প্রায়ই কটকট করে কলিজা কাঁপানো একটা শব্দ ভেসে আসে বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে। অনেকে মনে করে ভূতে করে এই শব্দ।লোকমুখে প্রচলিত আছে, ঠিক দুপুরে মেঠোপথের কোনো পথিকের সামনে হঠাৎই নুয়ে পড়ে রাস্তার পাশের কোনও বাঁশ। পথিক তখন ভালোমনে বাঁশটাকে ডিঙিয়ে পার হতে যায়। অমনি বাঁশটা হঠাৎ সোজা হয়ে যায়। পথিককে নিয়েই বাঁশ সোজা হয়। ফলে পথিক চিৎপটাং হয়ে উঠে যায় একেবারে বাঁশের মাথায়, নইলে মাঝপথ থেকেই ধম করে পড়ে মাটিতে! এতে মারাত্মক আঘাত পায় পথিক। কখনও কখনও মারাও যেতে পারেন।
মুখে মুখে প্রচলিত বেঁশোভূতের এই গল্প কেবল শোনাই যায়। ‘দেখেছি’ বলতে পারে এমন মানুষ দেখা যায় না। তবে ঘটনা একেবারে মিথ্যে নয়। মাঝে মাঝে কিছু ঘটে বলেই কিছু রটে। গাঁয়ের মানুষের কাছে এর সমাধানও আছে। তাঁদের ধারণা এসব বেঁশোভূতের শয়তানী। পথিককে একা পেয়ে ব্যাটা ইচ্ছে করেই একটা বাঁশ রাস্তার ওপর নুয়ে ফেলে। পথিক যখন পার হতে যায়, তখন সে বাঁশটা ছেড়ে দেয়। পাজি ভূতকে শায়েস্তা করার ওষুধও গ্রামবাসীদের জানা আছে। কেউ কখনো এমন অবস্থায় মুখোমুখি হলে তার উচিত ভয় না পেয়ে ওই বাঁশ এড়িয়ে যাওয়া। তখন হয়তো বেঁশোভূত সামনের কোনও ঝাড় থেকে আরেকটা বাঁশ ফেলে দেয়। পথিক যদি একের পর এক সবকটা বাঁশ এড়িয়ে যায়, তখন বেঁশোভূত বিরক্ত হয়ে তাকে ছেড়ে যায়। বেঁশোভূতকে শায়েস্তা করার আরেকটা উপায়ও গ্রামবাসীর জানা আছে। পথিককে সবার আগে বুকে সাহস বাঁধতে হবে। তারপর আশেপাশে খুঁজে দেখতে হবে মোটা-শক্ত কোনও লাঠি পাওয়া যায় কিনা। আর হাতে যদি একটা লাঠি থাকে, তা হলে তো কথাই নেই। সজোরে লাঠি দিয়ে কষে এক আঘাত করতে হবে বাঁশের গায়ে। সেই বাড়ি অদৃশ্য ভূতের গায়ে লাগবে । বোঁশোভূত পালাবে তখন বাপরে-মা-রে বলে। হেলে পড়া বাঁশও তখন যাবে সোজা হয়ে। পথিকের পথ তখন পরিষ্কার।
ব্যাখ্যা
প্রথমেই আসা যাক, বাঁশের কটকট শব্দ করার বিষয়টাতে। বাঁশ ৬০-৭০ ফুট উঁচু হয়। তবে বৃক্ষ নয়। ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। বলা চলে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ তৃণ হলো বাঁশ। তাই বৃক্ষের মতো এর কাণ্ডের ভেতরটাও নিরেট নয়, ফাঁপা। আধাফুট দূরে দূরে একটা করে গিঁঠ। ভেতরটা ফাঁপা হওয়ার কারণে বাঁশ অন্য উদ্ভিদের মতো দৃঢ় নয়। তাছাড়া বাঁশের আগার দিকে কঞ্চি থাকে অনেক বেশি। অনেক বড়ও হয় সেগুলো। তাই আগার দিকটা ভারি হয়ে যায়। তখন বাঁশের ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব ভালোই কাজ করে। সব তৃণের মতো বাঁশেরও হেলে পড়া ভাব এসে যেতে বাধ্য। কিন্তু চারা বা কোঁড়া বাঁশের হেলে পড়া ভাব থাকে না। বাঁশ অনেক বড় হলে পরিণত হওয়ার পর তার আগাটা ক্রমেই ভারী হতে শুরু করে। এ প্রক্রিয়া এক দিনের নয়, কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত চলে। ধীর এ প্রক্রিয়ায় প্রধান বাধা বাঁশের ভেতরকার তন্তু। মহাকার্য বল যতই তাকে নুয়ে ফেলার চেষ্টা করুক, বাঁশের শরীরের ভেতরে তন্তুগুলো কিছুটা হলেও বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে। আর তখনই কটকট শব্দ হয় বাঁশঝাড়ে। ঠিক দুপুরে মাঠ প্রায় নির্জন থাকে। সুনসান নির্জনতায় সামান্য শব্দও অনেক দূর থেকে শোনা যায়। গাঁয়ের মানুষ এতসব ব্যাখ্যার ধার ধারে না। তারা ভয় পেতে ভালোবাসে। নির্জন বাঁশঝাড়ে হঠাৎ কটকট শব্দ হলে তারা থমকে তাকায়। কিন্তু শব্দের উৎস খুঁজে পায় না। ফলে কাল্পনিক বেঁশোভূত সার্থক করে তার ভয় পাওয়াটাকে।
দুপুরে বাঁশ কটকট করার আরও একটা কারণ আছে। বিশেষ করে গ্রীষ্মের দুপুরে। প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে বাঁশের ভেতরের তন্তুগুলোর ভেতর ফাটল ধরে। সে সময় যদি একে কোনভাবে মোচড়ানো যায় তবে কটকট শব্দ তো হবেই। এখানে মোচড়ানোর কাজটা করে মহাকর্ষ ক্রিয়া। তাই চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরেই কটকটে ভূতের আনাগোনা বাঁশবাগানে বেশি।
এবার দেখা যাক পথরোধ করা ভূতের ব্যাপারটা। কেউ কি দেখেছে এঘটনা? এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যে নিজে দেখেছে। কেউ বলে তার চাচা দেখেছে, সেই চাচা আবার দশ বছর আগেই পটল তুলেছে। কেউ বলে তার অমুক আত্মীয় দেখেছে। কিন্তু সে থাকে অনেক দূরে। সুতরাং বেঁশোভূত দেখেছে এমন কাউকে পাওয়া যায় না। তাহলে রটনাটা রটল কীভাবে?
ধরা যাক, একজন চাষা তার গরু-বাছুরের পাল নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন। রাস্তায় পড়ল হেলে পড়া এক বাঁশ। এমন ভাবে হেলে আছে, এর নিচ দেয়ে গরু পার করার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। আবার বাঁশ যে লাফিয়ে পার হতে হয়, সে বুদ্ধিও গরুর নেই। যদি নিজে ইচ্ছা না করে শত চেষ্টা করেও চাষা গরুকে দিয়ে লাফিয়ে বাঁশ ডিঙোতে পারবে না। বেশি চেষ্টা করতে গেলে গরু বিগড়ে যেতে পারে। তখন চাষার সামনে সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি বাঁশটাকে আরেকটু হেলিয়ে নিচ করে ফেলা। গরু সহজেই তখন বাঁশ ডিঙোতে পারবে।
সাধারণত মেঠোপথের দুদিকেই গাছাপালা বা বাঁশঝাড়ের অভাব হয় না। হেলে যাওয়া বাঁশটাকে চাষা উল্টো দিকের কোনো গাছ বা বাঁশ ঝাড়ের সাথে বেঁধে ফেলতে পারে। এমনভাবে বাঁধতে হবে যেন বাঁশ টানটান হয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়ে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, চাষা দড়ি পাবে কোথায়? গায়ের মাঠে কখনও দড়ির অভাব হয় না। দড়ির মতো ব্যবহার করা যায় এমন লতার অভাব নেই মেঠোপথে। তাছাড়া কিছু গুল্মের ছালও ভালো দড়ির কাজ করে। এভাবে বাঁশটা বেঁধে সেটা ডিঙিয়ে আমাদের ওই চাষা চলে যায় নিজের গন্তব্যে। এরপর আসে পথিক। সে রাস্তায় শুয়ে পড়া বাঁশ পার হতে গিয়ে ঘটিয়ে ফেলে বড় এক বিপত্তি। তার লুঙ্গির সাথে আটকে য়ায় বাঁশের কেটে ফেলা কোনাও কঞ্চির চোখা আগা। পথিক হুমড়ি খেয়ে পড়ে। টান লাগে বাঁশের লতায় বাঁধা আগায়। তাতে যেনতেন প্রকারে বাঁধা লতাটা যায় ছিঁড়ে। মুক্ত হয় বাঁশ। পথিককে নিয়ে উঠে যায় বেশ খানিকটা উপরে। তারপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আছড়ে পড়ে রাস্তার ওপর। বিহ্বল পথিক কিন্তু খেয়ালই করেনি লতায় বাঁধা বাঁশের আগাটার দিকে। সে দেখে, বাঁশ যে-ই ডিঙোতে গেছে, অমনি অদৃশ্য শয়তান ভূতটা বাঁশটাকে উঁচু করে ধরেছে। বাড়ি ফিরে সে বউ-ছেলেমেয়ে-প্রতিবেশিদের কাছে বেঁশোভূতের খপ্পরে পড়ার কাহিনিই তো বলবে!
এবার দেখা যাক লতায় বাঁধা বাঁশ দেখে সাহসী পথিক কী করে। পথিকের জানা আছে, বেঁশোভূতের শয়তানীর কথা। সে দেখবে, পথের মাঝখানে সটান আস্ত একটা বাঁশ, তখন বেঁশোভূতের কথা মনে পড়বে। ভূতকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় সেকথাও মনে পড়বে। আশপাশ থেকে একটা ভারী লাঠি কুড়িয়ে নিয়ে বাঁশের গায়ে বসিয়ে দেবে জোরসে ঘা। এই আঘাত থেকে যে বলের সৃষ্টি হবে তার একটা অংশ ব্যয় হবে লতা ছিঁড়তে। লতায় বাঁধার কারণে যে বলটুকু বেঁধে রাখা হয়েছিল সেটাও মুক্ত হবে। সুতরাং দুই বল মিলে যে কাজটা করবে তাতে বাঁশটা আগে যে পর্যন্ত হেলে ছিল তারচেয়েও বেশি ওপরে উঠে যাবে। সাহসী পথিক তখন দেখবে কীভাবে সে বেঁশোভূতকে শায়েস্তা করেছে। এককান, দুকান হয়ে সেই ঘটনা ফুঁলে-ফেঁপে ছড়িয়ে পড়বে দূর দূরান্তে।