বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ছেলেটি ইহুদি ছিল। মদিনায় রাসুল (সা.)-এর ঘরের অনতিদূরেই ছিল তার ঘর। নিয়মিত এসে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর খেদমত করত। তার ছোট ছোট কাজগুলো করে দিত। ওজুর পানি এনে দিত। রাসুল (সা.) যখন ঘর থেকে বের হতেন অথবা মসজিদে যেতে চাইতেন, তখন সে প্রিয়নবী (সা.) এর জুতাগুলো সামনে এনে দিত।
কাউকে কোনো পয়গাম পাঠাতে হলে বা কাউকে কোনো কিছু দিতে হলে অথবা কোনো কিছু আনতে হলে- এই ছেলেটি দৌঁড়ে যেত এবং রাসুল (সা.) এর কাজটা করে দিত। ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলোতে ছেলেটির নাম পরিস্কারভাবে আসেনি। অবশ্য তার নাম অজানা ও অনুল্লেখ থাকলেও কোনো সমস্যা নেই।
একদিন ইহুদি ছেলেটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। কয়েকদিন রাসুল (সা.) এর খেদমতে আসতে পারেনি। আল্লাহর রাসুল (সা.) লক্ষ করলেন, যে ছেলেটি সকাল-বিকেল তার সেবায় উপস্থিত থাকত, কয়েকদিন ধরে তাকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি দ্রুত ছেলেটি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন। সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় সে?’। জানানো হলো, ছেলেটি খুব অসুস্থ। কয়েকদিন ধরে শয্যাশায়ী।
পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম মানুষটি যখন জানতে পারলেন, তার প্রিয় ছোট্ট বালকটি অসুস্থ, তখন তিনি ইহুদিপল্লীতে তাকে দেখার জন্য তার ঘরে আগমন করেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন ওই ইহুদি ছেলেটির ঘরে পৌঁছলেন, তখন ছেলেটির পিতাও ঘরে উপস্থিত ছিল।
ছেলেটির কী সৌভাগ্য! আল্লাহর রাসুল (সা.) তাকে দেখার জন্য তার ঘরে আগমন করেছেন!! সে তখন খাটে শায়িত ছিল। রাসুল (সা.) তার শিয়রে বসে তাকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকলেন। কেমন লাগছে তার জিজ্ঞাসা করলেন। পরিশেষে জানতে পারলেন, ছেলেটি এখন জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পার করছে।
প্রিয় পাঠক! অন্যের প্রতি রাসুল (সা.) এর ভালোবাসা, মানুষের প্রতি অভাবনীয় কল্যাণকামিতার প্রতি লক্ষ্য করুন। তিনি যখন দেখলেন, ছেলেটি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন চিন্তা করলেন, সম্ভব হলে তাকে জাহান্নামের আজাব থেকেও বাঁচানোর চেষ্টা করা যায়। সুতরাং তার জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার পূর্বেই আল্লাহর রাসুল (সা.) ছেলেটিকে সম্বোধন করে বললেন, “হে ছেলে! ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো।”
ছেলেটি এ কথা শোনে চোখের পাতা খুলে রাসুল (সা.) এর আলোকময় চেহারার দিকে তাকালো। তারপর ছেলেটি পার্শ্ব পরিবর্তন করল। নিজ চেহারাটা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিতার দিকে ফেরলো। ছোট ছেলে, বাচ্চা মানুষ। তাই হয়ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পিতার দিকে তাকিয়ে অনুমতি চাচ্ছিল। ছেলেটির বাবা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি ঈমান আনেনি ঠিক। কিন্তু সে জানত, মুহাম্মদ (সা.) সত্য নবী। তাই সন্তানকে বলল, ‘প্রিয় ছেলে! তুমি আবুল কাসেমের কথা মেনে নাও।’ (অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) যা বলছেন, তার উপর আমল করো। আর আবুল কাসেম প্রিয়নবীর উপনাম ছিল।)
তার পিতা অনুমতি দেওয়ামাত্রই ছেলেটি পড়তে শুরু করলো-‘আশহাদু আল-লা ইলাহা, ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’ অর্থাৎ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুল।’
এদিকে তার মুখ থেকে এসব বাক্য বের হয়েছে, আর ওদিকে তার জীবনের অবশিষ্ট মুহূর্তগুলোও দ্রুত ফুরিয়ে গেল। সে শেষ কয়েকটি নিঃশ্বাস নিল। অতঃপর নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে নিল।
আল্লাহর রাসুল (সা.) তার ঘর থেকে সন্তুষ্টচিত্তে বেরিয়ে এলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এখন তিনি নিশ্চিন্ত। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তার স্তুতি ও প্রশংসা করে বললেন, ‘সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি আমার মাধ্যমে ওই ছেলেটিকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেছেন।’
সম্মানিত পাঠক! আসুন একটি চিন্তা করি, আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) কত উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন! তিনি এত দয়ালু ও স্নেহপরায়ণ ছিলেন যে, তিনি শুধুমাত্র মুসলমানদের সঙ্গে নয়; বরং কাফির ও ইহুদিদের সঙ্গেও ভালো আচরণ করতেন।
রাসুল (সা.) মানবতার সাফল্য এবং মানবতার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা এমন পর্যায়ে করেছেন যে, তার সামনে দিয়ে একদিন একটি জানাজা যখন অতিক্রম করছিল, তখন তিনি জানাজার সম্মানে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। এক সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটা তো ইহুদির জানাজা।
তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘সে কি মানুষ নয়?’ অন্য একটি হাদিসের বর্ণনা মতে, জানাজাটি দৃষ্টির আড়াল হওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ইহুদি ছেলেটি তার খাদেম ছিল। সে কোনো ধনী ব্যক্তি ছিল না। কোনো গোত্রের সর্দারও ছিল না। রাসুল (সা.) বিশ্ববাসী ও পুরো মানবতাকে শিক্ষা দিতে চাচ্ছিলেন যে, ইসলামে নৈতিকতা কাকে বলা হয়। একজন ছোট মানুষও যদি অসুস্থ হয়, তাকে দেখতে যাওয়া কর্তব্য।
ছেলেটির মৃত্যুর পর আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের নামাযে জানাযা পড়ো।’ কারণ সে মুসলমান। তাকে রাসুল (সা.) আগেই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে বলেছেন, ‘সেই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, যিনি আমার মাধ্যমে তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছেন।’
সম্মানিত পাঠক! তিনিই হচ্ছেন আমাদের প্রিয়নবী ও রাসুল (সা.), যিনি মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে খুবই খুশি ও নিশ্চিন্ত হতেন। ইসলাম কবুল না করলে তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যেত। কাফিররা ঈমান না আনলে তার অবস্থা কি হতো; তা সম্মন্ধে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি মনে হয়, তাদের (কাফিরদের) চিন্তায় নিজেকে এই দুঃখে শেষ করে দেবেন যে, ওসব লোক এই কোরআনের প্রতি কেন ঈমান আনছে না।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ০৬)
লেখক, গবেষক-আলেম এবং অনুবাদক, বাংলাদেশ দূতাবাস, রিয়াদ, সৌদি আরব।