নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনার ঘটনায় করা মামলার আসামি স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ফিরে গেলেন। রবিবার ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে বিচারক জেসমিন আরা শুনানির জন্য ২৩ মে দিন ধার্য করেছেন।
রবিবার মামলার ধার্য তারিখে সকালে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন সেলিম ওসমান। ব্যক্তিগত হাজিরা মওকুফ করে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দেওয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। আরেক আসামি অপুর পক্ষে আদালতে কোনো আবেদন ছিল না।
সাংসদ সেলিমের আইনজীবী এসএন সিদ্দিকুর রহমান শুনানিতে বলেন, গত ৮ মে হাইকোর্ট থেকে ২ সপ্তাহের জামিন পেয়েছেন। ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আত্মসমর্পণ করেছেন। তাকে জামিন দেওয়া হোক।
রাষ্ট্রপক্ষে আদালতের অতিরিক্ত পিপি আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। আগামী ২২ মে মেয়াদ শেষ হবে। ওই অনুযায়ী বিচারক পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন।
তিনি জানান, মামলার আরেক আসামি অপুর পক্ষে কোনো আবেদন না থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ মার্চ একই আদালত সেলিম ওসমান ও অপুকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি করে গতকাল দিন ধার্য করেছিলেন।
এর আগে গত ২২ জানুয়ারি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন। মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার সিজেএম আদালতে বদলির নির্দেশ দেন।
ওই আদেশে বলা হয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে দেশের আইন নিরপেক্ষ ও বৈষম্য ছাড়া প্রয়োগ করা। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, সবাই আইনের অধীন এটি আইনের শাসনের মর্মবাণী। বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা ওই ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছি। বিচারের স্বার্থে এটি যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয়। মোট ৬৫ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে আরও নথিপত্র সংযুক্ত রয়েছে।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে হলফনামা আকারে ঢাকার সিএমএম শেখ হাফিজুর রহমান গত ১৯ জানুয়ারি ওই প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্তকালে মোট ২৭ জনের জবানবন্দি নেওয়া হয়। তদন্ত করে প্রতিবেদন আকারে ছয়টি সিদ্ধান্ত দেন। এগুলো হলো-
প্রথমত- শ্যামল কান্তি ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ রিফাত হাসানকে ২০১৬ সালের ৮ মে মারধর করেছেন তা প্রমাণিত।
দ্বিতীয়ত- ইসলাম ধর্ম ও আল্লাহকে নিয়ে শ্যামল কান্তির করা কটূক্তির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
তৃতীয়ত- গত বছরের ১৩ মে ওই স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভা চলাকালে স্থানীয় জনৈক শামসুল হকের ছেলে অপুর নেতৃত্বে ১০/১২ জন সভাকক্ষে ঢুকে প্রধান শিক্ষককে মারধর করার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে, অপু ছাড়া বাকি ১০/১২ জনের নাম কোনো সাক্ষীই প্রকাশ করেননি।
চতুর্থত- ২০১৬ সালের ১৩ মে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভা চলাকালে আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় মসজিদ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় যে ইসলাম ধর্ম আল্লাহকে নিয়ে কটুক্তি করেছেন শ্যামল কান্তি। কে বা কারা ওই ঘোষণা দিয়েছেন, তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিরোধের কারণে এমন ঘোষণা দেওয়া হতে পারে বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে।
পঞ্চমত- গত বছরের ১৩ মে বিকাল ৫টার দিকে সাংসদ সেলিম ওসমান প্রধান শিক্ষকের রুমে ঢুকে তাঁকে গাল-কান জুড়ে দুই হাত দিয়ে পরপর চারটি থাপ্পড় দিয়েছেন। এমন দাবির সত্যতাও পাওয়া যায়নি।
ষষ্ঠত- সাংসদ সেলিম ওসমানের নির্দেশে শ্যামল কান্তি ভক্ত কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য হয়েছেন তা ভিডিও ফুটেজ থেকে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে উপস্থিত স্থানীয় জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদ ওই নির্দেশ দেন।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের স্কুল শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় পুলিশ প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে মন্তব্য করে গত বছরের ১০ আগস্ট হাইকোর্ট প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন।
প্রসঙ্গত, স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ইসলামের বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছেন অভিযোগ তুলে গত বছরের ১৩ মে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এলাকাবাসীকে স্কুলের মাঠে জড়ো হতে অনুরোধ জানানো হয়। স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে ওইদিন উপস্থিত জনতার সামনে ওই শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি পরে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে প্রকাশিত হওয়ার পর হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘটনায় সেলিম ওসমান জড়িত কি না তা উদঘাটনের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম)।
বিচার বিভাগীয় তদন্তে মর্মে আসামিদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩২৩/৩৫৫/৫০০ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। হাইকোর্ট ওই প্রতিবেদন গ্রহণ করে তদন্তে উঠে আসা অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা বিচারের জন্য ঢাকার সিজেএম আদালতে পাঠিয়ে দেন।