বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর উপজেলা “হাওর রানী” খ্যাত অষ্টগ্রাম নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর ছাড়াও ইতিহাসের দিক থেকে অন্যতম। এ উপজেলার প্রতিটি পরতে পরতে জড়িয়ে আছে নানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য। প্রায় সাড়ে চারশত বছরের পুরোনো পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট কুতুব শাহী মসজিদটির অবস্থানও এই উপজেলায়। দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতায় মসজিদটির কোনো কোনো অংশের নকশা চুন সুড়কির প্রলেপ কিছুটা বিনষ্ট হলেও স্ব-মহিমায় দাড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক কুতুব শাহী মসজিদ।
কিশোরগঞ্জের গভীর হাওর উপজেলা অষ্টগ্রাম সদরে পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির অবস্থান। দেশের পুরাকীর্তিগুলোর অন্যতম কুতুব শাহী মসজিদটির ইতিহাস অনেকেরই অজানা। যারা এ সম্পর্কে গবেষনা করেন তারাও মসজিদটির ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। প্রায় ৭৩ শতাংশ ভূমির উপর মসজিদটির অবস্থান। সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা আয়তকার মাঠ। কিনার দিয়ে আম, জাম, কাঁঠাল, সুপাড়ি, কাঁঠাল চাঁপা গাছের সারি। মৌসুমী ফলের গাছগুলোতে প্রতি বছর ফুল ফলের আগমন হাওরবাসীকে বিমুগ্ধ করে। নামাজের সময় এলাকার মুসল্লি ছাড়া অন্যরা প্রবেশ না করলেও নামাজের সময় ছাড়া দর্শনার্থীরা উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শনটি অবলোকন করে। তাদের পদচারনায় নিরিবিলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশের কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। মসজিদের সামনে পুকুরটির স্বচ্ছ পানি দূর থেকে আসা পথিকের দ্রোহ ক্লান্তিকে দূর করে। দূর থেকে পাঁচ গম্বুজওয়ালা প্রাচীন স্থাপত্যটিকে অন্যরকম সুন্দর দেখায়।
পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিতে কুতুব শাহের মাজার ও আরও পাঁচটি মাজারে কোনো শিলালিপি বা তারিখ পাওয়া যায়নি। বিশিষ্ট লোক ঐতিহ্য সংগ্রহ মো. সাইদুর সম্পাদিত কিশোরগঞ্জ গ্রন্থে এ নির্মাণশৈলী বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, এতে সুলতানী আমলের বৈশিষ্ট্য থাকলেও মোঘল প্রভাবই বেশি। অধ্যাপক ধানির মতে, মসজিদটি ষোড়শ শতকের শেষার্ধ্বে নির্মিত হয়েছিল। তবে আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়ার বিশ্লেষন প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলে পাঠান সম্রাট শের শাহর রাজ্যভূক্ত হয়। পাঠান রাজত্বের শেষে ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলা এই অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই অঞ্চলের মোঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় সুবেদার ইসলাম খানের আমলে ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে।
এতে দেখা যাচ্ছে যে, মুঘল অধিকারের পরে যদি এ মসজিদ নির্মিত হয়ে থাকে, তবে তা সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের আগে হতে পারে না। আর ঈশা খাঁর আমলে যদি এ মসজিদ নির্মিত হয়ে থাকে তবে তা ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে হতে পারে। ঈশা খাঁর আমলে নির্মিত হলে এত মোঘল প্রভাব থাকার কথা নয়। সঙ্গত কারণে তাই ধারনা করা যায় যে, মসজিদটি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম পাদে নির্মিত হয়েছিল।
মসজিদে পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে। এর ভিতর মাঝের গস্বুজটি বৃহৎ। মসজিদটি আয়তকার। বাইরের দিক থেকে দৈর্ঘ্যে ৪৫ফুট। চার কোণে চারটি আট কোণাকার বুরুজ আছে। এগুলো মোল্ডিং দ্বারা শোভিত এবং চূড়া ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো মসজিদের কার্নিশগুলো বেশ বাঁকানো, যা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষন করে।
পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দনি দেয়ালে দুটি করে প্রবেশ দ্বার রয়েছে। পূর্বের তিনটির প্রবেশ দ্বারের মধ্যে মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড়। পূর্ব ও পশ্চিম দেয়াল প্রায় পাঁচফুট এবং উত্তর ও দনি দেয়াল প্রায় ৪.৫ ফুট প্রশস্থ। দেয়ালের বাইরের দিকে পোড়ামাটির চিত্র ফলকের অলংকরণ ছিল। যার সামান্য নমুনা আজও অবিশিষ্ট রয়েছে। পূর্বদিকের দেয়াল দুই সারি প্যানেল দ্বারা শোভিত। প্রবেশদ্বারগুলো অর্ধবৃত্তাকারের খিলানের সাহায্যে নির্মিত। কালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ব্যাতিক্রমধর্মী এই পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট আয়তকার মসজিদটি অনেকটাই শীর্ণ অবস্থায় টিকে আছে।
জানা যায়, ভারতীয় উপ-মহাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য ৩৬০ জন আওলিয়ার আগমন ঘটে। তাদেরই একজন সুফী দরবেশ অলি শাহ কুতুব শাহ (রঃ) এখানে অবস্থান নেন। তৎকালীন সময়ে এ অঞ্চলে গাভী দিয়ে জমি চাষ করা হতো, বিভিন্ন মূর্তি পূজা করা হতো। এসব প্রথা বন্ধ করে এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন শাহ কুতুব (রঃ)।
কুতুবশাহের মসজিদ ও মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর বাংলা মাঘ মাসের শেষ শুক্রবার বিশাল ওরশ মোবারক হয়ে থাকে। এছাড়া মুসলমান ধর্মের প্রধান উৎসবের দুটি ঈদে এ মসজিদে প্রধান জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিগণ মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্য আসেন। লোকশ্রুতি আছে মসজিদ সংলগ্ন সুফী দরবেশ অলি শাহ কুতুব শাহ (রঃ) এর মাজার শরীফে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকই মনের বাসনা পূর্ণ করার জন্য বিভিন্ন মানত করেন এবং অনেকই মানতের সুফল পেয়েছেন।