ঢাকা , শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি

আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৯) শেষ পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রতি বছর ৩০০ বিলিয়ন ডলার তহবিল পাওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। এই চুক্তি ২০৩৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রথমে উন্নত দেশগুলো বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলার বা ২৫ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর আপত্তিতে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে সমঝোতা হয়।কপ২৯ সম্মেলন গত শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও জলবায়ু তহবিল নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় সময় বাড়ানো হয়। দুই সপ্তাহের দর-কষাকষির শেষে গত শনিবার সম্মেলনের প্রতিনিধিরা সমঝোতায় পৌঁছান। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও অভিযোজন ব্যয় বাবদ উন্নত দেশগুলো বার্ষিক ৩০ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ের আশ্বাস দিয়েছে। যদিও এই অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম।

চুক্তির মধ্যে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বিস্তৃত জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়েছে, যাতে সরকারি ও বেসরকারি তহবিল উভয়ই থাকবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলা করার জন্য এই অর্থ প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। জলবায়ু তহবিল নিয়ে ২০০ দেশ সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় সম্মেলনের সময় বাড়ানো হয়। একপর্যায়ে উন্নয়নশীল ও দ্বীপদেশগুলোর প্রতিনিধিরা হতাশা প্রকাশ করে সম্মেলন থেকে বের হয়ে যান। তারা অভিযোগ করেন, জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলো চুক্তি দুর্বল করার চেষ্টা করছে।

পূর্ববর্তী চুক্তির অধীনে, উন্নত দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে জলবায়ু অর্থায়নে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ১০ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা ২০২২ সালে গিয়ে বাস্তবায়িত হয়। এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালে। নতুন সমঝোতায় তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে সমালোচনা করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সায়মন স্টিল এই চুক্তিকে মানবতার বীমা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এই যাত্রা কঠিন হলেও আমরা একটি চুক্তি সরবরাহ করতে পেরেছি। তার আশা, চুক্তির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির বিকাশ ও শতাধিক মানুষের জীবন রক্ষা পাবে। তবে তিনি বলেন, যেকোনো বীমা পলিসির মতোই এটা তখনই কাজ করবে, যদি প্রিমিয়াম সবটা এবং সময়মতো পরিশোধ করা হয়।

জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক এক্সে পোস্ট করে বলেন, যারা এখানে অগ্রযাত্রা থামাতে এসেছিলেন, তারা বাজেভাবে হেরে গেছেন। বার্ষিক ৩০ হাজার কোটি ডলারের চুক্তিটি কেবল সূচনা। তিনি আরও বলেন, ঐতিহাসিক দায় কেউ ভুলে যায়নি এবং তরুণ প্রজন্মের সদস্য হিসেবে এটি পরিষ্কার যে, আমরা অতীতের সমাধান দিয়ে ভবিষ্যতের জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব না।

মালাওয়ির কূটনীতিক এবং এলডিসির প্রধান বলেন, আমরা কী আশা করছি তা পাওয়া এখানকার লক্ষ্য নয়। কয়েক বছরের আলোচনার পর আমরা আর উচ্চাভিলাষী নই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জলবায়ু কমিশনার ভপকে হুকস্ট্রা মনে করেন, তহবিলের অঙ্ক ট্রিলিয়ন ডলার না হলেও তা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যথেষ্ট। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আশা করছেন, চুক্তি মেনে আরও বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে।

এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়-পরবর্তীতে উন্নত দেশগুলোর অর্থায়নের আলোচনা আরও বেশি শঙ্কায় পড়ে যায়। ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন এবং তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল দিতে আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া, উন্নত দেশগুলো তাদের বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে অতিরিক্ত তহবিল দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ভারত, বলিভিয়া, কিউবা, নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলো এই অবস্থানকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছে। পরিবেশকর্মীরাও এই চুক্তির সমালোচনা করেন।

ব্রাজিলের জলবায়ু পরিবর্তন সংগঠন অবজারভেটরি দো ক্লিমার ক্লাউডিও অ্যাঞ্জেলো বলেছেন, ধনী দেশগুলো আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একটি চুক্তি গ্রহণে বাধ্য করছে।

অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত ৩০০ বিলিয়ন ডলার অনুদান এবং স্বল্প সুদের ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। বাকি অর্থ আসবে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের এবং নতুন সম্ভাব্য অর্থের উৎস, যেমনÑ জীবাশ্ম জ্বালানি ও উড়োজাহাজে নিয়মিত ভ্রমণকারীদের থেকে পাওয়া শুল্ক থেকে। তবে এই সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহামেদ আদৌ বলেন, কপ-২৯ সম্মেলনটি উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি বিপর্যয়। ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দাবি করলেও তাদের এই অর্থায়ন অপমানজনক। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মানুষ এখনই জীবন ও জীবিকা হারাচ্ছে।

বিশ্বের দুটি বড় অর্থনীতি এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃহৎ নির্গমনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবারের সম্মেলনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি। চীন স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যকবলিত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল দেওয়ার কথা বললেও ধনী দেশগুলো বাধ্যতামূলকভাবে তহবিল দেবে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি

আপডেট টাইম : ০৫:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৯) শেষ পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রতি বছর ৩০০ বিলিয়ন ডলার তহবিল পাওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। এই চুক্তি ২০৩৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রথমে উন্নত দেশগুলো বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলার বা ২৫ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর আপত্তিতে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে সমঝোতা হয়।কপ২৯ সম্মেলন গত শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও জলবায়ু তহবিল নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় সময় বাড়ানো হয়। দুই সপ্তাহের দর-কষাকষির শেষে গত শনিবার সম্মেলনের প্রতিনিধিরা সমঝোতায় পৌঁছান। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও অভিযোজন ব্যয় বাবদ উন্নত দেশগুলো বার্ষিক ৩০ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ের আশ্বাস দিয়েছে। যদিও এই অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম।

চুক্তির মধ্যে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বিস্তৃত জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়েছে, যাতে সরকারি ও বেসরকারি তহবিল উভয়ই থাকবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলা করার জন্য এই অর্থ প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। জলবায়ু তহবিল নিয়ে ২০০ দেশ সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় সম্মেলনের সময় বাড়ানো হয়। একপর্যায়ে উন্নয়নশীল ও দ্বীপদেশগুলোর প্রতিনিধিরা হতাশা প্রকাশ করে সম্মেলন থেকে বের হয়ে যান। তারা অভিযোগ করেন, জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলো চুক্তি দুর্বল করার চেষ্টা করছে।

পূর্ববর্তী চুক্তির অধীনে, উন্নত দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে জলবায়ু অর্থায়নে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ১০ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা ২০২২ সালে গিয়ে বাস্তবায়িত হয়। এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালে। নতুন সমঝোতায় তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে সমালোচনা করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সায়মন স্টিল এই চুক্তিকে মানবতার বীমা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এই যাত্রা কঠিন হলেও আমরা একটি চুক্তি সরবরাহ করতে পেরেছি। তার আশা, চুক্তির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির বিকাশ ও শতাধিক মানুষের জীবন রক্ষা পাবে। তবে তিনি বলেন, যেকোনো বীমা পলিসির মতোই এটা তখনই কাজ করবে, যদি প্রিমিয়াম সবটা এবং সময়মতো পরিশোধ করা হয়।

জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক এক্সে পোস্ট করে বলেন, যারা এখানে অগ্রযাত্রা থামাতে এসেছিলেন, তারা বাজেভাবে হেরে গেছেন। বার্ষিক ৩০ হাজার কোটি ডলারের চুক্তিটি কেবল সূচনা। তিনি আরও বলেন, ঐতিহাসিক দায় কেউ ভুলে যায়নি এবং তরুণ প্রজন্মের সদস্য হিসেবে এটি পরিষ্কার যে, আমরা অতীতের সমাধান দিয়ে ভবিষ্যতের জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব না।

মালাওয়ির কূটনীতিক এবং এলডিসির প্রধান বলেন, আমরা কী আশা করছি তা পাওয়া এখানকার লক্ষ্য নয়। কয়েক বছরের আলোচনার পর আমরা আর উচ্চাভিলাষী নই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জলবায়ু কমিশনার ভপকে হুকস্ট্রা মনে করেন, তহবিলের অঙ্ক ট্রিলিয়ন ডলার না হলেও তা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যথেষ্ট। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আশা করছেন, চুক্তি মেনে আরও বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে।

এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়-পরবর্তীতে উন্নত দেশগুলোর অর্থায়নের আলোচনা আরও বেশি শঙ্কায় পড়ে যায়। ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন এবং তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল দিতে আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া, উন্নত দেশগুলো তাদের বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে অতিরিক্ত তহবিল দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ভারত, বলিভিয়া, কিউবা, নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলো এই অবস্থানকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছে। পরিবেশকর্মীরাও এই চুক্তির সমালোচনা করেন।

ব্রাজিলের জলবায়ু পরিবর্তন সংগঠন অবজারভেটরি দো ক্লিমার ক্লাউডিও অ্যাঞ্জেলো বলেছেন, ধনী দেশগুলো আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একটি চুক্তি গ্রহণে বাধ্য করছে।

অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত ৩০০ বিলিয়ন ডলার অনুদান এবং স্বল্প সুদের ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। বাকি অর্থ আসবে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের এবং নতুন সম্ভাব্য অর্থের উৎস, যেমনÑ জীবাশ্ম জ্বালানি ও উড়োজাহাজে নিয়মিত ভ্রমণকারীদের থেকে পাওয়া শুল্ক থেকে। তবে এই সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহামেদ আদৌ বলেন, কপ-২৯ সম্মেলনটি উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি বিপর্যয়। ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দাবি করলেও তাদের এই অর্থায়ন অপমানজনক। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মানুষ এখনই জীবন ও জীবিকা হারাচ্ছে।

বিশ্বের দুটি বড় অর্থনীতি এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃহৎ নির্গমনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবারের সম্মেলনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি। চীন স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যকবলিত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল দেওয়ার কথা বললেও ধনী দেশগুলো বাধ্যতামূলকভাবে তহবিল দেবে।