বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রাজধানীজুড়ে রিকশার বহর। রিকশার সংখ্যা কত? এর সংখ্যা বলা কঠিন। তবে এই রিকশাকে ঘিরে রাজধানীর লাখো পরিবারের স্বপ্ন। রিকশার প্যাডেলের ওপর তাদের আয়। আর এ আয় দিয়ে চলে তাদের সংসার। খাওয়া, পড়ালেখা, চিকিৎসা সবই একটি রিকশাকে ঘিরে। প্রশ্ন জাগে, রাজধানী ঢাকায় রিকশাচালকের আয় কত? এ নিয়ে কথা হয় রিকশাচালকদের সঙ্গে। তাদের মুখেই ফুটে উঠেছে চিত্র।
রিকশাচালক ইয়াকুব হোসেন। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলায়। থাকেন আদাবরের গ্যারেজে। ঘড়িতে তখন রাত ১২টা। খাওয়া শেষে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঘুমানোর। গ্যারেজেই তাদের শোবার জায়গা। একটি স্যাঁতসেঁতে রুমে গাদাগাদি করে বিছানা করেছেন ৩৫ জন মানুষ। এতগুলো মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র ২টা ফ্যান। লালমনিরহাট জেলার মমিনুল ইসলাম বলেন, ভাবতোচেন গরমত ঘুমাই ক্যামনে? সারা দিন যে পরিশ্রম হয় ফ্যান না তাকলেও ঘুম আইস্যে। আজিজুল ইসলাম, রোকন, কবিরুল ইসলাম জানান, ছারপোকা, তেলাপোকা, ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ তারা। মশার জন্য মশারি থাকলেও ছারপোকা দমনে কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয় না।
ইয়াকুব হোসেন সকাল ৬টায় ঘুম থেকে ওঠেন। খাওয়া শেষে ৭টার দিকে বের হন রিকশা নিয়ে। উদ্দেশ্য অফিস, স্কুল, কলেজগামী যাত্রী নেয়া। দুপুর ২টা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে ফেরেন গ্যারেজে। গোসল খাওয়া শেষে আবার ৪টার দিকে বের হন রিকশা নিয়ে। ফেরেন রাত ১০টা ১১টার দিকে। আবারো গোসল শেষে খাওয়া দাওয়া, ঘুম। এভাবেই চলে ইয়াকুব আলীর জীবন। তিনি জানান, গ্রামে তার মা, বৌ ও দুই সন্তান আছে। মেয়ে রিক্তা পড়ে ক্লাস এইটে, ছোট ছেলে রবিন মাদরাসায়।
সারা দিনে আয় হয় ৮শ’ থেকে হাজার টাকা। কোনো দিন বেশি- আবার ছুটির দিনে কম হয়। গ্যারেজে রিকশা ভাড়া দেয়া লাগে ১২০ টাকা। দিনে তিনবার খাওয়ার জন্য দিতে হয় ১২০ টাকা। অন্যান্য খরচ দিনে লাগে ১০০ টাকার মতো। দিন শেষে হাতে থাকে ৪ থেকে ৫শ’ টাকা। ঢাকায় তিনি রিকশা চালান মাস খানেকের মতো। তারপর আবার চলে যান গ্রামে। সেখানে করেন বর্গা চাষ। তিনি বলেন, এ্যামনে সংসার চলতোচে টানিটুনি। বয়স হওচে, জানো না কতদিন রিশকা চালবার পাইম। গ্রামোত একখ্যান দোকান দিবার ইচ্ছা আচে।
ইলিয়াস মোল্লার বাড়ি গাইবান্ধা জেলার ঢোলভাঙ্গায়। বয়স আনুমানিক ৫০। নদীভাঙনে বাড়ি জমিজমা হারিয়েছেন। নিরুপায় পরিবারটি এখন থাকেন মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে। শরীর ছেড়ে দেয়ায় অন্য রিকশা চালকের তুলনায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কম আয় হয় তার। স্ত্রী কাজ করেন মানুষের বাসায়, চার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে চলছে তাদের পরিবার।
রিকশার শহর ঢাকা। এই তিন চাকার বাহন ২০১৫ সালে স্থান করে নিয়েছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। রাজধানীর ৪০ শতাংশ মানুষ চলাচল করে রিক্সায়। ১৮৬০ সালে মার্কিন নাগরিক জোনাথন স্কোবি জাপানে পালকির বিকল্প হিসেবে রিকশার প্রবর্তন করেন। জাপানি জিনরিকিশা থেকে এসেছে রিকশার নাম। জিন শব্দের অর্থ মানুষ, রিকি অর্থ শক্তি এবং শা অর্থ বাহন। ১৯০০ সালে মালপত্র পরিবহনের জন্য রিকশার প্রচলন ভারত উপমহাদেশে শুরু হলেও ১৯১৪ সালে প্রথম কলকাতায় যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে চট্টগ্রামে প্রথম রিকশা আসে। ঢাকায় রিকশা আসে নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের পাট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে। শুরুতে রিকশা ছিল মাত্র ৩৭টি। এই শহরে বর্তমানে রিকশা চলে ৬ থেকে ৭ লাখ।
রিকশাচালক মিজানুর রহমান বলেন, আমরাতো মানুষ না, যে পারে সে আমাদের গায়ে হাত তোলে। কালকে একজন মোটরসাইকেলওয়ালার রিকশার সামনে হঠাৎ ব্রেক ধরে। কোনো কথা বলার আগেই চড় মেরে বসে। ওই সময় আমার কানে তালি লেগে যায়। মাথাঘুরে রাস্তার পাশে বসেছিলাম আধা ঘণ্টা।
রিকশাচালক ওমর বলেন, একদিন শিয়া মসজিদ পর্যন্ত রিকশা ঠিক করে ছিলেন একজন। কিন্তু সে যায় মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটিতে। অতিরিক্ত ভাড়া চাইলে গালাগালির সঙ্গে গায়ে হাত তুলে। একটা ঘুষি এসে লাগে ঠোটে। এত রক্ত বের হয়েছিল। বলতে বলতে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন তিনি।
বৃষ্টি হলে ভাড়া বেশি, গরম হলে ভাড়া বেশি, ঈদে ভাড়া বেশি- এসব হচ্ছে রিকশাচালকদের প্রতিদিনের ঘটনা। এমন করে চলাচল করা যায় নাকি? তাদের বাড়তি ভাড়া দেব কোথা থেকে? বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোমানা রতি খান। শুধু দিনেই নয় রাতেও ঢাকার সড়কে চলে প্রচুর রিকশা। এসব রিকশা বের হয় রাত ১১টার দিকে আর চালানো শেষ করে সকাল ৭টার দিকে। গ্যারেজ ভাড়া দিতে হয় ১০০ টাকা। রিকশাচালক মিষ্টি বলেন, আমার চোখে সমস্যা, দিনের আলোতে সমস্যা হয় তাই রাতে রিকশা চালাই। রাতে চালানোর পরিশ্রম কম। যানজট থাকে না আরামে চালানো যায়। আবার দিনে যেখানে ভাড়া পাওয়া যায় ২০ টাকা রাতের ভাড়া ৩০ টাকা।
এসব রিকশা চালকরা কঠোর পরিশ্রম করে আয় করেন আবার চাইলেও করতে পারেন না সব সময় কাজ। পায়ের পেশিতে টান পড়ে তাদের। আবার রোদে পুড়তে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। তাই বিভিন্ন স্থান থেকে আসা এসব রিক্সাচালক অধিকাংশই ৪০-৫০ দিন কাজ করে চলে যান বাড়িতে। নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার রিকশাচালক মালেক মিয়া বলেন, একবার আসি দুই মাসের মত থাকি। ১৮ হাজার ২০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি যাই। বাড়িতে ক্ষেত আছে চাষ করি। ঢাকায় রিকশা চালাতে আসি বছরে ৩ থেকে ৪ বার।
৭০ট একা ভাড়া ঠিক করে ধানমন্ডি ২৭ থেকে রিং রোডে নিয়ে আসি। যাত্রী বলেন, একটু দাঁড়াও আমি ৫ মিনিটে আসতেছি। তোমার রিকশায় শ্যামলী যাব। এক ঘণ্টার উপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, বাড়ির দারোয়ান বাড়িতেও ঢুকতে দেয় নাই। জানান, রিক্সা চালক মোখলেসুর রহমান। তিনি জানান, একবার রাত ৯টার দিকে অস্ত্র ঠেকিয়ে যাত্রীর মোবাইল, টাকা পয়সা নিয়ে যায়। আমার সারা দিনের কামাই ৭৮০ টাকাও নিয়ে যায়। পা ধরে বলেছিলাম, ২০০ টাকা দেন, গ্যারেজ ভাড়া দিব তাও দেয় নাই তারা।
শিক্ষার্থী অনামিকা প্রধান বলেন, একবার টাকা না নিয়ে বেরিয়েছিলাম হোস্টেল থেকে। পরীক্ষার তাড়া ছিল তাই আবার ফেরত আসতেও পারছিলাম না। রিকশাওয়ালা চাচাকে বললে বলেন, কোনো সমস্যা নাই মা। আবার কাল এই সময় আপনার হোস্টেলের সামনে দাঁড়াবো তখন একবারে দিয়েন। আমাকে অবাক করে যাবার সময় হাতে ১০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেন, দুপুর হয়ে গেছে পরীক্ষা শেষে কিছু খাইয়েন আর বাকী টাকা দিয়ে যাওয়ার রিকশা ভাড়া দিয়েন। কিন্তু আর দেখা পাই নাই তার। প্রতিদিন তাকে খুঁজি।
আবার রিকশাচালক নিয়েই তার আছে ভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প। তিনি বলেন, বাজার করে রিকশায় ফিরে ব্যাগ নামাচ্ছিলাম। দুটা ব্যাগ ভেতরে নিতেই আরেকটি ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায় রিকশাচালক।