ঢাকা , বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং পরাজিত প্রার্থীরা কী করেন নির্বাচনের পর

মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং পরাজিত প্রার্থীর জীবনে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। এই অধ্যায়টা কারও হয় স্বপ্নপূরণ করে, কারওটা হয় স্বপ্নভাঙার বেদনা দিয়ে। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের জীবন বেশ বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে লেখালেখি, মানবাধিকার কাজ, জনহিতকর কাজ, বক্তৃতা এবং প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক অবদান রেখে চলেন। ঠিক একাই ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা। এই ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমেই তারা নিজেকে সক্রিয় রাখেন এবং একটি সম্মানজনক সামাজিক জীবনযাপন করেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- শামস্ বিশ্বাস

বই লেখা এবং প্রকাশনা

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে দায়িত্ব পালন শেষে বই লেখা একটি সাধারণ প্রবণতা। এই বইগুলোতে তাদের জীবন, অভিজ্ঞতা এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরেন। এই ধরনের বইগুলোর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টরা একদিকে তাদের ব্যক্তিগত মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, অন্যদিকে সমাজের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখেন।

বক্তৃতা ও পরামর্শদান কার্যক্রম

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টরা প্রায়ই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন বিশ্বব্যাপী সম্মেলন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই বক্তৃতাগুলোর মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ইস্যুগুলোর ওপর তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। এ ছাড়া তাদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে অনেক সাবেক প্রেসিডেন্ট করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।

জনহিতকর কাজ এবং দাতব্য সংস্থা গঠন

অনেক সাবেক প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর জনহিতকর কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। এমনকি পরাজিত প্রার্থীরাও। উদাহরণস্বরূপ, বিল ক্লিনটন Clinton Foundation গঠন করেন, যা জনস্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে যাচ্ছে। জিমি কার্টার তার Carter Center প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা, শান্তি এবং মানবাধিকার উন্নয়নে কাজ করে। ২০০০ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশের কাছে পরাজিত আল গোর The Climate Reality Project প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরিবেশের সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই ধরনের কাজের মাধ্যমে তারা মানুষের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন।

অবসর এবং পরিবারে সময় ব্যয়

কিছু সাবেক প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে জীবনযাপন করেন এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। তারা নিজেদের শখ, যেমন গল্ফ খেলা, চিত্রকলা কিংবা লেখালেখির মাধ্যমে সময় কাটান।

মার্কিন প্রেসিডেন্টরা দায়িত্ব শেষে সমাজে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন পথে এগিয়ে যান, যা তাদের জনপ্রিয়তা এবং সম্মানকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তাদের এই পরবর্তী কর্মজীবন একটি উদাহরণ হয়ে থাকে যে কীভাবে ক্ষমতা ছাড়াও একজন নেতা সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন।

জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৮৯-১৭৯৭)

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন দায়িত্ব ছাড়ার পর ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে গিয়েছিলেন। ভার্জিনিয়ায় তার নিজস্ব কৃষি খামারে ফিরে গিয়ে তিনি একটি শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন শুরু করেন। তবে তিনি জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ের জন্য সরকারের পরামর্শক হিসেবে থেকেছেন।

থমাস জেফারসন (১৮০১-১৮০৯)

থমাস জেফারসন তার প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর University of Virginia প্রতিষ্ঠা করেন, যা তার শিক্ষা ও সমাজের প্রতি অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে। তিনি শিক্ষাকে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার বাকি জীবন গবেষণা ও লেখালেখির মধ্যে কাটে।

ইউলিসিস এস. গ্রান্ট (১৮৬৯-১৮৭৭)

গৃহযুদ্ধের সময়ের এই সাহসী জেনারেল দায়িত্ব শেষে আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হন। তবে তিনি তার Personal Memoirs of Ulysses S. Grant বইটি লিখে অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এটি আজও মার্কিন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। মৃত্যুর আগে তার এই লেখাটি মার্কিন সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নেয়।

জিমি কার্টার (১৯৭৭-১৯৮১)

জিমি কার্টার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তিনি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর Carter Center প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবাধিকার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। কার্টার নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছেন তার এই অবদানের জন্য। তিনি আজও সমাজসেবামূলক কাজে নিবেদিত রয়েছেন।

রোনাল্ড রিগান (১৯৮১-১৯৮৯)

রোনাল্ড রিগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং তার শাসনামলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হন।

রোনাল্ড রিগান প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর রোনাল্ড রিগান প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে কিছুদিন পরই তিনি আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হন। এরপর তার বাকি জীবন এই রোগের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজে নিয়োজিত থেকে কাটান।

জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (১৯৮৯-১৯৯৩)

জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ তার অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলা করেন, বিশেষ করে উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাককে পরাজিত করেন। দায়িত্ব শেষে তিনি জনহিতকর কাজ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণকার্য পরিচালনায় মনোযোগী হন। তিনি ক্লিনটনের সঙ্গে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে যুক্ত হয়ে বন্ধুত্বের উদাহরণ হয়েছেন।

বিল ক্লিনটন (১৯৯৩-২০০১)

বিল ক্লিনটন দায়িত্ব শেষে Clinton Foundation প্রতিষ্ঠা করেন, যা জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ সুরক্ষা এবং শিক্ষা উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিতে যান এবং আন্তর্জাতিকভাবে জনসেবামূলক কার্যক্রমে অবদান রেখে চলেছেন। ক্লিনটনের এই ফাউন্ডেশন নানা জনহিতকর কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং আন্তর্জাতিক সেবামূলক কাজে তাকে সম্পৃক্ত রেখেছে।

জর্জ ডব্লিউ বুশ (২০০১-২০০৯)

জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা এবং আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধের সূচনা হয়। প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর Bush Institute প্রতিষ্ঠা করেন, যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং নেতৃত্ব বিকাশে কাজ করছে। এ ছাড়া তিনি চিত্রকলা ও মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছেন।

বারাক ওবামা (২০০৯-২০১৭)

Affordable Care Act পাস হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। দায়িত্ব শেষে তিনি Obama Foundation প্রতিষ্ঠা করেন, যা তরুণ নেতৃত্ব এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উন্নয়নে কাজ করছে। তিনি মিশেল ওবামার সঙ্গে লেখালেখি এবং বক্তৃতামূলক কার্যক্রমেও জড়িত আছেন। বারাক ওবামা তার ‘A Promised Land’ বইয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন।

আল গোর (২০০০ নির্বাচন)

আল গোর ২০০০ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশের কাছে পরাজিত হন, তবে তিনি রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন। নির্বাচনের পর তিনি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং ২০০৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। তার প্রচেষ্টা ও নেতৃত্বে জলবায়ু পরিবর্তন সচেতনতা প্রচারে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। তিনি ক্লাইমেট রিয়ালিটি প্রজেক্ট প্রতিষ্ঠা করেন।

জোন কেরি (২০০৪ নির্বাচন)

২০০৪ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশের কাছে পরাজিত হন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোন কেরি। পরাজয়ের পর তিনি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার চালিয়ে যান। ২০১৩ সালে কেরি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রচেষ্টার অংশ ছিলেন। পরাজয়ের পর তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

হিলারি ক্লিনটন (২০১৬ নির্বাচন)

২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হন। তবে তিনি রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকে যান। নির্বাচনের পর তিনি গঠনমূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন। ২০১৭ সালে তিনি ‘What Happened’ বইটি প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি ২০১৬ সালের নির্বাচনে তার পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন।

মিট রমনির (২০১২ নির্বাচন)

২০১২ সালের নির্বাচনে মিট রমনির পরাজয়ের পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তবে তার অধিকাংশ সময় ব্যবসা এবং জনসেবায় কাটিয়েছেন। রমনির Bain Capital-এ ফিরে যান, যা একটি প্রাইভেট ইকুইটি ফার্ম। তিনি কিছু সময়ের জন্য মৌলিক শাসন কাঠামো নিয়ে কাজ করতে থাকেন এবং রাজনীতি থেকে সরে আসেন।

জেরি ফোর্ড (১৯৭৬ নির্বাচন)

জেরি ফোর্ড ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হন, তবে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেননি। তিনি পরবর্তী সময়ে Ford Foundation প্রতিষ্ঠা করেন, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সমাজের অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের জন্য পরিচিত। তিনি অনেক আন্তর্জাতিক দাতব্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে তার মতামত প্রদান করেছেন।

আব্রাহাম লিংকন (১৮৬০ নির্বাচন)

আব্রাহাম লিংকন ১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতলেও ১৮৫৮ সালে স্টিফেন ডগলাসের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন, যা তাকে ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ এবং মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করেছিল। পরাজিত হওয়ার পর লিংকন দক্ষিণের দাসপ্রথা বন্ধ করতে এবং সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে থাকেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভা, অভিজ্ঞতা এবং নেতৃত্বের ক্ষমতা ব্যবহার করেন। তারা প্রাচুর্যপূর্ণ দাতব্য কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শিক্ষার প্রসার এবং জনস্বার্থে কাজ করে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকেন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং পরাজিত প্রার্থীরা কী করেন নির্বাচনের পর

আপডেট টাইম : ০৪:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং পরাজিত প্রার্থীর জীবনে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। এই অধ্যায়টা কারও হয় স্বপ্নপূরণ করে, কারওটা হয় স্বপ্নভাঙার বেদনা দিয়ে। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের জীবন বেশ বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে লেখালেখি, মানবাধিকার কাজ, জনহিতকর কাজ, বক্তৃতা এবং প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক অবদান রেখে চলেন। ঠিক একাই ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা। এই ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমেই তারা নিজেকে সক্রিয় রাখেন এবং একটি সম্মানজনক সামাজিক জীবনযাপন করেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- শামস্ বিশ্বাস

বই লেখা এবং প্রকাশনা

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে দায়িত্ব পালন শেষে বই লেখা একটি সাধারণ প্রবণতা। এই বইগুলোতে তাদের জীবন, অভিজ্ঞতা এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরেন। এই ধরনের বইগুলোর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টরা একদিকে তাদের ব্যক্তিগত মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, অন্যদিকে সমাজের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখেন।

বক্তৃতা ও পরামর্শদান কার্যক্রম

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টরা প্রায়ই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন বিশ্বব্যাপী সম্মেলন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই বক্তৃতাগুলোর মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ইস্যুগুলোর ওপর তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। এ ছাড়া তাদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে অনেক সাবেক প্রেসিডেন্ট করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।

জনহিতকর কাজ এবং দাতব্য সংস্থা গঠন

অনেক সাবেক প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর জনহিতকর কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। এমনকি পরাজিত প্রার্থীরাও। উদাহরণস্বরূপ, বিল ক্লিনটন Clinton Foundation গঠন করেন, যা জনস্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে যাচ্ছে। জিমি কার্টার তার Carter Center প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা, শান্তি এবং মানবাধিকার উন্নয়নে কাজ করে। ২০০০ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশের কাছে পরাজিত আল গোর The Climate Reality Project প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরিবেশের সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই ধরনের কাজের মাধ্যমে তারা মানুষের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন।

অবসর এবং পরিবারে সময় ব্যয়

কিছু সাবেক প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে জীবনযাপন করেন এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। তারা নিজেদের শখ, যেমন গল্ফ খেলা, চিত্রকলা কিংবা লেখালেখির মাধ্যমে সময় কাটান।

মার্কিন প্রেসিডেন্টরা দায়িত্ব শেষে সমাজে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন পথে এগিয়ে যান, যা তাদের জনপ্রিয়তা এবং সম্মানকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তাদের এই পরবর্তী কর্মজীবন একটি উদাহরণ হয়ে থাকে যে কীভাবে ক্ষমতা ছাড়াও একজন নেতা সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন।

জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৮৯-১৭৯৭)

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন দায়িত্ব ছাড়ার পর ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে গিয়েছিলেন। ভার্জিনিয়ায় তার নিজস্ব কৃষি খামারে ফিরে গিয়ে তিনি একটি শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন শুরু করেন। তবে তিনি জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ের জন্য সরকারের পরামর্শক হিসেবে থেকেছেন।

থমাস জেফারসন (১৮০১-১৮০৯)

থমাস জেফারসন তার প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর University of Virginia প্রতিষ্ঠা করেন, যা তার শিক্ষা ও সমাজের প্রতি অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে। তিনি শিক্ষাকে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার বাকি জীবন গবেষণা ও লেখালেখির মধ্যে কাটে।

ইউলিসিস এস. গ্রান্ট (১৮৬৯-১৮৭৭)

গৃহযুদ্ধের সময়ের এই সাহসী জেনারেল দায়িত্ব শেষে আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হন। তবে তিনি তার Personal Memoirs of Ulysses S. Grant বইটি লিখে অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এটি আজও মার্কিন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। মৃত্যুর আগে তার এই লেখাটি মার্কিন সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নেয়।

জিমি কার্টার (১৯৭৭-১৯৮১)

জিমি কার্টার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তিনি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর Carter Center প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবাধিকার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। কার্টার নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছেন তার এই অবদানের জন্য। তিনি আজও সমাজসেবামূলক কাজে নিবেদিত রয়েছেন।

রোনাল্ড রিগান (১৯৮১-১৯৮৯)

রোনাল্ড রিগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং তার শাসনামলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হন।

রোনাল্ড রিগান প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর রোনাল্ড রিগান প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে কিছুদিন পরই তিনি আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হন। এরপর তার বাকি জীবন এই রোগের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজে নিয়োজিত থেকে কাটান।

জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (১৯৮৯-১৯৯৩)

জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ তার অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলা করেন, বিশেষ করে উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাককে পরাজিত করেন। দায়িত্ব শেষে তিনি জনহিতকর কাজ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণকার্য পরিচালনায় মনোযোগী হন। তিনি ক্লিনটনের সঙ্গে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে যুক্ত হয়ে বন্ধুত্বের উদাহরণ হয়েছেন।

বিল ক্লিনটন (১৯৯৩-২০০১)

বিল ক্লিনটন দায়িত্ব শেষে Clinton Foundation প্রতিষ্ঠা করেন, যা জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ সুরক্ষা এবং শিক্ষা উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিতে যান এবং আন্তর্জাতিকভাবে জনসেবামূলক কার্যক্রমে অবদান রেখে চলেছেন। ক্লিনটনের এই ফাউন্ডেশন নানা জনহিতকর কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং আন্তর্জাতিক সেবামূলক কাজে তাকে সম্পৃক্ত রেখেছে।

জর্জ ডব্লিউ বুশ (২০০১-২০০৯)

জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা এবং আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধের সূচনা হয়। প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর Bush Institute প্রতিষ্ঠা করেন, যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং নেতৃত্ব বিকাশে কাজ করছে। এ ছাড়া তিনি চিত্রকলা ও মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছেন।

বারাক ওবামা (২০০৯-২০১৭)

Affordable Care Act পাস হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। দায়িত্ব শেষে তিনি Obama Foundation প্রতিষ্ঠা করেন, যা তরুণ নেতৃত্ব এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উন্নয়নে কাজ করছে। তিনি মিশেল ওবামার সঙ্গে লেখালেখি এবং বক্তৃতামূলক কার্যক্রমেও জড়িত আছেন। বারাক ওবামা তার ‘A Promised Land’ বইয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন।

আল গোর (২০০০ নির্বাচন)

আল গোর ২০০০ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশের কাছে পরাজিত হন, তবে তিনি রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন। নির্বাচনের পর তিনি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং ২০০৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। তার প্রচেষ্টা ও নেতৃত্বে জলবায়ু পরিবর্তন সচেতনতা প্রচারে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। তিনি ক্লাইমেট রিয়ালিটি প্রজেক্ট প্রতিষ্ঠা করেন।

জোন কেরি (২০০৪ নির্বাচন)

২০০৪ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশের কাছে পরাজিত হন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোন কেরি। পরাজয়ের পর তিনি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার চালিয়ে যান। ২০১৩ সালে কেরি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রচেষ্টার অংশ ছিলেন। পরাজয়ের পর তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

হিলারি ক্লিনটন (২০১৬ নির্বাচন)

২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হন। তবে তিনি রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকে যান। নির্বাচনের পর তিনি গঠনমূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন। ২০১৭ সালে তিনি ‘What Happened’ বইটি প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি ২০১৬ সালের নির্বাচনে তার পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন।

মিট রমনির (২০১২ নির্বাচন)

২০১২ সালের নির্বাচনে মিট রমনির পরাজয়ের পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তবে তার অধিকাংশ সময় ব্যবসা এবং জনসেবায় কাটিয়েছেন। রমনির Bain Capital-এ ফিরে যান, যা একটি প্রাইভেট ইকুইটি ফার্ম। তিনি কিছু সময়ের জন্য মৌলিক শাসন কাঠামো নিয়ে কাজ করতে থাকেন এবং রাজনীতি থেকে সরে আসেন।

জেরি ফোর্ড (১৯৭৬ নির্বাচন)

জেরি ফোর্ড ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হন, তবে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেননি। তিনি পরবর্তী সময়ে Ford Foundation প্রতিষ্ঠা করেন, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সমাজের অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের জন্য পরিচিত। তিনি অনেক আন্তর্জাতিক দাতব্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে তার মতামত প্রদান করেছেন।

আব্রাহাম লিংকন (১৮৬০ নির্বাচন)

আব্রাহাম লিংকন ১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতলেও ১৮৫৮ সালে স্টিফেন ডগলাসের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন, যা তাকে ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ এবং মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করেছিল। পরাজিত হওয়ার পর লিংকন দক্ষিণের দাসপ্রথা বন্ধ করতে এবং সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে থাকেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভা, অভিজ্ঞতা এবং নেতৃত্বের ক্ষমতা ব্যবহার করেন। তারা প্রাচুর্যপূর্ণ দাতব্য কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শিক্ষার প্রসার এবং জনস্বার্থে কাজ করে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকেন।