বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দেশে যে কোনো ধরনের অপরাধের তুলনায় মাদকের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংশ্নিষ্টতা পাওয়া যায় নারীর। মোট মাদক কারবারির ২০ থেকে ৩০ শতাংশই নারী। তবে তাদের মধ্যে মাদক বাহকের সংখ্যাই বেশি। বাকিরা মাদকের নারী গডফাদার। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ইয়াবা কারবারে জড়িত ৩৯ জন নারী। তারা প্রত্যেকে ১৫ থেকে ২০ নারী-পুরুষ বাহকের মাধ্যমে ইয়াবার চালান পাঠিয়ে আসছিল বিভিন্ন জায়গায়। রাজধানীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এসব চক্র। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় উঠে এসেছে রাজধানীকেন্দ্রিক এ রকম ২৫ নারী মাদক ব্যবসায়ীর নাম। তাদের মধ্যে ২২ জন পলাতক। বাকি তিনজন কারাগারে রয়েছে।
পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা জানান, একসময় ইয়াবার সঙ্গে নিকিতার নাম শোনা যেত। এখন আর আলোচনায় নেই সে। তবে অনেক নারী অল্প সময়ে অনেক টাকা আয়ের সুযোগ হিসেবে শুরু করেছে ইয়াবা ব্যবসা। যারা এরই মধ্যে দখল করেছে নিকিতার জায়গা। ঢাকা মহানগর পুলিশের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, মাদকবিরোধী অভিযানে নারী মাদক ব্যবসায়ীদেরও আইনের আওতায় নেওয়া হবে। তালিকা ছাড়াও যেসব নারী মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের ব্যাপারে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, অপরাধ কে করেছে, সেটা মুখ্য। এখানে কারও অন্য কোনো পরিচয় দেখার সুযোগ নেই। নারী মাদক ব্যবসায়ীদেরও কঠোর আইনের আওতায় আনা হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের অন্তত ৩০ শতাংশই নারী। অনেকে আবার নারীকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছে। পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগের এডিসি মাহমুদা আফরোজ লাকী বলেন, অল্প টাকার বিনিময়ে অনেকে মাদকের সঙ্গে নারীকে সম্পৃক্ত করছে। ইয়াবা আকারে ছোট। নারীকে দিয়ে বহন করালে ধরা পড়ার ভয় থাকে কম। আবার কোনো কোনো নারী নেপথ্যে থেকে নারীকে ব্যবহার করেই এ ব্যবসা চালাচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, গত তিন মাসে কক্সবাজার থেকে মাদক ঢাকায় আনতে গিয়ে তাদের হাতে অন্তত সাত নারী বাহক ধরা পড়েছে। তারা ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে মাদক বহন করছিল। কখনও এসব নারীর সঙ্গে ছোট্ট শিশুও আনা হয়, যাতে কেউ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তাদের সন্দেহ না করে। উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছে এমন তথ্য রয়েছে- এক নারী মাদক ব্যবসায়ী অন্তত ৬০টি মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। একেকটি নম্বর সে একেক দিন ব্যবহার করে। বারবার স্থান ত্যাগ করে গা-ঢাকা দিচ্ছে। অনেকে আবার স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ব্যবসা করে যাচ্ছে।
কোনো নারী গডফাদার আবার প্রতি মাসে টাকার বিনিময়ে নারীকে ব্যবহার করে ইয়াবার কারবার করছে। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ইয়াবা বহনকারী নারীর পরিবারের মাসিক ব্যয়ভার বহন করছে ওই সব নারী গডফাদার। এমনকি মামলার খরচও বহন করে তারা। অনেক সময় রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে অভিযানে গেলে নারী ইয়াবা বাহকরা ‘অশ্নীলতা’ প্রদর্শন করে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গ্রেফতার এড়াতে। হাইওয়েসহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় পুলিশ চেকপোস্টে পুরুষ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সন্দেহভাজন নারীদের তাই সব সময় চেক করা সম্ভব হয় না। তাই নারী মাদক পাচারকারীরা এ সুযোগও নিয়ে থাকে।
মাদক চক্রের নারী সদস্য :খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে সবুজবাগের সুফিয়া আক্তার শোভা (৫০)। স্বামীর নাম আইয়ুব আলী। মাদক ব্যবসায় তার রাজত্ব সবুজবাগের ওহাব কলোনি ঘিরে। তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১০টি মামলা রয়েছে। নারী মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে শামসুন্নাহার চম্পা। স্বামীর নাম মো. বাবুল ওরফে ফর্মা বাবুল। সবুজবাগ ঘিরে চম্পাও দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবার চালিয়ে আসছে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৬টি। ধনাঢ্য নারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে গেণ্ডারিয়ার রহিমা। রহিমা বেগমের জন্ম গেণ্ডারিয়ার ছোবাপট্টি বস্তিতে। মাদক ব্যবসা করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০টি বাড়ির মালিক হয়েছে সে। তার রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। ব্যাংকেও নামে-বেনামে অনেক অর্থ রয়েছে তার। রহিমার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা রয়েছে ছয়টি।
সায়েদাবাদ ওয়াসা কলোনিতে মাদক ব্যবসার নারী গডফাদার হলো সুফিয়া আক্তার সুফি (৪৫)। স্বামীর নাম আক্তার হোসেন। সুফির গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর সদরের খাকুরীতে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ছয়টি। সুফিয়া বর্তমানে কারাগারে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন বস্তি এলাকায় মাদকের ব্যবসা করে জমিলা খাতুন। গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে সাতটি। সবুজবাগ এলাকার মাদকের আরেক নারী গডফাদার হলো তানিয়া বেগম। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে সাতটি। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের নারী গডফাদার হলো ফারহানা আক্তার পাপিয়া। স্বামীর নাম জয়নাল আবেদীন পাচু। স্বামীর সঙ্গে মিলেমিশে দীর্ঘদিন ধরে জেনেভা ক্যাম্পে রমরমা ব্যবসা করছে সে। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে চারটি। ভাসানটেক বস্তিতে মাদকের ব্যবসা করছে মোর্শেদা। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৩টি। রূপনগরের দুয়ারীপাড়ায় মাদকের ব্যবসা করছে সালেহা বেগম। তার বিরুদ্ধে রূপনগর থানায় মামলা রয়েছে ২২টি। কামরাঙ্গীরচরে মাদকের নারী গডফাদার শাহিনুর রহমান। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৫টি। কারওয়ান বাজার বস্তিতে মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে শিল্পী।
তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে সাতটি। সে বর্তমানে কারাবন্দি। কারওয়ান বাজারের আরেক নারী মাদক ব্যবসায়ী আকলিমা আক্তার। কাফরুলে মাদকের নারী গডফাদার জ্যোৎস্না বেগম। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দির চন্দ্র সাগরদী গ্রামে। তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা রয়েছে। ভাসানটেকের ধামালকোট এলাকায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছে স্বপ্না। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে আটটি। স্বপ্না বর্তমানে জেলে আছে। কলাবাগান এলাকায় মাদকের গডফাদার শাহানাজ। তার বিরুদ্ধে মামলা সাতটি। ঢাকার আরেক আলোচিত নারী মাদক ব্যবসায়ী খুরশিদা বেগম ওরফে খুশি। স্বামীর নাম মিজান ওরফে গোল্ডেন মিজান।
মিরপুরের কালাপানি, পল্লবী, নিউমার্কেট ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় মাদক ব্যবসা করে সে। নিউমার্কেট এলাকার আরেক মাদক ব্যবসায়ী হাসি বেগম। হাজারীবাগের চিহ্নিত নারী মাদক গডফাদার হলো বীণা। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরায়। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১২টি। একই এলাকার আরেক নারী মাদক কারবারি হলো নূর নাহার নুন্নী। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে ১০টি। এ ছাড়া হাজারীবাগে মাদক ব্যবসা করছে জমিলা ওরফে জামেলা বেগম। তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। রাজধানীর কোতোয়ালি এলাকায় মাদক ব্যবসা করছে পারুলী রানী। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে পাঁচটি।
খিলক্ষেত এলাকায় মাদক ব্যবসা করছে নাজমা বেগম। তার বিরুদ্ধে মামলা ১৯টি। এ ছাড়া রাজধানীতে মাদকের নারী গডফাদার হলো ফারজানা ইসলাম স্বপ্না। উত্তর ধানমণ্ডিতে তার নিজের দামি ফ্ল্যাট রয়েছে। হাতিরপুলে টাইলসের ব্যবসার আড়ালে স্বপ্না দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবার কারবার করে আসছে। আরও যারা নারী মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে- ঢাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াকের স্ত্রী পাখি বেগম, আসমা আহমেদ ডালিয়া, আনোয়ারা বেগম আনু, নার্গিস, পারভীন আক্তার, ইতি বেগম, মরিয়ম ওরফে কুট্টি, মিনা বেগম ও মাহমুদা খাতুন। এ ছাড়া কক্সবাজারের বাসিন্দা আয়েশা বেগম (৪২) বড় মাদক ব্যবসায়ী।
মাদক ব্যবসায়ীরা তাকে ‘বড় আম্মা’ বলে চেনে। তার সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে আরও যারা এ ব্যবসায় জড়িত তারা হলো- চট্টগ্রামের নূর আয়শা, বার্মার সুলতানা রাজিয়া, টেকনাফের মুন্নী তাহের ও মোহাম্মদ, নারায়ণগঞ্জের দেলোয়ার, টঙ্গীর আমিরুল, যাত্রাবাড়ীর বাবু, কুমিল্লার রবিন ও খোকন ও নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ার রিপন। নারী মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে কক্সবাজারের সানজিদা বেগম, তার বোন লায়লা বেগম, স্থানীয় বাবুল মেম্বারের স্ত্রী সালেহা বেগম, শামসুননাহার। তাদের ব্যবসাও মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক।