মিয়ানমারে দীর্ঘ সময় ধরে কীভাবে সামরিক বাহিনী তাদের আধিপত্য বজায় রেখে আসছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গণতন্ত্র চায়নি তা তাদের শাসনকালের দিকে তাকালেই করলেই বোঝা যায়। মিয়ানমারের স্বাধীনতার ৭২ বছরের মধ্যে তারা ডিক্রি জারির মাধ্যমে শাসন করেছে ৩৭ বছর (১৯৫৮-৬০, ১৯৬২-৭৪, ১৯৮৮-২০১১, ২০২১-বর্তমান)।
এর আগেও ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর থেকে বেশ কয়েকটি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে দেশটিতে।
সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল ২০২১ সালে।
এর কারণ বিশ্লেষণ করেছেন জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ডেভিড আই স্টেইনবার্গ ‘দ্য মিলিটারি ইন বার্মা/মিয়ানমার’ নামে তার বইয়ে । এ বইয়ের কিছু অংশ প্রকাশ করেছে বুধবার ( ৭ ফেব্রুয়ারি) বিবিসি প্রতিবেদন আকারে।
স্টেইনবার্গ বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির চেয়ে বেশি পুরনো।
তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী বিভিন্ন সময় সংবিধানে নিজের অনুকূলে নানা বিধি অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং এগুলো তাদের অনুমোদন ছাড়া সংশোধনের উপায় নেই। তিনি মনে করেন, চতুর্থ ও সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মূল কারণ হচ্ছে শীর্ষ জেনারেল মিন অং লাইং এবং রাজনৈতিক নেতা অং সান সু চির মধ্যকার ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব।
বিশেষ করে ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির কাছে সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দলের পরাজয় সামরিক বাহিনীর জন্য অপমানকর ছিল।
তিনি বলেন, সাংবিধানিক ক্ষমতার মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে ১৯ বছর (১৯৭৪-৮৮, ২০১১-১৬), এবং ২০১৬-২১ পর্যন্ত পাঁচ বছর শাসন ক্ষমতায় নির্ধারিত নিয়ন্ত্রণ ছিল। সে হিসেবে মাত্র ১২ বছর দেশটির শাসন ক্ষমতা বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে ছিল, যদিও এই সময়েও সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ছিল।
সবচেয়ে বেশি সামরিক ব্যয় বরাদ্দ থাকে বাজেটে। সদস্য সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে প্রতিবছর। মিয়নমারের মানুষজনকে বোঝানো হয়, যদি ভালো থাকতে হয় তবে সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়া চাড়া বিকল্প নেই।
১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের পর সোশ্যালিস্ট রেভ্যুলিউশন ব্যর্থ হলেও তিনি দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সামরিক বাহিনীর জন্য উপযোগী করে পরিবর্তিত করতে সফল হয়েছিলেন।
সাধারণত জেনারেল পদে থাকা সামরিক কর্মকর্তাদের মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়া হত। এই ব্যবস্থা এখনো বহাল আছে।
বলা হয়ে থাকে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রটির তুলনায় বেশি বয়স্ক। কীভাবে ? ১৯৪৭ সালে থাইল্যান্ডে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং তখন এর নাম ছিল ‘বার্মা ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি’। দেশটির স্বাধীনতার জনক অং সান এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তা দিয়েছিল জাপান।
বিশ্লেষকরা মনে করেন— স্বাধীনতা পরবর্তী মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর মূল দায়িত্ব ছিল কমিউনিস্ট এবং জাতিগত সহিংসতা দমন করা এবং দেশকে ঐকস্টেইনবার্গ বলেন, মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বৈধতা আদায়ের চিরাচরিত একটি যুক্তি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক আক্রমণ থেকে দেশটিকে রক্ষা করা। অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসেবে মনে করা হতো বার্মা কমিউনিস্ট পার্টিকে যারা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থিত ছিল। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের শঙ্কা এবং তা ঠেকানোর জন্য নাগরিকদের আধা সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মতো ঘটনাগুলো এই প্যারানয়ার অংশ।
তিনি বলেন, মজার ব্যাপার অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের বেশির ভাগই ছিলেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।
মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক শুধুমাত্র বহুমাত্রিক। এ অঞ্চলে ভারতকে মোকাবিলায় বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক ভূরাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমার চীনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন ২০১৩ সাল থেকে গ্যাস নিচ্ছে। রাখাইন থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে তেল সরবরাহ শুরু হয় ২০১৪ সালে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে এবং ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে চীনের প্রেসিডেন্ট মিয়ানমার সফরে গিয়ে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোর চুক্তি করেন। এর মাধ্যমে চীন রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু গতবছরে মিয়ানমারের জনগণ বিক্ষোভ করে চীনের বিরুদ্ধে যে মিয়ানমারের জান্তা সরকারকেকে সাহায্য না করতে।
সামরিক শাসনের কারণে দেশটির ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশটির সর্বসাধারণের সশস্ত্র বিরোধিতার কারণেই ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে চীন। চীন সরে গেলেও বর্তমান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে থ্রি ব্রাদাহুড এ্যালায়েন্স যে বিদ্রোহ করেছে তাদেরকে সমর্থন দিয়েছে ।
এই থ্রি ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে যারা আছেন তারাও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একসময়। ফলে ঘুরেফিরে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা থাকছেনই।