‘প্রেমের প্রস্তাব’, ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যান’ এবং একটি নারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ক্রমাগত ঘটছে এই ঘটনাগুলো। আর এই সব উন্মাদ, খুনি, লম্পট, ধর্ষকদের বলা হচ্ছে ‘প্রেমিক’। তারা নাকি প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কিংবা প্রেমিকার কাছ থেকে আঘাত পেয়ে ছুরি, দা, চাপাতি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের কথিত প্রেমিকার উপর।
এই কি প্রেম? আমি তো ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বিশ্বের সেরা প্রেমিকদের নাম। শিরি-ফরহাদ, হীর-রঞ্জা, লাইলি-মজনু, ত্রিস্তান-আইসল্ডে, রোমিও-জুলিয়েট। এইসব প্রেমিকরা তো প্রেমিকার জন্য নিজের জীবন ত্যাগ করেছে। বাস্তব জীবনের অনেক প্রেমিক তার প্রিয়তমাকে আঘাত করা তো দূরের কথা তার মুখে হাসি ফোটাতে সর্বস্ব ত্যাগ করতে রাজি। মানুষের জীবনের মহত্তম অনুভূতিগুলোর একটি হলো প্রেম যা যুগ যুগ ধরে শিল্পসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং মানুষকে নিয়ে গেছে পশুত্বের অনেক ঊর্ধ্বে
প্রেমের মতো একটি মহান বিষয়কে কলুষিত করা হয় যদি এইসব হারামজাদাদের ‘প্রেমিক’ বিশেষণ দেওয়া হয়। এরা মোটেই প্রেমিক নয়, প্রেমের ধারে কাছেও এরা নেই। প্রেম কখনও প্রিয়জনকে আঘাত করার জন্য নয়। প্রেমিক বড়জোর নিজেকে আঘাত করতে পারে, আাত্মাহুতি দিতে পারে। প্রেমিক কখনও খুনি হতে পারে না। আর প্রেম কখনও প্রস্তাব পাশ করে ঘটে না। প্রেম বা বন্ধুত্ব তো এইভাবে ঘোষণা দিয়ে, রঘু ডাকাতের মতো হুমকি ধমকি দিয়ে ঘটবে না। প্রেম হতে পারে পারষ্পরিক ভালোলাগার ভিত্তিতে কিংবা দূর হতে ভালোবেসে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এগুলো প্রেমের প্রস্তাব নয়, লাম্পট্যের প্রস্তাব কিংবা লাম্পট্যের হুমকি। এবং এই আক্রমণ, খুন সবই হত্যাপরাধ, মৃত্যুদণ্ডই যার শাস্তি হওয়া উচিত।
ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশা, মাদারীপুরের কালকিনির নবম শ্রেণির ছাত্রী নিতু মণ্ডলের পর এখন একই ধরনের ঘটনার শিকার হলো সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রী খাদিজা নার্গিস। এবারের লম্পটটি আবার শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে ছাত্রলীগেরও কর্মী। তবে এই ধরনের খুনি হামলাকারীদের কোনো দল নেই, পরিবার নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। থাকা উচিতও নয়। এদের একমাত্র পরিচয় এরা দুষ্কৃতিকারী, বদমাশ, খুনি। কোনো প্রতিষ্ঠানের, কোনো সংগঠনের, কোনো দলের উচিত নয় এদের দায়িত্ব নেওয়া বা এদের আড়াল করার চেষ্টা করা। বরং খুনি, বদমাশ যে দলেরই, যে প্রতিষ্ঠানেরই হোক তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সহযোগিতা করা উচিত প্রত্যেকের।
এগুলো মানুষ নামেরই অযোগ্য। পাগলা কুকুরের মতো এদের দেখামাত্র মেরে ফেলা উচিত। এদের মনোভাবটা হলো: তুই একটা মেয়ে; তোর আবার মতামত, ইচ্ছা অনিচ্ছা কিসের? আমি তোর শরীর চেয়েছি। তুই স্বেচ্ছায় দিলে ভালো, না দিলে তোকে ধর্ষণ করা হবে, অ্যাসিডে পোড়ানো হবে, আগুনে ঝলসানো হবে, না হলে তোকে খুন করা হবে। আমি যদি তোর শরীর না পাই তাহলে অন্য কোনো পুরুষকেও তা পেতে দিব না। আমি পুরুষ। তোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুরো অধিকার আমার। তোর দেহ, মন, বাঁচা মরা সবকিছু আমার হাতের মুঠোয়।
এটা হলো পুরোপুরি দখলদারী মনোভাব। চরদখল, জমি দখল, ডাকাতির মতো মনোভাব থেকে এরা ‘প্রেম’ নামক একটা কিছু করতে চায় এবং এদের নিন্মস্তরের বোধবুদ্ধি থেকে এরা নারীকেও মনে করে দখল করার মতো একটা যৌনবস্তু বিশেষ। জোর খাটিয়ে প্রেম করতে চাওয়া প্রেম তো নয়ই গুরুতর শয়তানি মাত্র। গণমাধ্যমের কাছে তাই আকুল আবেদন এই ধরনের গুরুতর অপরাধের রিপোর্ট করার সময় কখনও প্রেম শব্দটি বা প্রেমিক শব্দটি ব্যবহার করে একে কলুষিত করবেন না। বরং লিখুন লম্পট, বদমাশ, দুষ্কৃতিকারী। তাতে এইসব পিশাচদের চরিত্র পাঠকরা সহজে বুঝতে পারবেন।
আর দেশে এই যে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, একের পর এক নারী প্রাণ হারাচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তার তো কোনোই প্রতিকার হচ্ছে না। তনুর হত্যাকারীদের আজও ধরা যায়নি। ধামাচাপা পড়ে গেল মিতু হত্যার বিষয়টিও। আফসানার নামও আর কেউ উচ্চারণ করছে না। রবিন তো নাকি ভারতেই পালিয়ে গেছে। এর আগে এই রাজধানীতেই পহেলা বৈশাখের দিন প্রকাশ্যে নারীর উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ভিডিও ফুটেজে তাদের ছবি পর্যন্ত রয়েছে। তবু তাদের ধরা হয়নি। রাজধানীতে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে কর্মজীবী গাােরা তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
যখনি কোনো অপরাধ করে কেউ পার পেয়ে যায় তখনি নতুন আরো অনেক অপরাধীর জন্ম হয়। কারণ তখন সম্ভাব্য অপরাধী দেখে কই কিছুই তো হলো না। তখন সে আস্ফালন করার সুযোগ পায়, সে অপরাধ করতে সাহসী হয়। তার উপর যদি সে হয় কোনো রাজনৈতিক দলের লোক তাহলে তো আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে ভাবে আমাকে কে কি করবে। এগুলো সমাজে কুদৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। এজন্য কোনো রাজনৈতিক দলের তকমা ব্যবহার করে কেউ যেন আশ্রয় প্রশ্রয় না পায় সেদিকে রাজনৈতিক দলের কর্ণধারদের সতর্ক থাকা দরকার। বিচারহীনতা গুরু পাপে লঘু দণ্ড সমাজে অপরাধপ্রবণতাকে আরো উস্কে দেয়। আর যদি অপরাধের কঠোর শাাস্তি হয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় তখন অন্যরাও সাবধান হয়। অপরাধ করার আগে মানুষ তখন দশবার ভাবে। তখন আর হুট করে কেউ এমন গুরুতর অপরাধের পথে পা বাড়ায় না।
এই লেখাটি যখন লেখা হচ্ছে তখনও খাদিজা জীবন-মৃত্যুর সাঁকোতে দাঁড়িয়ে। জানি না সে বাঁচবে কিনা। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি সে বেঁচে থাকুক। সেই সঙ্গে খাদিজার উপর হামলাকারী পিশাচ বদরুলের কঠোর শাস্তি দাবি করছি। একই সঙ্গে তনু, মিতু, আফসানা, রিশা, নিতুর হত্যাকারীদেরও কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।