ঢাকা , শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যাংকিং খাতের সমস্যার মূলে ‘খেলাপি ঋণ

ব্যাংকিং কমিশন’ই হোক আর ‘ব্যাংকিং টাস্কফোর্স’ই হোক—এগুলো কেন? এত কথা বলার দরকার নেই। ব্যাংকিং খাতের সমস্যার মূলে, সব সমস্যার মূলে হচ্ছে ‘খেলাপি ঋণ’ (ক্লাসিফাইড লোন)। খেলাপি ঋণ কী? এখানে ‘খেলাপি’ হচ্ছে শর্ত খেলাপি। ঋণদানের সময় কিছু শর্ত থাকে—বিশেষ করে কত দিনের মধ্যে ঋণ পরিশোধ হবে, কিস্তি কী ইত্যাদি। এর খেলাপ হলেই প্রধানত একে খেলাপি ঋণ বলে। এটা কেন হয়? কারা দায়ী এর জন্য? বিশাল এক প্রশ্ন। সহজ কোনো উত্তর নেই।

কেউ ‘খেলাপি’ হতে পারে রাজনৈতিক কারণে, প্রাকৃতিক কারণে, প্রযুক্তির কারণে। আবার তা হতে পারে ইচ্ছাকৃত। সামর্থ্য আছে পরিশোধের, কিন্তু ইচ্ছা নেই। রাজনৈতিক কারণ কীভাবে? এই যেমন বর্তমানে ছাত্র আন্দোলনের ফলে মাস দেড়েক যাবৎ উৎপাদন, বেচাকেনা বিঘ্নিত। সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত। মিল-ফ্যাক্টরি পুড়েছে, উৎপাদন বন্ধ হয়েছে বা হচ্ছে শ্রমিকদের আন্দোলনে। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁরা অনেকেই ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। কিস্তি দিতে পারছেন না। রয়েছে ব্যবসায়িক কারণ। যেমন তেলের সংকট, বিদ্যুতের সংকট, গ্যাসের সংকট, ডলারের সংকট, ঋণপত্র খোলার সংকট। এসব কারণে ব্যবসা ও ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত। তাঁরা কিস্তি দিতে পারছেন না। হচ্ছেন ঋণখেলাপি।

বন্যা, খরা, ঝড়, দুর্যোগ, প্রাকৃতিক পরিবর্তন ইত্যাদিতেও ব্যবসা ও ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হন। ব্যবসায়ী ঋণের কিস্তির টাকা দিতে পারেন না। এদিকে রয়েছে প্রযুক্তিগত সমস্যা। এই যেমন পদ্মা সেতু। বিশাল ঘটনা। মানুষের যাতায়াতের কত সুবিধা হয়েছে। কিন্তু এর মাশুল দিতে হয়। লঞ্চের ব্যবসা, স্টিমারের ব্যবসায় নেমেছে ধস। এদিকে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল। এতে বাসের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত। এসবে ব্যাংকের অসুবিধা কী? অসুবিধা হচ্ছে এই যে আজকের দুনিয়ায় এমন কোনো ব্যবসা নেই, যেখানে ব্যাংকের ‘ফিন্যান্স’ নেই। বস্তুত আজকের ভালোমন্দ ‘উন্নত-অনুন্নত’ বাংলাদেশ গঠনে ব্যাংক ফিন্যান্স অপরিহার্য ছিল, আছে, থাকবে।

মুশকিল হচ্ছে ওপরে বর্ণিত প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যাংকের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত। ঋণগ্রহীতারা ব্যবসা করতে না পারলে ব্যাংকের লোনের টাকা দেবে কোত্থেকে? আমরা কেউ যদি মনে করে থাকি যে ব্যবসা নেই অথচ ঋণের টাকা ফেরত দিতে হবে, তাহলে এটা অবাস্তব চিন্তা। জমানো টাকা, পকেটের টাকা দিয়ে ব্যাংকের ঋণ শোধের নজির বিরল। বস্তুত এটা বাঙালির ব্যবসা। ছোটবেলায় দোকানে দোকানে লেখা দেখেছি ‘আজ নগদ, কাল বাকি, বাকির নাম ফাঁকি’। এটা কারও বানানো কথা নয়। আমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা এবং চর্চিত। এমন একটা সমাজে অর্থনীতিতে ব্যাংকার ব্যবসা করেন। এখানে প্রকৃত কারণ থাকলে তো কথাই নেই, স্বাভাবিক অবস্থায়ও কেউ ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে চান না।

এরই মধ্যে আমরা ‘প্রাইমারি অ্যাকুমুলেশন অব ক্যাপিটাল’-এর নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে ঋণগ্রহীতাদের অনেক আশকারা দিয়েছি। এতে লাভ-ক্ষতি দুটোই হয়েছে। এই হিসাব ভিন্ন। কিন্তু তাও হিসাব। পরিস্থিতি এমনই যে এখন বিনা কারণেই লোকজন ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে চান না। এটা স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু হয়েছে প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলো দিয়ে। ১৯৮৪ সালে বেসরকারি খাতে ব্যাংক দেওয়ার পর পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। দুটো বড় বিজনেস হাউস তখনকার দিনের ২৫০ কোটি টাকা মেরে দিতে উদ্যত হয়। ধরা পড়ে যায় সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের হাতে। তিনি ব্যাংকের পরিচালকদের পদত্যাগে বাধ্য করেন। কিন্তু যা করা যায়নি তা হচ্ছে ‘ক্রিমিনাল মামলা’। উল্টো কাস্টমার-ব্যাংকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে ওই ঋণের টাকা বিনা সুদে ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়। এটা হচ্ছে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের উদাহরণ। এখানে কোনো ব্যবসায়িক, প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কারণ নেই। বিষয়টি ছিল সহজ বাংলায়—পুঁজি গঠনে সাহায্য করা। যেমন, আমেরিকানরা বলে, ‘এভরি ফার্স্ট ডলার ইজ ডার্টি ডলার’। এই উদাহরণে ভর্তি আমাদের দেশ।

বহু বড় বড় ব্যবসায়ীর টাকা বানানোর প্রাথমিক ইতিহাস নোংরা পর্যায়ে পড়ে। সেদিকে আজ যাব না। আজকের সমস্যা—ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির টাকা কীভাবে উদ্ধার করা যাবে। আরও সমস্যা—আগামী দিনে যেন এসব ‘লুট’ আর না ঘটে তার জন্য কী করা যায়। অতীতে যা ঘটেছে অর্থাৎ, বর্তমান ঋণখেলাপিদের সমস্যা আলাদা একটি বিষয়। একে আলাদাভাবে ফয়সালা করতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য কী করা যায়? করা যায় অনেক কিছু। ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই। এই ক্ষেত্রে আমার একটা সুপারিশ আছে। সুপারিশটা হচ্ছে প্রধান নির্বাহীকে নিয়ে। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী যদি শিরদাঁড়া সোজা করে কাজ করেন তাহলে ৫০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এর ব্যবস্থাও করা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান নির্বাহীর যোগ্যতা ঠিক করে দিয়েছে। তাঁর বেতনও ঠিক করে দিয়েছে। তাঁর নিয়োগ এবং বরখাস্তকরণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে। এসব করা হয়েছে যেন প্রধান নির্বাহীরা বোর্ডের হস্তক্ষেপের বাইরে কাজ করতে পারেন। একটা অডিট কমিটি আছে। তাতে প্রধান নির্বাহী নেই, যেন অডিট কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন।

দুঃখের বিষয়, এরপরও এমন নির্বাহী ব্যাংকে খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি শিরদাঁড়া উঁচু করে কাজ করবেন। দরকারবোধে সবকিছু বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাক। উল্টো অনেক প্রধান নির্বাহী তাঁদের কিছু বশংবদ অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে মালিকদের এ সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে ব্যাংকগুলোর সর্বনাশ করেছে এবং করছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানই বড় হয়ে উঠেছে। বশংবদ ছাড়া কারও পদোন্নতি নেই, বশংবদ ছাড়া কারও নিয়োগ নেই। খুব কম ব্যাংকই আছে যেখানে সত্যিকার অর্থে উপযুক্ত প্রধান নির্বাহী নিয়োজিত আছেন। কোথাও থাকলে সেটা একান্তই ব্যতিক্রম।

এমতাবস্থায় আমার সুপারিশ হচ্ছে, এখন থেকে এমন ব্যবস্থা করা হোক যেন সব বড় সিদ্ধান্ত, ঋণ সিদ্ধান্তের জন্য প্রধান নির্বাহী হবেন এক নম্বর দায়ী। ভালোমন্দ দুটোর জন্যই। বড় বড় সিদ্ধান্ত বোর্ডে হয়। বোর্ডের এমনিতে কোনো ক্ষমতা নেই। চা-বিস্কুট খাওয়ারও অধিকার নেই। সব সিদ্ধান্তের জন্য দরকার ‘মেমো’। মেমো ছাড়া বোর্ড কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বোর্ড খারাপ কাজ, দুই নম্বরি কাজ প্রধান নির্বাহীর স্বাক্ষরে করে থাকে। প্রধান নির্বাহী রাজি না হলে কোনো ‘আকাম’ই ব্যাংকে সম্ভব নয়। এ কারণে আমি মনে করি, প্রধান নির্বাহীকে সবার আগে ধরতে হবে। তারপর অন্যদের। এক নম্বর আসামি প্রধান নির্বাহী, জবাব দেবেন তিনি।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

ব্যাংকিং খাতের সমস্যার মূলে ‘খেলাপি ঋণ

আপডেট টাইম : ০৫:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ব্যাংকিং কমিশন’ই হোক আর ‘ব্যাংকিং টাস্কফোর্স’ই হোক—এগুলো কেন? এত কথা বলার দরকার নেই। ব্যাংকিং খাতের সমস্যার মূলে, সব সমস্যার মূলে হচ্ছে ‘খেলাপি ঋণ’ (ক্লাসিফাইড লোন)। খেলাপি ঋণ কী? এখানে ‘খেলাপি’ হচ্ছে শর্ত খেলাপি। ঋণদানের সময় কিছু শর্ত থাকে—বিশেষ করে কত দিনের মধ্যে ঋণ পরিশোধ হবে, কিস্তি কী ইত্যাদি। এর খেলাপ হলেই প্রধানত একে খেলাপি ঋণ বলে। এটা কেন হয়? কারা দায়ী এর জন্য? বিশাল এক প্রশ্ন। সহজ কোনো উত্তর নেই।

কেউ ‘খেলাপি’ হতে পারে রাজনৈতিক কারণে, প্রাকৃতিক কারণে, প্রযুক্তির কারণে। আবার তা হতে পারে ইচ্ছাকৃত। সামর্থ্য আছে পরিশোধের, কিন্তু ইচ্ছা নেই। রাজনৈতিক কারণ কীভাবে? এই যেমন বর্তমানে ছাত্র আন্দোলনের ফলে মাস দেড়েক যাবৎ উৎপাদন, বেচাকেনা বিঘ্নিত। সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত। মিল-ফ্যাক্টরি পুড়েছে, উৎপাদন বন্ধ হয়েছে বা হচ্ছে শ্রমিকদের আন্দোলনে। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁরা অনেকেই ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। কিস্তি দিতে পারছেন না। রয়েছে ব্যবসায়িক কারণ। যেমন তেলের সংকট, বিদ্যুতের সংকট, গ্যাসের সংকট, ডলারের সংকট, ঋণপত্র খোলার সংকট। এসব কারণে ব্যবসা ও ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত। তাঁরা কিস্তি দিতে পারছেন না। হচ্ছেন ঋণখেলাপি।

বন্যা, খরা, ঝড়, দুর্যোগ, প্রাকৃতিক পরিবর্তন ইত্যাদিতেও ব্যবসা ও ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হন। ব্যবসায়ী ঋণের কিস্তির টাকা দিতে পারেন না। এদিকে রয়েছে প্রযুক্তিগত সমস্যা। এই যেমন পদ্মা সেতু। বিশাল ঘটনা। মানুষের যাতায়াতের কত সুবিধা হয়েছে। কিন্তু এর মাশুল দিতে হয়। লঞ্চের ব্যবসা, স্টিমারের ব্যবসায় নেমেছে ধস। এদিকে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল। এতে বাসের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত। এসবে ব্যাংকের অসুবিধা কী? অসুবিধা হচ্ছে এই যে আজকের দুনিয়ায় এমন কোনো ব্যবসা নেই, যেখানে ব্যাংকের ‘ফিন্যান্স’ নেই। বস্তুত আজকের ভালোমন্দ ‘উন্নত-অনুন্নত’ বাংলাদেশ গঠনে ব্যাংক ফিন্যান্স অপরিহার্য ছিল, আছে, থাকবে।

মুশকিল হচ্ছে ওপরে বর্ণিত প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যাংকের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত। ঋণগ্রহীতারা ব্যবসা করতে না পারলে ব্যাংকের লোনের টাকা দেবে কোত্থেকে? আমরা কেউ যদি মনে করে থাকি যে ব্যবসা নেই অথচ ঋণের টাকা ফেরত দিতে হবে, তাহলে এটা অবাস্তব চিন্তা। জমানো টাকা, পকেটের টাকা দিয়ে ব্যাংকের ঋণ শোধের নজির বিরল। বস্তুত এটা বাঙালির ব্যবসা। ছোটবেলায় দোকানে দোকানে লেখা দেখেছি ‘আজ নগদ, কাল বাকি, বাকির নাম ফাঁকি’। এটা কারও বানানো কথা নয়। আমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা এবং চর্চিত। এমন একটা সমাজে অর্থনীতিতে ব্যাংকার ব্যবসা করেন। এখানে প্রকৃত কারণ থাকলে তো কথাই নেই, স্বাভাবিক অবস্থায়ও কেউ ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে চান না।

এরই মধ্যে আমরা ‘প্রাইমারি অ্যাকুমুলেশন অব ক্যাপিটাল’-এর নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে ঋণগ্রহীতাদের অনেক আশকারা দিয়েছি। এতে লাভ-ক্ষতি দুটোই হয়েছে। এই হিসাব ভিন্ন। কিন্তু তাও হিসাব। পরিস্থিতি এমনই যে এখন বিনা কারণেই লোকজন ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে চান না। এটা স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু হয়েছে প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলো দিয়ে। ১৯৮৪ সালে বেসরকারি খাতে ব্যাংক দেওয়ার পর পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। দুটো বড় বিজনেস হাউস তখনকার দিনের ২৫০ কোটি টাকা মেরে দিতে উদ্যত হয়। ধরা পড়ে যায় সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের হাতে। তিনি ব্যাংকের পরিচালকদের পদত্যাগে বাধ্য করেন। কিন্তু যা করা যায়নি তা হচ্ছে ‘ক্রিমিনাল মামলা’। উল্টো কাস্টমার-ব্যাংকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে ওই ঋণের টাকা বিনা সুদে ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়। এটা হচ্ছে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের উদাহরণ। এখানে কোনো ব্যবসায়িক, প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কারণ নেই। বিষয়টি ছিল সহজ বাংলায়—পুঁজি গঠনে সাহায্য করা। যেমন, আমেরিকানরা বলে, ‘এভরি ফার্স্ট ডলার ইজ ডার্টি ডলার’। এই উদাহরণে ভর্তি আমাদের দেশ।

বহু বড় বড় ব্যবসায়ীর টাকা বানানোর প্রাথমিক ইতিহাস নোংরা পর্যায়ে পড়ে। সেদিকে আজ যাব না। আজকের সমস্যা—ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির টাকা কীভাবে উদ্ধার করা যাবে। আরও সমস্যা—আগামী দিনে যেন এসব ‘লুট’ আর না ঘটে তার জন্য কী করা যায়। অতীতে যা ঘটেছে অর্থাৎ, বর্তমান ঋণখেলাপিদের সমস্যা আলাদা একটি বিষয়। একে আলাদাভাবে ফয়সালা করতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য কী করা যায়? করা যায় অনেক কিছু। ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই। এই ক্ষেত্রে আমার একটা সুপারিশ আছে। সুপারিশটা হচ্ছে প্রধান নির্বাহীকে নিয়ে। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী যদি শিরদাঁড়া সোজা করে কাজ করেন তাহলে ৫০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এর ব্যবস্থাও করা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান নির্বাহীর যোগ্যতা ঠিক করে দিয়েছে। তাঁর বেতনও ঠিক করে দিয়েছে। তাঁর নিয়োগ এবং বরখাস্তকরণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে। এসব করা হয়েছে যেন প্রধান নির্বাহীরা বোর্ডের হস্তক্ষেপের বাইরে কাজ করতে পারেন। একটা অডিট কমিটি আছে। তাতে প্রধান নির্বাহী নেই, যেন অডিট কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন।

দুঃখের বিষয়, এরপরও এমন নির্বাহী ব্যাংকে খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি শিরদাঁড়া উঁচু করে কাজ করবেন। দরকারবোধে সবকিছু বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাক। উল্টো অনেক প্রধান নির্বাহী তাঁদের কিছু বশংবদ অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে মালিকদের এ সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে ব্যাংকগুলোর সর্বনাশ করেছে এবং করছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানই বড় হয়ে উঠেছে। বশংবদ ছাড়া কারও পদোন্নতি নেই, বশংবদ ছাড়া কারও নিয়োগ নেই। খুব কম ব্যাংকই আছে যেখানে সত্যিকার অর্থে উপযুক্ত প্রধান নির্বাহী নিয়োজিত আছেন। কোথাও থাকলে সেটা একান্তই ব্যতিক্রম।

এমতাবস্থায় আমার সুপারিশ হচ্ছে, এখন থেকে এমন ব্যবস্থা করা হোক যেন সব বড় সিদ্ধান্ত, ঋণ সিদ্ধান্তের জন্য প্রধান নির্বাহী হবেন এক নম্বর দায়ী। ভালোমন্দ দুটোর জন্যই। বড় বড় সিদ্ধান্ত বোর্ডে হয়। বোর্ডের এমনিতে কোনো ক্ষমতা নেই। চা-বিস্কুট খাওয়ারও অধিকার নেই। সব সিদ্ধান্তের জন্য দরকার ‘মেমো’। মেমো ছাড়া বোর্ড কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বোর্ড খারাপ কাজ, দুই নম্বরি কাজ প্রধান নির্বাহীর স্বাক্ষরে করে থাকে। প্রধান নির্বাহী রাজি না হলে কোনো ‘আকাম’ই ব্যাংকে সম্ভব নয়। এ কারণে আমি মনে করি, প্রধান নির্বাহীকে সবার আগে ধরতে হবে। তারপর অন্যদের। এক নম্বর আসামি প্রধান নির্বাহী, জবাব দেবেন তিনি।