ত স্নেহের নাতি হজরত আলী ও মা ফাতেমার আদরের দুলাল ইমাম হোসাইন (রা.)। এই মর্মান্তিক ঘটনা ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হওয়ার মূলে রয়েছে ইমাম হোসাইনকে শাহাদতের নজরানা পেশ করতে হয়েছিল তার নানাজানের আদর্শ রক্ষার জন্য আর যারা তাকে নির্মমভাবে শহীদ করেছে তারা ছিল তার নানার আদর্শের দাবিদার মুসলমান।

নবীজির ইন্তেকালের মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে তাঁর নাতি মজলুমভাবে শহীদ হওয়া মানুষের বিবেক কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এ কারণে যুগে যুগে কারবালা মানব হৃদয়ে শোকের মাতম তুলেছে আর সেসব হৃদয়কে এখনও কাঁদায়, যারা প্রত্যেক নামাজের শেষ বৈঠকে দরুদ পড়ে আলে মুহাম্মদ বা আহলে বাইতের প্রতি দরুদ ও সালাম জানায়।

হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ১০ বছর মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনার পর দশম হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। এর পর খোলাফায়ে রাশেদিনের চারজন সত্যনিষ্ঠ খলিফা দীর্ঘ ৩০ বছর আল্লাহ ও তার রাসুলের সঠিক নীতি আদর্শের ওপর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.) বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদতবরণ করলে তার রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার দাবিতে সিরিয়ার গভর্নর আমির মুয়াবিয়া (রা.) চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) এর সঙ্গে বিরোধ ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। হজরত আলী (রা.) খারেজি আততায়ীর হাতে শাহাদতবরণের পর তার ছেলে ইমাম হাসানকে খলিফার পদে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু তিনি আমির মুয়াবিয়া (রা.) এর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা ও মুসলিম উম্মাহর অব্যাহত অনৈক্যের কথা চিন্তা করে খেলাফতের দাবি ত্যাগ করেন। এরপর ৬০ হিজরি পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর আমির মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামি জাহান শাসন করেন। তার হাতে ইসলামের বিজয় অভিযান চলতে থাকে অব্যাহতভাবে। ইউরোপসহ সারা দুনিয়ায় ইসলাম পৌঁছে যায়। ৫৫ হিজরিতে পূর্ববর্তী খলিফাদের নিয়ম ভেঙে নিজ পুত্র এজিদকে তিনি খলিফা মনোনীত ও জনগণের বায়াত আদায় করেন।

পিতার ইন্তেকালের পর ৬০ হিজরিতে এজিদ দামেস্ককেন্দ্রিক ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফার পদে বসে। এর পরই মদিনার গভর্নরের কাছে পত্র লেখে, যাতে তার পক্ষে হোসাইন (রা.) এর বায়াত আদায় করা হয়। রাসুলে খোদার নাতি হয়ে হোসাইন (রা.) একজন অপদার্থ ও ইসলামি শরিয়তের রীতিনীতির প্রতি প্রকাশ্যে বিরুদ্ধাচরণকারী খলিফার হাতে বায়াত বা আনুগত্যের শপথ নিতে পারেন না। তাই রাতের অন্ধকারে তিনি মদিনা থেকে সপরিবারে মক্কায় চলে আসেন হিজরি ৬০ সালের রজব মাসে।

এজিদের প্রতি বিদ্রোহী ছিল কুফার জনগণের মন। কুফা বর্তমান ইরাকের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) যখন মদিনায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সপরিবারে কুফায় চলে যান। কারণ, কুফার লোকেরা ছিল হজরত আলী (রা.) এর সমর্থক ও অনুরক্ত। ইমাম হাসান (রা.) খেলাফতের দাবি ত্যাগ ও পরে বিষপ্রয়োগে শাহাদতবরণ করলে ইমাম হোসাইন (রা.) আহলে বায়াতের সদস্যদের নিয়ে মদিনায় চলে আসেন। কাজেই কুফার লোকেরা ইমাম হোসাইনের (রা.) এর পূর্বপরিচিত ছিল এবং কুফাবাসীও হোসাইন (রা.) কে ভালোভাবে চিনত। এজিদ দামেস্কে খেলাফতের মসনদে বসার পর হোসাইন (রা.) মক্কায় চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে কুফার গণ্যমান্য লোকেরা একের পর এক চিঠি পাঠাতে থাকে হোসাইনের কাছে। সবার বক্তব্য ছিল, আমরা কিছুতেই এজিদের মতো অপদার্থের হাতে বায়াত নেব না। আপনি আমাদের মাঝে চলে আসুন, আমরা আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করে প্রয়োজনে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।

রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ এই ৫ মাস হোসাইন (রা.) বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, সবার সঙ্গে পরামর্শ করেন। অধিকাংশ লোকের পরামর্শ ছিল কুফার লোকেরা বিশ^াসঘাতক, কাজেই আপনি যাবেন না। তিনি দেখেন যে, এজিদ নাছোড়বান্দা। প্রয়োজনে মক্কা আক্রমণ করবে। তখন কাবাঘর ও মক্কা নগরীর পবিত্রতা লুণ্ঠিত হবে। ‘আমার কারণে মক্কার অমর্যাদা হোক’ তা হোসাইন সহ্য করতে পারেন না। তাই সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন কুফায় যাবেন। তিনি মাহে রমজান ও হজের মৌসুমে মানুষকে ইসলামি খেলাফত বিপথগামী হওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন। ওদিকে সর্বশেষ পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠান। মুসলিম ইবনে আকিল রিপোর্ট দেন, এ পর্যন্ত কুফার ১৮ হাজার মানুষ আপনার পক্ষে আমার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনি নিশ্চিন্তে চলে আসতে পারেন।

ইসলামি খেলাফতের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝানোর জন্য কুফার উদ্দেশে যাত্রার যে দিনটি নির্ধারণ করেন তা ছিল ৮ জিলহজ, যেদিন হাজীরা ইহরাম পরে মক্কা থেকে মিনা ও আরাফাতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ওই দিনই তিনি মক্কা থেকে রওয়ানা হয়ে পথিমধ্যে জানতে পারেন কুফাবাসী বিশ^াসঘাতকতা করেছে। নতুন গভর্নর ইবনে জিয়াদের ষড়যন্ত্রে শরিক হয়ে মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা করেছে। এ সংবাদে যারপরনাই মর্মাহত হয়ে একবার মক্কায় ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন। কিন্তু সফরসঙ্গী মুসলিম ইবনে আকিলের ছেলেরা পিতার রক্তের বদলা নেওয়ার যে সংকল্প দেখায় তাতে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই হুর ইবনে এজিদের নেতৃত্বে কুফার গভর্নরের প্রেরিত বাহিনী অন্য কোথাও যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয় এবং কারবালা প্রান্তরে উপনীত হতে বাধ্য করে। ইতিহাসের বিস্ময়কর তথ্য হলো, পথিমধ্যে নামাজের সময় হলে পথরোধকারীরাও ইমাম হোসাইন (রা.) এর ইমামতিতে নামাজ পড়ে। নামাজ শেষ হলে আবার তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। এভাবে কুফার সামরিক অধিনায়ক হুর ইবনে এজিদ হিজরি নববর্ষ ৬১ সালের মহরম মাসে ইমাম ও তার পরিবারকে কারবালায় গিয়ে শিবির স্থাপনে বাধ্য করে।

কুফার গভর্নর দামেস্ক অধিপতি এজিদের পক্ষে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ২২ হাজার বা ৩০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করে। সে বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করে মুহাম্মদ ইবনে সাদকে। তিনি ছিলেন কাদেসিয়া বিজয়ী হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ছেলে। শেষ পর্যন্ত কারবালা প্রান্তরে শান্তি স্থাপনের জন্য যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইমাম শিবিরের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। চরম মুহূর্তে সেনাপতি হুর ইবনে এজিদ ইমামের শিবিরে পালিয়ে আসে এবং পরে ইমামের পক্ষ নিয়ে বীরবিক্রমে লড়াই করে শাহাদতের পেয়ালা পান করেন, যা প্রমাণ করে ইমাম হুসাইন (রা.) ছিলেন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আর এজিদ ও ইবনে জিয়াদের বাহিনী যুদ্ধ করেছিল মিথ্যার পক্ষে।

আশুরা এলে আমরা বলি ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সেই ন্যায় ও সত্য কি ছিল তা পরিষ্কার হয়ে গেছে, যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। বস্তুত সে সত্য ও ন্যায় ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামি নেতৃত্ব। ইসলামি খেলাফতের আসনে এজিদের মতো পাপিষ্ঠকে কোনো মুসলমান মেনে নিতে বা সমর্থন করতে পারে না ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ধর্ম ও রাজনীতি ইসলামের দুটি হাত বা পা। একটি অচল হলে অপরটি অকেজো হয়ে যায়। কাজেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কোনো পাপাচারীর হাতে তুলে দিয়ে ধর্মকর্ম নিয়ে বুজুর্গ হয়ে বসে থাকার সুযোগ আল্লাহর রাসুলের নাতি উম্মতের জন্য রাখেননি।

একশ্রেণির কলুষিত মনের লোক মানুষকে বোকা বানানোর জন্য বলে, ইমাম হোসাইন (রা.) পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। তার মানে কারবালার ঘটনা একটি রাজনৈতিক দুর্ঘটনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু আমরা যখন দেখব, এজিদের হাতে বায়াত এড়ানোর জন্য ইমাম হোসাইন (রা.) মদিনার বাড়িঘর ত্যাগ করে মক্কায় চলে এসেছেন। রাসুলের নাতি হিসাবে মক্কায় সর্বোচ্চ ধর্মীয় মর্যাদার মধ্যে দীর্ঘ ৫ মাস সলাপরামর্শ করেছেন। আমরা দেখি, সবাই হজে আরাফার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার দিনটি তিনি কুফা যাত্রার জন্য বেছে নিয়েছেন। এর আগে পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় প্রেরণ করেছেন। পথিমধ্যে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে বহুবার বৈঠক ও মতবিনিময় করে শান্তি স্থাপন ও যুদ্ধ এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।

আশুরার আগের রাতে সঙ্গীদের ডেকে অন্ধকারের ঢাল ব্যবহার করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ মৃত্যু আসন্ন জেনেও ইমামকে ছেড়ে যেতে তারা কেউ রাজি হয়নি। আশুরার দিন তিনি সেনাপতির মতো শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধের ব্যূহ রচনা করেন। আক্রান্ত হলে একে একে সাথি যোদ্ধাদের রণাঙ্গনে পাঠানোর পর নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বা তার এমন কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি, যা রাসুলে পাকের আদর্শের বাইরে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কাজেই চিন্তা করলে বোঝা যাবে, ইমাম হোসাইন (রা.) অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে নানাজানের দ্বীন রক্ষার জন্য শাহাদতের পথ বেছে নিয়েছিলেন। রাসুলের নাতি হয়েও ইসলামের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ প্রমাণ করে ইসলাম মানে বিলাসিতা ও আরামদায়ক জীবনে সন্তুষ্ট থাকা নয়। ইসলাম মানে ত্যাগের পরাকাষ্ঠা।