বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মাদকের ভয়ানক ছোবলে শুধু পুরুষেরা নয়, নারীরাও আসক্ত। কিন্তু মাদকাসক্ত নারীরা পুরুষের সমপর্যায়ের চিকিৎসা পাচ্ছেন না। জাতির স্বার্থে সবার উচিত এই সব নারীদেরকে পুরুষদের মতোই সাহায্য করা। আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মা, বোন, প্রেমিকা ও স্ত্রী। অথচ আমাদের অনেকেরই ধারণা মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্র শুধু পুরষদের জন্য, নারীদের জন্য নয়।
অনেক নারীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের আত্মসম্মানবোধ হয়ে ওঠে পর্বতসমান। লোক জানাজানির ভয়ে আসক্ত নারীটি হয় চার দেয়ালে গৃহবন্দী। প্রিয় পাঠক, আজ আমরা শুনব চারজন নারীর জীবনবার্তা-যারা অকপটে স্বীকার করেছেন তাদের মাদকাসক্তির সূচনা, পারিবারিক বেদনার মারাত্মক পরিণতি।
কেস স্টাডি: ১
প্রবাসে চাকরিরত বাবা-মায়ের অতি আদরের কন্যা সীমা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘কলেজের একাদশ শ্রেণিতে নেশাগ্রস্ত এক ক্যাডারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। সে তার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ফেনসিডিল-মদ খেত। কৌতূহলবশত আমিও তার সঙ্গে খেতাম।
কৌতূহলের মাত্রা নেশাতে রূপ নিলো। ফেনসিডিলের গন্ডি পেরিয়ে আমি হোরোইন ও ইয়াবাতে আসক্ত হয়ে পড়লাম। বাবা-মায়ের লাখ লাখ টাকা আমি নেশার জন্য নষ্ট করে দিয়েছি।
প্রবাসী টাকা আমার অ্যাকাউন্টে আসতো, আর পুরোটা আমি নেশার জন্য খরচ করতাম। ইন্টার পাসের পর আমার নেশাগ্রস্ত প্রেমিককে আমি বিয়ে করলাম, সন্তানও হলো। সন্তান কোলে নিয়েই আমি মাদকের আস্তানায় যেতাম। জানাজানি হবার পর আত্মীয়-স্বজনেরা সম্পর্ক ছিন্ন করলো।
প্রবাস থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হলো। নেশার জন্য টাকার প্রয়োজনে স্বামী আমাকে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করলো। আমার সন্তানটা বড় হতে লাগল। সেও বুঝতে পারলো। আমাকে প্রায়ই বলতো, মা তুমি ভালো হয়ে যাও, নেশা ছেড়ে দাও, আমি স্কুলে গেলে সবাই আমাকে বলবে, তোমার মা নেশা করে। সন্তানের এই ব্যাকুলতা আমার মনে দাগ কেটে দিত। তার ভবিষ্যতের জন্যই আমি নিরাময় কেন্দ্রে এলাম। আজ উনিশ বছর পর নেশার জগত থেকে আমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
কেস স্টাডি: ২
দরিদ্রতা আর বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহে কণা (ছদ্মনাম) মানসিক হতাশায় ভুগতেন। তিনি বলেন, ‘সংসারের অভাব মেটানোর জন্য আমি ইট ভাঙা, বালু টানার কাজ করতাম। সেখানে দালাল মহিলা কৌশলে আমাকে যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয়। সেই পল্লীর মেয়েরা শারীরিক, মানসিক কষ্ট নিরসনের জন্য হেরোইন খেত। তাদের দ্বারা আমিও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। প্রথমে খেতাম সিগারেট ভেবে, পরে দালাল মাসিরা দিত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বলে। ১৫ বছর যাবৎ হেরোইন-গাঁজা খেতাম; পতিতালয় থেকে বের হয়ে বিবেকের তাড়নায় আমি নেশা ছেড়ে দিলাম। নেশা ছাড়ার জন্য অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। সব কিছু বলে বোঝানো যায় না।
কেস স্টাডি-৩
১৩ বছর ধরে ফেনসিডিল-গাঁজা, হেরোইনে আসক্ত ছিলেন মিতা (ছদ্মনাম)। মাদকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, স্বামীর সঙ্গে ক্ষুদ্র মনোমালিন্যে আমি বাবার বাসায় যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে বাসস্ট্যান্ডে দালালের পাল্লায় পড়লাম। গর্ভস্থ সাত মাসের শিশুসহ আমি বিক্রি হয়ে গেলাম যৌনপল্লীতে।
সেটা ছিল মাদকের আখড়া। যৌনপল্লীতে আসা খদ্দেরদের দ্বারা আমি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ি। হেরোইন নিলে প্রথমে বমি হতো, পরে তিন বেলায়ই নিতে হতো। এভাবে আমি প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে যাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে আমি পথে-ঘাটে পড়ে থাকতাম। নিরাময় কেন্দ্রের কর্মীরা আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনে ভালো করেছে। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। নেশার জন্য আমার আর খিঁচুনি ওঠে না।
কেস স্টাডি-৪
মাদকাসক্ত স্বামীর প্রভাবে কৌতূহলবশত আমিও আসক্ত হয়ে যাই, বলেন তৃষা (ছদ্মনাম)। পাঁচ বছর মাদকে আসক্ত হয়ে আমি আমার সব আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। তারা আমাকে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে।
আমার দুই সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য আমি মাদকের ভয়াল জগৎ থেকে মুক্ত। মাদকের সুচ আমার দেহে আর ফুটাতে হয় না।
এই চারজন নারীই মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসারত ছিলেন। বর্তমানে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ। নড়বড়ে জীবনে শক্ত অবলম্বনের জন্য তারা সেলাই ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণে ব্যস্ত।
ভালো হওয়ার জন্য নিজেদের তাগিদ এবং নিরাময় কেন্দ্রের জন্যই তারা ফিরে পেয়েছেন নতুন জীবন। তারা চান, তাদের মতো কেউ যেন কষ্টের শিকার না হয়। কৌতূহলেও যেন একবিন্দু মাদক না নেয়।
এ দেশে পুরুষদের সঙ্গে আসক্ত নারীদের সংখ্যাও বেড়ে চলছে। অথচ তাদের চিকিৎসার জন্য এখনও পরিবার, সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারি, বেসরকারিভাবে রয়েছে মাদক নিরাময় হসপিটাল। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ফলে প্রতিষ্ঠানের অভাব আর সামাজিক সম্মানহানির জন্য নারীদের চিকিৎসা হচ্ছে চার দেয়ালের বৃত্তে। যা একজন মাদকাসক্ত নারীর জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ প্রসঙ্গে মনোচিকিৎসকেরা বলেন, মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ। তাই সঠিকভাবে চিকিৎসা করালে এই রোগ অবশ্যই ভালো হবে। কখনোই আশা ছাড়বেন না।
মাদক নিরাময় কেন্দ্র ‘আপন’-এর পরিচালক প্রয়াত ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল বলতেন, ‘মাদকাসক্ত নারীদের প্রতি কখনোই বিরূপ আচরণ করবেন না। তারা পরিস্থিতির শিকার।
এমন অনেক ঘটনা আছে-যারা ৩০ বছর যাবৎ মাদক নেওয়ার পরও ভালো হয়ে গেছেন। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। মিডিয়া ও পরিবারকে আরো সচেতন হতে হবে।
আমরা মাদকাসক্ত নারীদের চিকিৎসা দেই তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত।
মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ কারও প্রতিই অবহেলার দৃষ্টি দেবেন না। আমাদের সমাজে নারীরা তুলনামূলকভাবে আরও বঞ্চনার শিকার। তাই মাদকাসক্ত নারীরা হচ্ছেন ভয়াবহ পরিণতির পাত্রী।
সীমা, কণা, মিতা, তৃষা এতো বছর পরে মাদক ছেড়ে দিলে অন্যরাও পারবেন। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও মানসিক সহযোগিতা। প্রতিটি মাদকাসক্ত নারীর আকাশ থেকে কেটে যাক নেশার মেঘ। মাদকমুক্ত সুস্থ জীবনের আলোয় আলোকিত হোক তার চলার পথ।
লেখক: ডা. ফারহানা মোবিন, স্কয়ার হসপিটাল, ঢাকা।