বিদেশে অর্থ পাচার রোধে ব্যাংক খাতে ‘নগদ অস্বাভাবিক লেনদেন (সিটিআর) ও সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) কঠোর নজরদারিতে আনা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংকে এ ধরনের লেনদেন গভীরভাবে বিশ্লেষণ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর আগে সিটিআর ও এসটিআর গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিএফআইইউকে নির্দেশ দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। পাশাপাশি মানি লন্ডারিং যেন না হয় সেজন্য গ্রাহকের লেনদেন মনিটরিং জোরদার করতে সব তফশিলি ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সূত্রমতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক খাত থেকে প্রাপ্ত সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান, পুত্রবধূ শাজরেহ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক এমপি মির্জা আজম, জান্নাত আরা হেনরী ও ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল এবং সিটিজেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান তৌফিকা আফতাব। এছাড়া সন্দেহজনক লেনদেনের ভিত্তিতে আরও যাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয় তাদের মধ্যে রয়েছেন ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিম, তার পরিবারের সদস্য, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তার, সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও তার স্ত্রী নাফিসা বানু, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন ও তার স্ত্রী আফসারী খানম।
সূত্রমতে, অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা নিয়ে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছেন। সেখানে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেন রিপোর্ট (সিটিআর) ও সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) বিশ্লেষণ জোরদার করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিএফআইইউকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
ওই বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদ্য বিদায়ি সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, সন্দেহজনক যে কোনো লেনদেন পরিলক্ষিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক যেন অনতিবিলম্বে বিএফআইইউকে রিপোর্ট প্রদান করে সে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, বিগত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে সিটিআর এবং এসটিআর লেনেদেন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই আট মাসে ব্যাংক খাতে ২ কোটি ৫৬ লাখ ৯৬ হাজার ২২২টি ব্যাংকে (সিটিআর) লেনদেন শনাক্ত করা হয়। এর মধ্য থেকে বিশ্লেষণ করে ১০ হাজার ৮১৬টি সন্দেহজনক (এসটিআর) লেনদেন শনাক্ত করা হয়। সন্দেহজনক গ্রাহকের হিসাবগুলোর মধ্যে ১৭৬টি ঘটনাকে অধিক তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছে বিএফআইইউ। তবে বর্তমান হিসাবে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) হচ্ছে-‘যাহা স্বাভাবিক এবং সাধারণ লেনদেনের ধরন হইতে ভিন্ন বা যে লেনদেন অপরাধ হইতে অর্জিত সম্পদ বা কোনো সন্ত্রাসী কার্যে, কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বা সন্ত্রাসীকে অর্থায়ন করে। আর সিটিআর লেনদেন হচ্ছে-ব্যাংকিং নিয়মে একজন গ্রাহক একটি নির্দিষ্ট দিনে তার অ্যাকাউন্টে একাধিক বা একটি লেনদেনের মাধ্যমে দশ লাখ টাকা বা তারও বেশি জমা বা উত্তোলন করা।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট এর সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) এবং সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) বিশ্বব্যাপী হচ্ছে। এটি গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের তথ্য পর্যালোচনার জন্য এক ধরনের সতর্ক সংকেত বটে। প্রতিটি দেশই তাদের অর্থ পাচার ও আর্থিক ঝুঁকি পর্যালোচনা করে। এসটিআরের মাধ্যম ঝুঁকি পর্যালোচনার একটি কৌশল। তিনি আরও বলেন, সারা মাসে এ ধরনের লেনদেন তালিকাভুক্ত করে একটি নির্দিষ্ট তারিখে ব্যাংকগুলো পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কাছে। তবে কোনো গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হলে তা সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যাংকের শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ে রিপোর্ট করে। পরবর্তীতে প্রধান কার্যালয় থেকে সেটি বিএফআইইইতে পাঠানো হয়।
সূত্রমতে, অর্থ পাচার প্রতিরোধের পাশাপাশি হুন্ডি এবং মোবাইল ব্যাকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিএফআইইউ অনলাইন গেম, বেটিং ও অবৈধ ফরেক্স ট্রেডিং পরিচালনাকারী ২৯১টি ওয়েবসাইট, ৪৬৪টি সোশ্যাল মিডিয়া (ফেসবুক, ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রাম) ও ৩৩টি মোবাইল অ্যাপস শনাক্ত করেছে। এদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পাঠানো হয়েছে। হুন্ডির সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে ২১টি মানিচেঞ্জারের তালিকা এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৩৯টি হিসাবের তথ্য প্রদান করা হয়েছে পুলিশের সিআইডিকে। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগে ব্যক্তিগত ২৭ হাজার ৬৮০ মোবাইল ব্যাংক (এমএফএস) স্থগিত এবং ৫ হাজার ২৯টি এমএফএস এজেন্টশিপ বাতিল করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব এটি, যা বর্তমানে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।
এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত বৈঠকে আলোচনা হয়। অর্থ পাচারের এসব মাধ্যম বন্ধের জন্য মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন সংক্রান্ত লেনদেনগুলো মনিটরিং জোরদারের জন্য তফশিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।