ফসলরক্ষা বাঁধে টানা ২৪ দিন স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ কারার পরও শেষ রক্ষা হলো না সুনামগঞ্জের খাদ্যভাণ্ডার খ্যাত শনির হাওরের। শনিবার মধ্য রাতে হাওরের লালুখালি বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যেতে শুরু করে কৃষকের ফসল। এতে হাওরে আবাদকৃত ৮৫৬০ জমির বোরো ফসলের বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে এবং গো খাদ্যের যোগান দিতে হাওরে পানি পরিপূর্ণ হওয়ার আগে কাঁচা ধান কাটতে শুরু করেছেন অনেকে কৃষক।
হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধানী হাওর হিসেবে পরিচিত শনির হাওর। এর আয়তন ১৩ হাজার হেক্টর হলেও এবার ধান চাষ হয়েছে ৮৫৬০ হেক্টর জমিতে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার প্রায় ১৬ হাজার কৃষক পরিবারের জীবন-জিবীকা চলে এই হাওরের উৎপন্ন ধান দিয়ে।
চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে ভারি বর্ষণ ও অকাল বন্যায় নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। হাওরে নিযুক্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার বেড়িবাঁধে কোনো কাজ না করার কারণে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে হাওরটি।
এই পরিস্থিতিতে হাওরটি রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের তরুণ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল। সাধারণ কৃষককে সংগঠিত করে হাওরের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ শুরু করেন স্বেচ্ছাশ্রমে। বন্যায় যখন জেলার বাঁধ ভেঙে একের পর এক হাওরের ফসল তলিয়ে যেতে যেতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৯০ ভাগে এসে দাঁড়ায় তখনও সুরক্ষিত ছিল শনির হাওর।
বৃষ্টিপাত ও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় শেষ পর্যন্ত কাটানো গেল না শনির হাওরের শনির দশা। শনিবার হাওরের বিভিন্ন বাঁধে ফাঁটল দেখা দেয়। অনেক স্থানে ছুঁইয়ে হাওরে প্রবেশ করেতে থাকে পানি। অবশেষ শনিবার মধ্যরাতে হাওরের দুটি স্থানে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যেতে শুরু করে হাওর। এই পরিস্থিতিতে হাওরটি সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ার আগে যে যেটুকু পারেন আধপাঁকা ধান কাটতে শুরু করেছন কৃষকেরা।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ‘সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে আমরা হাওরটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না।’ তার অভিযোগ, ‘এই হাওরের বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য একজন ঠিকাদার দায়িত্ব পান। কিন্তু কার্যাদেশ পাওয়ার পরও এই তিনি বাধে এক কোদাল মাটি ফেলেননি। যে কারণে মানুষকে আজ এই দুর্দশায় পড়তে হলো।’
হাওরপাড়ের মধ্য তাহিরপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক গোলাম সারোয়ার লিটন বলেন, ‘১৯৭৭, ১৯৯৩ ও ২০১০ সালে সারা জেলায় শতভাগ ফসলহানির ঘটনা ঘটলেও ঠিকে ছিল একমাত্র শনির হাওর। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডে সীমাহীন উদাসীনতার কারণে এই বছর এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হলো।’
রাজিনপুর গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘এত খষ্ট খরার পরও হাওররে বাঁচাইয়া রাখতাম ফারলাম না। গতবারও ফসল গেল। এইবারও গেল। আমরার সমনে বড় দুর্দিন আইতাছে।’
উজান তাহিরপুর গ্রামের কৃষক বাদল মিয়া বলেন, ‘বাপ দাদার আমল থাইক্কা শুইন্যা আইতাছি শনির হাওর আমরার ধানের ভাণ্ডার। এই ভাণ্ডার নষ্ট করল কন্টাকটারারে কাম দিয়া।’
তাহিরপুর উপজেলার উজ্জ্বলপুর গ্রামের গৃহস্থ তৌহিদ মিয়া জানান, ‘প্রায় ৩৩ একর জমি করছিলাম। ৩০ একরের মত পাশের হালির হাওরের ছিল। সেগুলো আগেই পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন শনির হাওরে তিন একরের মতো আছে। বাঁধ উপছে পানি হাওরে ঢুকার উপক্রম হওয়ার পরে কাঁচা ধান কাটতে শুরু করে দিয়েছি। এখান থেকে সামান্য যা ধান পাই না কেন গো খাদ্যের কিছুটা যোগান তো হবে।
হাওর তলিয়ে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষদের সরকার ব্যাপক সহয়াতা ও পুর্নবাসন করবে এবং বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসিনতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে প্রত্যাশা হাওর পারের মানুষের।
প্রসঙ্গত, সুনামগঞ্জে চলতি বোরো মৌসুমে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল। আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে শনির হাওর ছাড়াই সরকারি হিসাবে তলিয়ে গেছে ৮২ ভাগ জমির ফসল। কৃষকদের দাবি, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৯০ ভাগেরও বেশি।