বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। গত কয়েক বছরে তারা গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নিয়েছেন জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন। খুলেছেন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট। লেনদেনও চলছে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও সবকিছু জানেন। কিন্তু ক্ষমতার দাপটের মুখে কারোরই কিছু বলার নেই। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে এক নেতা বলেন, ‘সারা দেশের নেতা-কর্মীরা যখন হামলা-মামলায় জর্জরিত তখন চেয়ারপারসন অফিসের কর্মচারীরা ব্যস্ত নতুন নতুন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত অন্য রাজনৈতিক নেতারাও তাদের উৎসাহ জোগাচ্ছেন।’ জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের বিশ্বস্ত অফিস সহকারী মাসুদ। পুরো নাম মাসুদার রহমান। তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ৫ কোম্পানি। জয়েন্ট স্টকে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলো হচ্ছে— রমা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, অ্যাকটিভ ট্রেডিং, রমা প্যাকেজিং অ্যান্ড এক্সেসরিজ লিমিটেড, রমা অটো রাইস মিলস লিমিটেড। মাসুদের অন্য সহযোগীরা হলেন— ১. মো. এনামুল হক, পিতা-মৃত আকবর আলী। তার বাসা ধানমন্ডি ১নং সড়কে। (২). মীর শাহ আলম, পিতা-মৃত মীর মোস্তাফিজুর রহমান। তার ঠিকানা তেজগাঁও। (৩) এস এম ওবায়দুল্লাহ, পিতা মৃত মোন্তাজ আলী সরকার। তার ঠিকানা এলিফ্যান্ট রোড দেখানো হয়েছে। এই গ্রুপের আরেকজন পরিচালক হলেন— রুহুল আমিন, পিতা-দলিল উদ্দিন। তার ঠিকানাও ধানমন্ডি এক নম্বর সড়কের এনামুল হকের দেখানো একই বাড়ির পঞ্চম তলায়। জানা গেছে, এই গ্রুপের একজন চেয়ারপারসন কার্যালয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তার দুই ভাই। একজন সহোদর, অপরজন চাচাতো। তবে তাদের ব্যবসা করা প্রসঙ্গে বিএনপির একজন নেতা বলেন, যে কারও ব্যবসা করার অধিকার রয়েছে। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই। তবে অনেকের মতে, এই মুহূর্তে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের কর্মচারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়ালে সরকার তাদের অপব্যবহার করতে পারে। যা সার্বিকভাবে বিএনপির রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ২০১৩ ও ২০১৪ সালে খোলা বেশ কিছু ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে— প্রাইম ব্যাংক ধানমন্ডি শাখা, পূবালী ব্যাংকের সাইন্স ল্যাব শাখা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বগুড়া শাখা। রমা ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত হচ্ছে প্রাইম ব্যাংকের ধানমন্ডি ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্ট নং-১৪৬১১০১০০১৯৮৫২ তে এবং পূবালী ব্যাংকের গুলশান মডেল টাউন ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্ট নং-০৫৬৫৯০১০২৬৪৮৯ এর মাধ্যমে। অ্যাকটিভ ট্রেডিং চলছে প্রাইম ব্যাংকের ধানমন্ডি ব্রাঞ্চের ১৪৬১১৩০০১৭০৮৪, ইউসিবির বগুড়া শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বর ০০০৭১১১০০০৩১৭১০ এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নং-০১-১১৬৯৩১৪০১ এর মাধ্যমে। ঠিকানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে- ধানমন্ডি-১ এর ৫১৯-নং বাড়ি, গুলশান-২ এর কালাচাঁদপুরের ক-৭১ নং হোল্ডিং এবং বগুড়ার শিবগঞ্জের হুদা বালা গ্রাম।
প্রাপ্ত দলিলাদিতে দেখা যায়, ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের সাহেরা ট্রপিক্যাল সেন্টারে গড়ে তোলা আমদানি-রপ্তানি-প্যাকেজিং ও গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাকটিভ ট্রেডিং’-এর মালিকানার শেয়ার যথাক্রমে- মাসুদুর রহমান ৩০%, ওবায়দুল্লাহ ২৫%, এনামুল হক ৩০% এবং রুহুল আমিন ১৫%। রমা প্যাকেজিংয়ে মাসুদ চেয়ারম্যান এবং পরিচালক হিসেবে এনামুল, রুহুল আমিন, ওবায়দুল্লাহর সঙ্গে আছেন শাহে আলম ও রবিউল হক। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল রানার ঠিকানা মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকে ও পরিচালক রবিউল হকের ঠিকানা উত্তরা। তাদের প্রত্যেকেই চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। নিরাপত্তার কাজেও নিয়োজিত কেউ কেউ। রমা রাইস মিলেরও চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন মাসুদ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর শাহে আলম। পরিচালক- এনামুল, ওবায়দুল্লাহ ও রুহুল আমিন। রমা ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান মাসুদ এবং এমডি ওবায়দুল্লাহ। এখানে দুই পরিচালক হলেন— এনামুল ও রুহুল আমিন। এই রমা ইন্টারন্যাশনালের প্রাইম ব্যাংকের ধানমন্ডি ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্টে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকার লেনদেনও দেখা গেছে। পূবালী ব্যাংকের গুলশান মডেল টাউন ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্টেও একই ধরনের লেনদেন আছে। এসব পরিচালকের মধ্যে কয়েকজন আগে রিকশায় চড়তে পারতেন না, তারা এখন ভক্সি গাড়ি কিনেছেন।এ ব্যাপারে মাসুদার রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে গতকাল রাতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি পরিচয় নিশ্চিত করেন। এরপর কোম্পানিগুলোর নাম উল্লেখ করে এগুলো তার মালিকানার কিনা জানতে চাইলে মাসুদ ফোন কেটে দেন। পরে একাধিক দফায় চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
সহ-দফতর সম্পাদকের অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন : বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু পরিচালিত মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। মার্কেন্টাইলের বিজয়নগর ব্রাঞ্চে মেসার্স টি ইন্টারন্যাশনালের নামে খোলা এই অ্যাকাউন্টে গত ৫ এপ্রিল ২০১৫ থেকে চলতি এপ্রিলের ৫ তারিখ পর্যন্ত সাড়ে চার কোটি টাকার লেনদেন করেছেন তিনি। গত বছরের ১৮ মে গুরুত্বপূর্ণ সহ-দফতর সম্পাদক হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা টিপুর ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায়, পাবনা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মোট ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৩ টাকা জমা হয়েছে। তুলে নেওয়া হয়েছে চার কোটি ৩৭ লাখ ৫২ হাজার ৩৭২ টাকা। সব টাকা অনলাইনে ওই হিসাব নম্বরে জমা হয়েছে। সর্বশেষ মার্চের ১৬ তারিখের পর থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২৭ বার লেনদেন হয়েছে। কর্মীদের অভিযোগ, এই টাকা পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্যের। তবে তাইফুলের দাবি, এটি পুরোপুরিই তার ব্যবসার লেনদেনের টাকা।