আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু পরে। শুনে, পড়ে জেনেছি যুদ্ধ সময়ের কথা। যত্ন করে যুদ্ধ বিষয়ক বইগুলো পড়ি। যারা বলেন, মনোযোগ দিয়ে শুনি। মুক্তিযোদ্ধা সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য হলে ছুঁয়ে দেখি। মনে মনে আমিও যুদ্ধে সামিল হই। সে সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হত একটি গান। স্বাধীনতা কিংবা বিজয় দিবসে এখনো বাজে সে গান আর এটি আমার মগজের ভেতর গাঁথা। গানটি রথীন্দ্রনাথ রায়ের কন্ঠে ধারণ করা, “আমার এই দেশ সব মানুষের”।
বলা হয়, যুদ্ধের সময় নারী সম্ভোগ জায়েজ। নারীকে গণিমতের মাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যৌন সম্ভোগের পর মেরে পথে পথে ফেলে রাখাও যুদ্ধ নীতিমালায় আছে। কিন্তু এখন কি যুদ্ধ চলছে, মুক্তির যুদ্ধ? যৌনকর্মের পর এখন নারী হত্যার খবর তো ডালভাত। যুদ্ধ চলছে বলেই হয়তো এগুলো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। পঁয়তাল্লিশ বছর পরে নিশ্চই এর বিচার হবে। নিশ্চই বিচার হবে।
শুনেছি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল দুই অসম শক্তির মধ্যে। একদিকে ছিলো স্বাধীনতায় বিশ্বাসি মুক্তিকামী মানুষ, তারা ছিলো প্রায় ক্ষমতাশূন্য। অন্যদিকে ছিল নিজের মত অন্যের উপর জোর করে চাঁপিয়ে দেয়ার পায়তাড়ায় বর্বর জনগোষ্ঠী। তারা অসীম ক্ষমতাধর ছিলো। মাঝখানে পড়ে চিরকালই চিড়েচ্যাপ্টা হয় সাধারণ মানুষ।
শুনেছি, এই সাধারণ মানুষেরা ক্ষমতাধরদের খুশি রাখার জন্য কিংবা প্রাণভয়ে নিজের ঘরে কায়েদে আযম জিন্নাহ অথবা ভূট্টোর ছবি টানিয়ে রাখতো। এখনো কিন্তু তাই। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ক্ষমতাধরদের গুণগান করতে হয়। তারা যা বলেন নিঃশেষে মেনে চলতে হয়। একটা সিনেমায় দেখেছি, ট্রেনের বগিতে পাকবাহিনী একজন ট্রেন যাত্রীকে কলেমা পড়তে বললো। বেচারা হিন্দু ছিলো। প্রাণভয়ে শিখে রাখা কলেমা শুনিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলো। আমাদেরকেও বলা হয়েছে ধর্ম কর্ম মেনে চলতে, নাহলে যা ঘটবে দায়ভার ব্যক্তির নিজের। আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ভেতর দিয়েই যাচ্ছি?
পঁচিশে মার্চের কালো রাতে বিপুল হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিলো। লেখক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের ঘর থেকে ডেকে নিয়ে কিংবা ঘরে ফেলেই হত্যা করা হয়েছিলো। এখনতো প্রতিটি দিন-রাতই পঁচিশে মার্চ রাতের রিপিটেশন। ব্লগার, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষকরা ঘরে বাইরে নির্বিচারে জীবন দিচ্ছেন। হয়তো পঁয়তাল্লিশ বছর পরে এর বিচার হবে। নিশ্চই বিচার হবে।
আমার বুদ্ধিবৃত্তি দ্বিতীয় শ্রেণীর। ছোট মাথায় এতকিছু কুলোয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণেরা যেমন করেছিল, তেমন করলে কেমন হয়! ফেসবুকের অথবা অন্য যে কোনো লেখার ইন্ট্রোতে কিছু ধর্মীয় বাণী লিখে রাখা যাক-ঐযে ঘরের ভেতর জিন্নাহ আর ভুট্টোর ছবি লাগানোর মতো। বুদ্ধিমানেরা বিষয়টা একটু ভেবে দেখতে পারেন।
লেখার গোড়াতে গানের কথা বলছিলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গান।
“নেই ভেদাভেদ হেথা চাষা আর চামারে
নেই ভেদাভেদ হেথা কুলি আর কামারে
হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান
দেশ মাতা এক সকলের”।
তখন যুদ্ধ চলছিলো, এখনো যুদ্ধ চলছে। পঁয়তাল্লিশ বছর পর গানের কথায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। প্রিয় শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, এ দেশ এখন আর সব মানুষের নয়। এ দেশ নারীর নয়। এ দেশ সংখ্যালঘুর নয়। এ দেশ সমকামীর নয়। এ দেশ ব্লগার, লেখক, সাংবাদিকের নয়। মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন কারও নয়।
আমার দেশ এখন ভূট্টো জিন্নাহ’র অনুসারীদের। একাত্তরে যে যুদ্ধ হয়েছিলো তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। এখন কি কোন যুদ্ধ চলছে, তবে এর নাম মুক্তিযুদ্ধের মুক্তির যুদ্? রক্তের যে মহাযজ্ঞ এই সময়ে চলছে, পঁয়তাল্লিশ বছর পর হয়তো এর বিচার হবে। নিশ্চই এর বিচার হবে।