ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্ব পরিবেশ দিবস: বাবা-বৃক্ষের গল্প

বাবা একটা বাড়ি বানালেন। সুনামগঞ্জে। হাওরের পারে। টিনের বাড়ি। সারাক্ষণ বাতাস খেলা করে। উড়ে যায় হরেক রকম পাখি। চারদিকে পানি থৈ থৈ। মাছেরা উৎসবে মাতে। জ্যোৎস্না ঝিলিক দেয় মায়াবী জলে। আর পাড়ার তরুণেরা, জলে পা ডুবিয়ে, গান গায়। রাত ভর করে পরীর ডানায় । বাড়ির বারান্দায় বসে, বাবা হাওয়া খেতেন। প্রচণ্ড শক্তিশালী হাওয়া আমাদের দরজার কপাট ভেঙ্গে দিত। আমার বাবা রাগ করতেন না। মোলায়েম হেসে বলতেন,আহারে বাতাস। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিদ্যুতের পাখা লাগেনা। অদ্ভুত সুন্দর, বিস্তৃত হাওরে চোখ রেখে নিজেই হয়ে যেতেন আকাশের পাখি। পান করতেন নিসর্গের মৌনতা,উত্তাল আকাশ আর বিস্তৃত মেঘমালা।
একদিন বাবা একটা আতা ফলের গাছ রোপণ করলেন, বাড়ির সামনে। গাছটি দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকল। ফল ধরল গাছে, কী মিষ্টি তার ফল। বাবা বারান্দায় বসে ফল খেতেন। গাছটি ক্রমশ তার ডালপালা বিস্তার করতে থাকল। করতে করতে এমন এক অবস্থায় উপনীত হলো যে, বাড়িতে ঢুকার পথ রুদ্ধ প্রায়। আমার মা বললেন- গাছটাকে কেটে ফেলা হোক। বাবা বেঁকে বসলেন। তিনি গাছ কাটবেন না। গাছের প্রতি তার অপরিসীম প্রেম। গাছ সন্তানতুল্য। মা বললেন- তাহলে ডালপালা ছাঁটাই করা হোক। বাবা সম্মত নন। তাহলে !
মা ও বড় ভাই মিলে যুক্তি করলেন। বাবা যখন বাসায় ছিলেন না- মা কাজের লোক ডাকলেন। দ্রুত গাছটিকে কেটে ফেলা হলো। দ্রুত সরিয়ে নেয়া হলো সব। ডালপালা, পাতা। গাছটির জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল নিঃসঙ্গ শূন্যতা । বাড়ির উঠোন ফাঁকা । পাখি বসে না, রোদও না।
বাবা ফিরলেন। বাড়িতে ঢুকতে যাবেন, অমনি থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন গেটের সামনে। সবকিছু ফাঁকা কেন ! বাড়ি বৃক্ষহীন কেন ! পাতারা মর্মরিত নয় কেন ! সবুজে ঢাকা নয় কেন সব ! ভালো করে সবকিছু পরখ করলেন। দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দিলেন হাওয়ায়। তারপর আস্তে আস্তে বাড়িতে ঢুকলেন। আমার মা ও ভাই- সবকিছু স্বাভাবিক আছে, এরকম একটা অভিনয় শুরু করলেন। বাবা নিশ্চুপ। বাজারের ব্যাগটা রাখলেন রান্নাঘরে। তারপর গিয়ে দাঁড়ালেন মায়ের সামনে। দুঃখ ভরাক্রান্ত মন নিয়ে বললেন-গাছটিকে কে কাটলো ?
মা বললেন- আমি। বাবা কিছু বললেন না। ঘুরে দাঁড়ালেন। চাপকলে গিয়ে হাতমুখ ধুলেন। ভাত খেলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন বাইরে। মা ভাবলেন, বাবা মসজিদে যাচ্ছেন । একটু পর-ই ফিরবেন। না, তিনি ফিরলেন না। রাত হয়ে এলো। বাবা ফিরছেন না। বাবা কোথায় গেলেন ? মা ভাবলেন- হয়ত কোন আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছেন। শহরের সব বাড়িতে খোঁজা হলো। বাবা নেই। যে বাবা তার সন্তানদের ছেড়ে কখনো থাকেন না, সন্তানদের ছেড়ে থাকতে হবে বলে, কোন বদলি-পদোন্নতি নেননি, তিনি আজ আমাদের ছেড়ে ! সারা বাড়ি জুড়ে উৎকণ্ঠা বিরাজ করল। আমার মা সারারাত পায়চারি করলেন। ঘুমালেন না। পরদিন কাজের লোককে পাঠালেন নানার বাড়িতে। না, বাবা সেখানেও নেই। কোথায় গেলেন তিনি ! মোবাইলের যুগ ছিল না সেটা । লোক পাঠিয়ে সব জায়গায় খোঁজা হলো। দুদিন পর পাওয়া গেল বাবাকে। ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি।তিনি ফিরবেন না। তার বৃক্ষ ফেরত দিতে হবে। প্রিয় আতা ফল গাছ। বাড়ি সবুজে সবুজে ভরে উঠবে। বাবা বারান্দায় বসে ফল খাবেন। হাওয়া লাগাবেন শরীরে।
আমার মা ও ভাই বাবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। প্রতিস্রুতিবদ্ধ হলেন- আর গাছ কাটবেন না। বাবা বাড়ি ফিরলেন। বাবা উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতেন সেই শূন্য জায়গায়। যেখানে আতাফলের গাছ ছিল। দীর্ঘশ্বাস ছড়াতেন । আর পায়চারি করতেন বারান্দায়। কী যেন খুঁজতেন, কী যেন নেই। বৃক্ষসন্তান।
বাবা এখন না ফেরার দেশে। বাবার গাছেরা এখনও উকি দেয়। বারান্দায় বসে বাবার গাছ দেখি। বাবাকে দেখি না।
গাছেরাও বাবাকে খুঁজে। আমি খুঁজি। খুঁজে উত্তাল বাতাস, খোলা আকাশ, হাওর,মাছ আর জলের মৌনতা। বাবা নেই। বারান্দায় বসে আমরা এখনও বিস্তৃত জলরাশি দেখি, আকাশ, পাখি। কেউ জানেনা বাবার খবর। বাবা কী সবুজের সাথে মিতালি করে এখনও উত্তাল হাওর দেখেন ? নৌকা, পাখি আর পাখিদের কানাকানি ? বারান্দায় বসে ফল খান? আর হাওয়ার পরশ নিতে নিতে বৃক্ষের সাথে কথা বলেন ? আমরা এসবের কিছুই জানিনা। শুধু এইটুকু জানি- পৃথিবীর সব বাবা-রাই যাতে ভাল থাকেন, ইহকাল ও পরকালে। ভালবাসা হয়ে, গাছ হয়ে, গাছের মায়া, পাতার মর্মর । বাবা বেঁচে আছেন বৃক্ষে। ফল হয়ে ঝুলে আছেন । আতাফল। বাবাকে দেখি আর গাছ লাগাই। আশা- আমিও ঝুলে থাকবো বাবার মত- ফল হয়ে, পাতা হয়ে, প্রেম হয়ে,বিস্তৃত সবুজে, খোলা হাওয়ায়। গাছ বাঁচলে আমি বাঁচি, আমি বাঁচলে গাছ। গাছের নাম বাবা, বাবার নাম গাছ।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

বিশ্ব পরিবেশ দিবস: বাবা-বৃক্ষের গল্প

আপডেট টাইম : ০৩:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ জুন ২০১৬

বাবা একটা বাড়ি বানালেন। সুনামগঞ্জে। হাওরের পারে। টিনের বাড়ি। সারাক্ষণ বাতাস খেলা করে। উড়ে যায় হরেক রকম পাখি। চারদিকে পানি থৈ থৈ। মাছেরা উৎসবে মাতে। জ্যোৎস্না ঝিলিক দেয় মায়াবী জলে। আর পাড়ার তরুণেরা, জলে পা ডুবিয়ে, গান গায়। রাত ভর করে পরীর ডানায় । বাড়ির বারান্দায় বসে, বাবা হাওয়া খেতেন। প্রচণ্ড শক্তিশালী হাওয়া আমাদের দরজার কপাট ভেঙ্গে দিত। আমার বাবা রাগ করতেন না। মোলায়েম হেসে বলতেন,আহারে বাতাস। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিদ্যুতের পাখা লাগেনা। অদ্ভুত সুন্দর, বিস্তৃত হাওরে চোখ রেখে নিজেই হয়ে যেতেন আকাশের পাখি। পান করতেন নিসর্গের মৌনতা,উত্তাল আকাশ আর বিস্তৃত মেঘমালা।
একদিন বাবা একটা আতা ফলের গাছ রোপণ করলেন, বাড়ির সামনে। গাছটি দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকল। ফল ধরল গাছে, কী মিষ্টি তার ফল। বাবা বারান্দায় বসে ফল খেতেন। গাছটি ক্রমশ তার ডালপালা বিস্তার করতে থাকল। করতে করতে এমন এক অবস্থায় উপনীত হলো যে, বাড়িতে ঢুকার পথ রুদ্ধ প্রায়। আমার মা বললেন- গাছটাকে কেটে ফেলা হোক। বাবা বেঁকে বসলেন। তিনি গাছ কাটবেন না। গাছের প্রতি তার অপরিসীম প্রেম। গাছ সন্তানতুল্য। মা বললেন- তাহলে ডালপালা ছাঁটাই করা হোক। বাবা সম্মত নন। তাহলে !
মা ও বড় ভাই মিলে যুক্তি করলেন। বাবা যখন বাসায় ছিলেন না- মা কাজের লোক ডাকলেন। দ্রুত গাছটিকে কেটে ফেলা হলো। দ্রুত সরিয়ে নেয়া হলো সব। ডালপালা, পাতা। গাছটির জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল নিঃসঙ্গ শূন্যতা । বাড়ির উঠোন ফাঁকা । পাখি বসে না, রোদও না।
বাবা ফিরলেন। বাড়িতে ঢুকতে যাবেন, অমনি থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন গেটের সামনে। সবকিছু ফাঁকা কেন ! বাড়ি বৃক্ষহীন কেন ! পাতারা মর্মরিত নয় কেন ! সবুজে ঢাকা নয় কেন সব ! ভালো করে সবকিছু পরখ করলেন। দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দিলেন হাওয়ায়। তারপর আস্তে আস্তে বাড়িতে ঢুকলেন। আমার মা ও ভাই- সবকিছু স্বাভাবিক আছে, এরকম একটা অভিনয় শুরু করলেন। বাবা নিশ্চুপ। বাজারের ব্যাগটা রাখলেন রান্নাঘরে। তারপর গিয়ে দাঁড়ালেন মায়ের সামনে। দুঃখ ভরাক্রান্ত মন নিয়ে বললেন-গাছটিকে কে কাটলো ?
মা বললেন- আমি। বাবা কিছু বললেন না। ঘুরে দাঁড়ালেন। চাপকলে গিয়ে হাতমুখ ধুলেন। ভাত খেলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন বাইরে। মা ভাবলেন, বাবা মসজিদে যাচ্ছেন । একটু পর-ই ফিরবেন। না, তিনি ফিরলেন না। রাত হয়ে এলো। বাবা ফিরছেন না। বাবা কোথায় গেলেন ? মা ভাবলেন- হয়ত কোন আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছেন। শহরের সব বাড়িতে খোঁজা হলো। বাবা নেই। যে বাবা তার সন্তানদের ছেড়ে কখনো থাকেন না, সন্তানদের ছেড়ে থাকতে হবে বলে, কোন বদলি-পদোন্নতি নেননি, তিনি আজ আমাদের ছেড়ে ! সারা বাড়ি জুড়ে উৎকণ্ঠা বিরাজ করল। আমার মা সারারাত পায়চারি করলেন। ঘুমালেন না। পরদিন কাজের লোককে পাঠালেন নানার বাড়িতে। না, বাবা সেখানেও নেই। কোথায় গেলেন তিনি ! মোবাইলের যুগ ছিল না সেটা । লোক পাঠিয়ে সব জায়গায় খোঁজা হলো। দুদিন পর পাওয়া গেল বাবাকে। ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি।তিনি ফিরবেন না। তার বৃক্ষ ফেরত দিতে হবে। প্রিয় আতা ফল গাছ। বাড়ি সবুজে সবুজে ভরে উঠবে। বাবা বারান্দায় বসে ফল খাবেন। হাওয়া লাগাবেন শরীরে।
আমার মা ও ভাই বাবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। প্রতিস্রুতিবদ্ধ হলেন- আর গাছ কাটবেন না। বাবা বাড়ি ফিরলেন। বাবা উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতেন সেই শূন্য জায়গায়। যেখানে আতাফলের গাছ ছিল। দীর্ঘশ্বাস ছড়াতেন । আর পায়চারি করতেন বারান্দায়। কী যেন খুঁজতেন, কী যেন নেই। বৃক্ষসন্তান।
বাবা এখন না ফেরার দেশে। বাবার গাছেরা এখনও উকি দেয়। বারান্দায় বসে বাবার গাছ দেখি। বাবাকে দেখি না।
গাছেরাও বাবাকে খুঁজে। আমি খুঁজি। খুঁজে উত্তাল বাতাস, খোলা আকাশ, হাওর,মাছ আর জলের মৌনতা। বাবা নেই। বারান্দায় বসে আমরা এখনও বিস্তৃত জলরাশি দেখি, আকাশ, পাখি। কেউ জানেনা বাবার খবর। বাবা কী সবুজের সাথে মিতালি করে এখনও উত্তাল হাওর দেখেন ? নৌকা, পাখি আর পাখিদের কানাকানি ? বারান্দায় বসে ফল খান? আর হাওয়ার পরশ নিতে নিতে বৃক্ষের সাথে কথা বলেন ? আমরা এসবের কিছুই জানিনা। শুধু এইটুকু জানি- পৃথিবীর সব বাবা-রাই যাতে ভাল থাকেন, ইহকাল ও পরকালে। ভালবাসা হয়ে, গাছ হয়ে, গাছের মায়া, পাতার মর্মর । বাবা বেঁচে আছেন বৃক্ষে। ফল হয়ে ঝুলে আছেন । আতাফল। বাবাকে দেখি আর গাছ লাগাই। আশা- আমিও ঝুলে থাকবো বাবার মত- ফল হয়ে, পাতা হয়ে, প্রেম হয়ে,বিস্তৃত সবুজে, খোলা হাওয়ায়। গাছ বাঁচলে আমি বাঁচি, আমি বাঁচলে গাছ। গাছের নাম বাবা, বাবার নাম গাছ।