আত্মহত্যা ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছেন কখনো? একটু পড়াশুনা করতে পারলে ভাল হতো। মনোবিজ্ঞানীরা, সমাজবিজ্ঞানীরা অনেক কাজ করেছেন আত্মহত্যা নিয়ে। আত্মহত্যার রাজনীতিও আছে, দর্শনও আছে। আমি বেশ কিছু তরুণকে জানি, আমাদের এই ঢাকা শহরেই, যারা রাজনীতি ও দর্শনের পাঠ করেছেন গভীরভাবে। ওদের মতো পড়াশুনা থাকলে হয়তো আমিও ব্যাখ্যা করতে পারতাম। এমনিতে মোটাদাগে একটা ব্যাপার তো আছেই আরকি- ভোগবাদী অর্থনীতি মানুষকে এলিয়েনেট করে দেয়। এইরকম এলিয়েনেশন থেকে সমাজ সংসারে একজন মানুষ নিজের জীবনের কোন প্রাসঙ্গিকতা পায়না। প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলে, অর্থ হারিয়ে ফেলে। তার সাথে যদি যুক্ত হয় তীব্র ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতা তখন তার কাছে আর বেঁচে থাকার কোন অর্থ থাকে না।
আর এই কথাটা তো আমরা সবসময়ই শুনি। আত্মহত্যাগুলির কারণ মানসিক অসুস্থতা। গভীর ডিপ্রেশন থেকে নাকি আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। আরও কি সব ডিজর্ডার নাকি আছে যেগুলির কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। সিজোফ্রেনিয়া নাকি এরকম একটি ব্যাধি।
আত্মহত্যার প্রবণতা আছে এরকম মানুষ আমি দেখেছি। নানারকম ইমোশনাল কারণে ধুমধাম ঝুলে গেল বা লাফ দিল বা একমুঠো ওষুধ গিলে ফেলল এইরকম করতে দেখেছি আমি কয়েকজনকে। এইগুলি তো দৃশ্যতই মানসিক ব্যাধি।
কিন্তু দৃশ্যত এইরকম কোন মানসিক ডিজঅর্ডার নাই এরকম কেউ কেউও তো আত্মহত্যা করে। ওরা কেন করে? বিশেষ করে যারা ‘তোমাকে পেলাম না’ বলে আত্মহত্যা করে ওদের কথা কি বলবেন? ‘তোমাকে পেলাম না’ বলে তো আর কোন মানুষের জীবন ব্যর্থ হতে পারেনা। আর কাউকে ‘পাওয়া’ তো আর একজনের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যও হতে পারেনা। এই কথাটি কি ওরা জানেনা? নিশ্চয়ই জানে। তার পরেও কেন আত্মহত্যা করে? এমনকি হতে পারে যে ‘তোমাকে পেলাম না’ এই অনুভূতির চেয়ে নিজের অহমে আঘাতটা মানুষকে বেশী আপ্লুত করে আর সেজন্যেই আত্মহত্যা করে?
আরেকটা কারণের কথা কি কেউ ভেবেছেন- ‘তোমাকে পেলাম না’ বলে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে এমন কি হতে পারে যে মেয়েটির বা ছেলেটির আত্মহত্যার জন্যে আসলে আমরা সকলেই অর্থাৎ কিনা আমাদের সমাজ সংস্কৃতি প্রথা বিশ্বাস এইসবই দায়ী? কিভাবে? চিন্তা করেন।
মেয়েদের ক্ষেত্রে তো ‘তোমাকে পেলাম না’ বলে আত্মহত্যার প্রায় প্রতিটি ঘটনায়ই পুরুষবাদ বা পিতৃতান্ত্রিকতা দায়ী। কেন? কেননা একটি নারী শিশুকে আমরা ছোটবেলা থেকেই শেখাতে থাকি যে মনোগামি হচ্ছে একজন নারীর জন্যে একটি পবিত্র ব্যাপার, একজন নারী তার জীবন একজন পুরুষের ভোগের বস্তু হয়েই কাটাতে হবে। এর ব্যতয় হলে পাপ। এর ব্যতয় হলে খারাপ। ভাল মেয়েরা একজন পুরুষের জন্যে তার শরীর রক্ষা করবে। সেই পুরুষটি হচ্ছে তার স্বামী। বিবাহের পর নারীটি তার দেহ তুলে দেবে স্বামীর হাতে। এর আগে যদি তাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করে তাহলে সে অপবিত্র হয়ে যাবে। আমরা মেয়েদেরকে কি শেখাই? তোমাকে অক্ষতযোনি থাকতে হবে। বিয়ের রাতে স্বামী যেন রক্ত দেখে। সেটা না হলে তুমি অসতী। তুমি নীচ। তুমি অপবিত্র।
এখন চিন্তা করেন মেয়েটির কথা। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওর কি কোন ছেলেকে ভাল লাগবে না? সে কি প্রেমে পড়বে না? সে কি কামনা করবে না তার প্রিয় একজন পুরুষকে? হাঁ, করবে। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি মানবিক ব্যাপার। ধরেন মেয়েটি খুবই সতর্কতার সাথে পছন্দ করে এমন একজনের সাথে প্রেম করলো সেটাকে আপনাদের অর্থে একটি মানানসই পাত্র বলা যায়। এক বছর, দুই বছর বা তিন বছর যদি ওরা প্রেম করে ওরা কি শারীরিকভাবে কাছে আসবে না? মিলিত হবে না দুজনে? কেন হবে না? দুজন দুজনকে ভালোবেসে মিলিত হওয়ায় তো অন্যায় কিছু নাই।
এখন যদি কোন কারণে প্রেমটি ভেঙে যায়, নানা কারণেই প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে। প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর ছেলেটির কি প্রতিক্রিয়া হয় আর মেয়েটির কি প্রতিক্রিয়া হয়? না, দুঃখ দুজনেই পেতে পারে। দেবদাস পুরুষরাই হয়। কিন্তু পুরুষবাদ বা পিতৃতন্ত্র নারীকে একটা স্টিগমা দেয়। কলঙ্ক। পুরুষের কলঙ্ক হয় না, কলঙ্ক হয় নারীরই।
আপনি তো কন্যাকে শিখিয়েছেন নারীকে বিবাহের আগে পর্যন্ত অক্ষতযোনি থাকতে হবে। আপনি তো কন্যাকে শিখিয়েছেন বিবাহের আগে পুরুষের সাথে সঙ্গম করা মানে তুমি বাজে মেয়ে। আপনি তো কন্যাকে শিখিয়েছেন একাধিক পুরুষের সাথে মিলিত হয় কেবল নষ্টা মেয়েরা। এখন আপনার কন্যার প্রেমিকটি তাকে ত্যাগ করেছে। যে কারণেই করুক, করেছে। এখন কি হবে?
আপনার কন্যার মনে কি প্রতিক্রিয়া হবে ভেবেছেন? ‘তোমাকে পেলাম না’ বলে তার মনে একটা দুঃখ তো আসবেই। সকল বিচ্ছেদেই এটা আসে। কিন্তু তার সাথে কি যুক্ত হয়? স্টিগমা। সে বিবাহের পূর্বে পুরুষের সাথে সঙ্গম করেছে। সে তো তাহলে অসতী হয়ে গেল। বাবা মায়ের চোখে সমাজের চোখে সে তো আর ভাল মেয়ে না। তার নিজের যে সমাজ, তার বন্ধুরা, ওরা কি বলবে? ওদের চোখে তো সে নষ্টা হয়ে গেল। একটি ছোট মেয়ে, বিশ একুশ বা বাইশ বা তেইশ বা চব্বিশ বছর বয়স, ওর কাঁধে কি সেই শক্তি আছে যে সে এই স্টিগমা বা কলঙ্কের ভার বহন করতে পারবে? না। মেয়েটির সেই শক্তি থাকে না। কেননা আপনি তাকে সেই শিক্ষা দেননি।
ওর বাবা-মা ওর স্কুল কলেজ কোথাও কেউ তাকে এই কথা বলেনি যে, মেয়ে তুমি একটা ক্যান্ডি নও যে কেউ একজন তোমাকে চেটে দিলেই তুমি নষ্ট হয়ে যাবে। কেউ তাকে বলেনি যে ভালোবেসে প্রেমিকের সাথে মিলিত হওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কেউ তাকে বলেনি যে যৌনতা কোন নোংরামি নয়- এটি একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। কেউ তাকে শেখায়নি যে সতীত্ব ব্যাপারটি নারীর দেহে নয়, নারীর মনে। ওর তো সেই শিক্ষা হয়নি যে বিনা বিবাহে সঙ্গম মন্দ কাজ না, বিনা প্রেমে সঙ্গম হচ্ছে মন্দ কাজ। এমনকি বিবাহিত নারীপুরুষ হলেও, সেখানে যদি প্রেম না থাকে শারীরিক মিলন একটি নষ্টামি।
আমরা মেয়েদেরকে ক্যান্ডি হিসেবেই বড় করেছি। আর মেয়েটি তখন ভাবতে থাকে যে একজন যেহেতু ওকে চেটে দিয়েছে সে তো এখন ঝুটা খাবারের মতো বাতিল হয়ে গেছে, ওর তো আর বেঁচে থাকার কোন অর্থ নাই।
এই যে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে সে তো তার অধিকার প্রয়োগ করার জন্যে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। সে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কারণ আমরা ওকে একটা স্টিগমা দিচ্ছি। আমরা ওকে নষ্টা বলবো, আমরা ওকে কলঙ্কিনী বলবো এই কারণে সে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটা তো ওর সিদ্ধান্ত না, এটা আমরা চাপিয়ে দিয়েছি ওর উপর। আমরা পুরুষরা, যারা মনে করি নারী কেবলই নারী, পুরুষের ভোগের পণ্য, একটি ঊন-মানুষ।
সেদিন ফারুক সাদিক আমাকে বলছিল, ‘তোমাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন’ এইরকম ভণ্ড কথাবার্তা কে বলেনা? সকলেই বলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। আজকের কবি শিকপিরা বলেন। ফারুক সাদিক এমনকি চেয়ারম্যান মাওএর কবিতা থেকেও দেখিয়েছে আমাকে যেখানে তিনি এইরকম ‘তোমাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন’ ধরনের কথা লিখেছেন। অথচ এইসব কবি, শিল্পী, রাজনীতিবিদ সকলেই নিজের ব্যক্তিগত জীবনে কেউ মনোগামি না। এইরকম ভণ্ডামি আমরা কেন করি? এটাই পুরুষবাদী প্রবণতা, পিতৃতান্ত্রিক প্রবণতা।
এই যে মেয়েগুলি আত্মহত্যা করছে, এগুলি আত্মহত্যা না। এর প্রত্যেকটিই একেকটি হত্যাকাণ্ড এবং এর জন্যে আমি আপনি আমরা যারাই শিক্ষা দিয়ে একটি মানব শিশুকে নারীতে রূপান্তর করি আমরা সকলেই দায়ী।