বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার পরিচালনায় এসেছে আওয়ামী লীগ। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন চতুর্থবারের মতো। এর মাধ্যমে বিরল এক অর্জনের অধিকারী হলেন শেখ হাসিনা। এখন তিনি দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির যে ধারাবাহিকতা তা ধরে রাখতে কাজ করছেন। আবার টেকসই উন্নয়নের যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা-ও জয় করতে হবে বাংলাদেশকে। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর দেশের হাল ধরে যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলতেন, তার জন্য দ্বিতীয় সংগ্রামের কথা বলতেন, তা নতুন মাত্রায় শুরু করেছেন শেখ হাসিনা।
দেশকে উন্নয়নের যে পথে নিয়ে গেছেন তিনি, তা আরো উচ্চতায় নিতে চাইছেন। তার জন্য এবার তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দুর্নীতি দমন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিচ্ছেন। টেকসই উন্নয়নের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। কারণ কোনো কিছু সংখ্যার দিকে দিয়ে বাড়লেই হবে না, তা দীর্ঘস্থায়ী হতে হবে, গুণগতমানেও উন্নত হতে হবে। এটাই আসলে টেকসই উন্নয়নের মূলমন্ত্র।
যা হোক, নতুন সরকার আসার ডামাডোলের মধ্যেই দেশ নিয়ে আমরা বাইরের পৃথিবী থেকে আশাবাদী হওয়ার মতো খবর পেয়েছি। নতুন বছরের জানুয়ারির গোড়ার দিকেই জানা গেল আমাদের অর্থনীতির বর্তমান যে আকার তা বিবেচনায় ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিলে’ দুই ধাপ এগিয়ে বিশ্বে ৪১তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ ‘সিইবিআর’ বলছে, অর্থনীতির এই গতি ধরে রাখতে পারলে ২০৩৩ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব বিল্ডিংয়ের অর্থায়নে সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ এবং গ্লোবাল কনস্ট্রাকশন পার্সপেকটিভস যৌথভাবে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল (ডব্লিউইএলটি) প্রকাশ করে। তাদের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে অর্থনীতির আকার বিবেচনায় বিশ্বের ১৯৩টি দেশের এ টেবিলে বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে ৪১তম অবস্থানে। গত বছর এ তালিকায় বাংলাদেশ ৪৩ নম্বরে ছিল।
২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একটি দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর তথ্য বিবেচনায় নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বিচার করে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত একটি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে এ প্রতিবেদনে। এই পূর্বাভাস ঠিক হলে বাংলাদেশ ২০২৩ সালে বিশ্বের ৩৬তম, ২০২৮ সালে ২৭তম এবং ২০৩৩ সালে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।
২০০৯ সালের তালিকায় প্রথম তিনটি অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল’ বলছে, ২০৩৩ সালে বিশ্বের তিন শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ গত এক দশকে ৬.৩ শতাংশের বেশি হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু আয় বাড়ায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ভারত সেলস ট্যাক্স চালু করায় বাংলাদেশের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে সুবিধা পাচ্ছে, পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ভোগ ব্যয় বাড়ায় অর্থনীতির গতি বাড়ছে বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
অবশ্য বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.৪ শতাংশ থেকে কমে ২০১৮ সালে ৭.৩ শতাংশ হতে পারে এবং চলতি হিসাবে গত বছরের ঘাটতি এবার আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছে সিইবিআর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আধুনিকায়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বড় দুটি ঝুঁকির বিষয় হয়ে রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিগুলো ঠিক রেখেই রাজস্ব আদায় কীভাবে আরও বাড়ানো যায় তা খুঁজে দেখতে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবারের প্রতিবেদনে। তবে এটা পরিষ্কার যে, গত পাঁচ বছর দেশের অথর্নীতি সামনের দিকে যাচ্ছে। অনেক চ্যালেঞ্জ উতরে এই সময়ের মধ্যে অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষিত করা সম্ভব হয়েছে।
উন্নয়ন-অগ্রগতি ধরে এবং তা আরো গতিশীল করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন নতুন সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগের সরকারে তাকে আমরা পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম। যেখানে তিনি সফলতা দেখিয়েছেন। তিনি একজন ক্রীড়ামোদী হিসেবেও যথেষ্ট পরিচিত মুখ। একজন ব্যবসায়ী হিসেবেও পরিচিতি আছে। তবে তিনি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। তাই তো নতুন দায়িত্ব গ্রহণের সময় মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘এটা আমার সাবজেক্ট, আমি ওই সাবজেক্ট নিয়েই লেখাপড়া করেছি। সুতরাং এটুকু বলতে পারি যে, আমি আপনাদের মিথ্যা আশ্বাস দেব না। আমি ফেল করব না। আমার বিশ্বাস, আপনারাও ফেল করবেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে আমাদের অর্থনীতিকে আরও অনেক শক্তিশালী অবস্থানে আমরা নিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।’
চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে তিনি আশার কথা শুনিয়েছেন। বলেছেন, এ বছর বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে বাংলাদেশের। আশা করছি চলতি অর্থবছরে আমরা প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২৫ থেকে ৮ দশমিক ৩০ অর্জন করতে পারব। বিশ্বব্যাংক সাড়ে ৬ ভাগের বেশি আমাদের প্রবৃদ্ধি হবে না বলত। এবার বিশ্বব্যাংক নিজেরাই বলেছে আমাদের সাত ভাগের ওপরে প্রবৃদ্ধি হবে। এ বছর আমাদের যে অর্জন হবে, এটি হবে সারা বিশ্বের সর্বোচ্চ।
আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকলেও খেলাপি ঋণ নিয়ে অনেকেই উদ্বেগের কথা বলেন। এ নিয়ে আশ্বস্ত করে নতুন অর্থমন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমরা একটি জায়গায় ঐকমত্যে পৌঁছেছি, মূল যে এলাকা মূল যে চিন্তা সেটি হচ্ছে খেলাপি ঋণ। এটি আপনাদের উৎকণ্ঠা, জাতির উৎকণ্ঠা, আমাদের উৎকণ্ঠা এবং আমার উৎকণ্ঠা। তবে আমার উৎকণ্ঠা কিছুটা কম। কেননা এরই মাঝে আমি দেখেছি যেভাবে পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়, সে পরিমাণ খেলাপি ঋণ নেই। এর হার ১১ থেকে ১২ শতাংশ। এর চেয়ে অন্যান্য দেশে আরো বেশি। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও আরো বেশি। খেলাপি বা ননপারফরমিং লোন কমলে ব্যাংক সুদের হার কমে যাবে, সুতরাং এটা কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া হবে না।’
আমাদের বর্তমান উন্নয়নের পেছনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির বিষয়টি। এটা যেমন ব্যক্তির, তেমনি সমাজের, তদুপরি রাষ্ট্রের। আমাদের জাতীয় বাজেট এখন পরনির্ভর নয়। মূলত রাজস্ব বাড়ায় সরকার অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে পারছে। নতুন অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আদায়ে আরও গতি আনতে চান। তা বাড়াতে চান। তাই তো দায়িত্ব নিয়েই তিনি চলতি অর্থবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) তিন লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এজন্য সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়ে রাজস্ব কাঠামো ঢেলে সাজাতে বলেছেন তিনি। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আড়াই লাখ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারবে বলে জানিয়েছে। এই অঙ্কও কিন্তু কম নয়। কারণ এক দশক আগে পরিস্থিতি ছিল অন্য রকম।
তাই তো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজস্ব খাত গতিশীল হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেছেন, ‘২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৫০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি রাজস্ব পাওয়া যেত। এটি এখন দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।’
রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে এখন ৩৭ লাখ নিবন্ধিত করদাতা রয়েছে। তবে আয়কর রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে ১৫-১৬ লাখ। এটা বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে প্রায় চার কোটি মধ্যবিত্ত রয়েছে। মধ্যবিত্তরা চাইলেই বছরে ৫-১০ হাজার টাকা কর পরিশোধ করার ক্ষমতা রাখে। এদের করের আওতায় এনে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে।
দেশের অর্থনীতির যে গতিপ্রবাহ তাতে রাজস্ব আয় বাড়তে থাকবে, বাড়বে প্রবৃদ্ধি। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেও দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। অর্থনীতি বড় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি বৈষম্যও বেড়েছে। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন করতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের বিকল্প নেই। এ কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা আরো বলছেন, অর্থনীতির আরো উদারীকরণ করতে হলে একটি আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজার নিশ্চিত করতে হবে। এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আসবে। ম্যাক্রো-ইকোনমিতে সরকারের কাজ হলো একটি সুষ্ঠু বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা। এজন্য আর্থিক নীতিতে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য স্থির করতে হবে।
এসডিজি অর্জনের জন্য সম্পদের সঠিক স্থানান্তরের বিষয়টিতে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। তবে শ্রমবাজার আরো উন্মুক্ত করার আগে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একটি বিষয় অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। কয়েক বছর ধরেই প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্বও বেড়েছে। আমদানি ব্যয় বাড়লেও নতুন বিনিয়োগ আসছে না। তাই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাই হবে বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জ। মালিক-শ্রমিক সব পক্ষের অধিকার সুরক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস, সম্পদের সুষম বন্টন-এ সব বিষয়ে কাজ করতে হবে সরকারকে।
অর্থনীতিতে আমরা এখন অনেকটাই আত্মনির্ভর। তবে বিদেশি সহায়তা নানা দিক দিয়ে প্রয়োজন। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। এখানেও নতুন মন্ত্রী এসেছেন। দায়িত্ব পেয়েছেন এ কে আবদুল মোমেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ কুটনীতিক। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দূতাবাসগুলোকে আরও সক্রিয় করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। কেননা বিদেশে নতুন নতুন শ্রমবাজার ধরতে হলে রাষ্ট্রদূতদের বড় ভূমিকা রাখতে হবে। রপ্তানির নতুন নতুন খাত উন্মোচনেও দিক-নির্দেশনা দিতে পারেন তারা। এর জন্য অবশ্যই তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে হবে। এর কোনো বিকল্পও নেই। কারণ আমাদের এখন যে জাতীয় আয়, তার প্রধান দুটি আসলে বিদেশনির্ভর। একটি হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি। অন্যটি তৈরি পোশাক রপ্তানি। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতেও দূতাবাসগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারে। এসব বিষয় নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভালোই ওয়াকিবহাল আছেন। তাই আমরা আশাবাদী হতেই পারি।
বর্তমান সরকারের জন্য মধুর একটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পআয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের কাতারে যাচ্ছে, যা দারুণ একটি অর্জন। কিন্তু বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিভিন্ন দেশে যে ধরনের বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকে, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থায়ী হয়ে গেলে সেসব সুবিধা হারাবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে ২০৩০ সাল নাগাদ বেশ কিছু কঠিন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর সঙ্গে লক্ষ্য রয়েছে ২০৩০ সাল নাগাদ একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত বিশ্বের কাতারে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ। এগুলো অর্জন বড় লড়াই, কিন্তু ধরে রাখতে পারা হবে আরো বড় লড়াই।
বিগত এক দশকের অগ্রগতির মধ্যেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা শোনা যায়। দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এর জন্য বিনিয়োগ পরিবেশ ও প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। কেননা প্রতিযোগী দেশগুলো যদি এক্ষেত্রে এগিয়ে যায়, তবে আমরা পিছিয়ে পড়ব। তাই আমাদের আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে। এছাড়া অবকাঠামোগত ও আমলাতান্ত্রিক যেসব জটিলতার কথা বলা হয়ে থাকে, সেগুলোর সমাধান করতে হবে।
বিনিয়োগ গতিশীল করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এক দরজায় সব সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করতে যাচ্ছে। সেখানে বিনিয়োগকারীরা আপাতত অনলাইনে একই সঙ্গে ১৮টি রাষ্ট্রীয় পরিষেবা গ্রহণ করতে পারবে। এই সেবা বিনিয়োগকারীদের সময় ও ব্যয় কমাতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষও (বেজা) এই ধরনের সেবা দিবে। বিনিয়োগকারীরা সব সেবা তাদের কাছ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে পাবে।
বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচক বা ডুইং বিজনেস ইনডেক্সে উন্নতির অংশ হিসেবে সরকার ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। ডুইং বিজনেস ইনডেক্সে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে আসতে চায়। এই সূচকে এখন বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম। এজন্য ২৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দ্রুত সেবাদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে কাজ চলছে। এই উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এর মাধ্যমে বিনিয়োগ গতি পাবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
কর্মসংস্থান সরকারের জন্য এক চ্যালেঞ্জ। বছরে অন্তত ২০ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি যুক্ত হচ্ছে বাজারে। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে দেশের ভেতরে তাদের সবার কাজ নিশ্চিত হচ্ছে না। তাই অনেকে দেশের বাইরে কাজের সুযোগ করে নিচ্ছে। আবার একটি অংশ থেকে যাচ্ছে বেকার। যাদের মধ্যে আবার বড় একটা অংশ শিক্ষিত। তাই আমাদের এখন কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে হবে। এর অন্যান্য সমাধান নিয়েও ভাবতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্টদের। প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা অবশ্য সরকারের উদ্যোগে নতুন গতি পেয়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের যে দর্শন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সমালোচনা করছে একটি মহল। তাদের দাবি, দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার কমে যাচ্ছে। আমি তাদের সাম্প্রতিক একটি বিদেশি সূচক দেখতে বলবো। যেখানে দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ বহুজাতিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট গ্রুপের বিজনেস ইউনিট ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ (ইআইইউ) সম্প্রতি ২০১৮ সালের এই বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচক প্রকাশ করেছে। এবারের সূচকে বাংলাদেশ ৫.৫৭ পয়েন্ট (১০-এর মধ্যে) নিয়ে ৮৮তম স্থানে আছে। এক বছর আগে ৫.৪৩ স্কোর নিয়ে ছিল ৯২তম স্থানে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল এই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। সে হিসাবে বাংলাদেশ আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এগিয়েছে চার ধাপ।
আমি আশাবাদী বর্তমান সরকার উন্নয়ন-অগ্রগতিতে টেকসই করার যে চ্যালেঞ্জ, তাতে অবশ্যই জয়ী হবে। চরমপন্থার প্রতিরোধের বিপরীতে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক আবহও আরও গতিশীল হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার যে সংগ্রামে হাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাতে তিনি সফলকাম হবেনই। বাংলাদেশকে কেউ আর দাবায়ে রাখতে পারবে না।
মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার