ঢাকা , রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্রিক কবি সাফো, পরমাসুন্দরী আত্তিস ও পাতি-মাছরাঙা

প্রাচীন গ্রিসের অতি বড় এক কবির নাম ‘সাফো’। তিনি লেসবো দ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন। আজ থেকে ছাব্বিশ শত বছর আগের কথা। লেসবো সেদিনের বিশ্বে জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্য চর্চার তুঙ্গে ছিল। লেসবোর শিল্পকর্ম, মদ ও অন্যান্য পণ্য ‘লেসবিয়ান সামগ্রী’ নামে গ্রিসের সর্বত্র সমাদৃত ছিল। এই খ্যাতির সঙ্গে সাফোর কাব্য প্রতিভা যুক্ত হয়ে লেসবো দ্বীপ মর্যাদার শীর্ষে আরোহণ করেছিল।
প্লেটো বলেছিলেন, জগতের সেরা কবির সংখ্যা ‘নয়’ বলা ঠিক নয়, কারণ দশম জন সাফো। সাফো উদ্ভাবিত সরল ও হ্রস্ব কবিতার স্তবক অনেক কবি অনুকরণ করেছেন। সেসব কবিতাকে বলা হয় ‘সাফো-স্তবক’। কবি হিসেবে সাফোর প্রভাব হাজার হাজার বছর পরেও ম্লান হয়নি। উনিশ শতকের শক্তিমান কবি বায়রন, শেলি ও টেনিসন তার কবিতা অনুবাদ করেছেন।
অনেকেই বলেন, সাফো ছিলেন সে কালের সেরা নারী কবি। গ্রিসের প্রাগ্রসর দ্বীপ আর কবি সাফোর উজ্জ্বল সেই দিন নিয়ে বায়রন যে কবিতা লিখেছেন তার একটি অংশের বাংলা অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত হলো।

গ্রিসের সে দ্বীপ, গ্রিসের সে দ্বীপপুঞ্জ!
যেথায় প্রোজ্জ্বল সাফোর প্রেম ও গান,
যেখানে শানিত সংঘাত ও শান্তি-কুঞ্জ
যেথায় ঢেলস এবং ফিবাসের উত্থান,
সূর্যকিরণে যা ছিল সোনারং-এ রঞ্জিত
সেই সূর্যটি ছাড়া আজ সবই অস্তÍমিত।

সাফো নিঃসন্দেহে সুন্দরী ছিলেন। তার সৌন্দর্যের মোহনীয় দিক নিয়ে সমসাময়িক কবি ‘আলসাউজ’ লিখেছেন, বেগুনি চুল, নির্মল চেহারা ও মধুর হাসি। নিজের সৌন্দর্য যা-ই থাক, সাফো ছিলেন সৌন্দর্যের পূজারি। সুদর্শন পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রতি সাফোর গভীর প্রেমই তার কাব্যের মূল উপজীব্য। লেসবো রাজ্যের বর্ষপূর্তি উৎসবে নারী সঙ্গীদের নিয়ে সাফো স্বরচিত গান পরিবেশন করতেন। সে পরিবেশনাকে আলসাউজ তার কাব্যে ‘স্বর্গীয়’ বলে মহিমান্বিত করেছেন।
সাফোর একজন প্রণয়িনী ছিলেন পরমাসুন্দরী আত্তিস। তিনিও লেসবোর বাসিন্দা। সাফোর কাব্য ছাড়া কবি প্রিয়া আত্তিস সম্বন্ধে বেশি কিছু জানা যায় না। জানাটা তেমন জরুরিও নয়। তার জন্য সাফোর প্রেম যে অমর কাব্যের জন্ম দিয়েছে, সেটা তো আমরা জানি। আদি নারী প্রণয়িনী জুটি হিসেবে সাফো ও আত্তিস বিশ্বে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
কবি প্রিয়া আত্তিসের নামে বাংলাদেশে একটি পাখি আছে। ‘পাতি-মাছরাঙা’ নামে আমরা একে চিনি। এ দেশের সব গ্রামেই একে পাওয়া যায়। খানা-ডোবা, নীদ-নালা, ঝিরি-ঝরনা, হাওর-বাঁওড়, উপকূল, উপবন সর্বত্রই পাখিটি চোখে পড়ে। আমাদের দেশের বারো প্রজাতির মাছরাঙার মধ্যে এ পাখিটিই সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে রয়েছে।
সাফো হয়তো কোনোদিন পাতি-মাছরাঙা দেখেননি। দেখলেও একে আত্তিসতুল্য আকর্ষণীয় বলে মনে করেননি। তা মনে করলে তো এ পাখি নিয়ে তার দু-চারটি অবিস্মরণীয় স্তবক আমরা পেতাম। পাতি-মাছরাঙাকে সাফো তার প্রিয়তমা আত্তিসের সঙ্গে তুলনা না করলেও আঠারো শতকের একজন রসিক বিজ্ঞানী তা করেছেন। তার নাম ক্যারোলাস লিনিয়াস।
আঠারো শতকের কথা। সুইডেনের বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস বিশ্বের সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর ল্যাটিন নাম দিতে শুরু করলেন। প্রতিটি উদ্ভিদ অথবা প্রাণীর নানা ভাষায় নানা নাম থাকে। এক দেশের নাম অন্য দেশের মানুষ বোঝে না। তাই তিনি এই আন্তর্জাতিক নামের উদ্ভাবন করেছিলেন। তার উদ্ভাবিত নাম ও নামকরণের প্রক্রিয়াই বিশ্বের সর্বত্র ব্যবহৃত হয়।
ক্যারোলাস লিনিয়াস পাতি-মাছরাঙার আন্তর্জাতিক নাম রেখেছেন ‘অলসেডো আত্তিস’। এই গ্রিক নামটির অর্থ ‘মাছরাঙা আত্তিস’। আত্তিসের রূপ-যৌবন লেসবোর মাটিতে মিশে গেছে আড়ই হাজার বছর আগে। তুচ্ছ পাতি-মাছরাঙা আজও টিকে আছে। এই খুদে পাখিটিই এখন আত্তিসের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
পাতি-মাছরাঙ্গা ছোট্ট একটি পাখি। চড়–ইয়ের চেয়ে কিছুটা বড়। ওজন পঁচিশ গ্রামের বেশি নয়। কিন্তু টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা এর। ইউরোপ, আফ্রিকা আর এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এর বিচরণ। আমাদের দেশে অনেক প্রতিকূল পরিবেশেও পাখিটি টিকে রয়েছে। দু-একটি ব্যাঙাচি, পোনামাছ, মলা কিংবা ঢেলা শিকার করতে পারলেই এর দিন চলে যায়।
একাধিক মহাদেশে বসবাস করে বলে পাতি-মাছরাঙার চেহারা ও কণ্ঠস্বর সর্বত্র হুবহু এক নয়। ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের এবং আন্দামান ও বেগনভিলা দ্বীপের পাতি-মাছরাঙার মধ্যে ছোট ছোট পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যের ভিত্তিতে পাতি-মাছরাঙাকে সাতটি উপপ্রজাতিতে ভাগ করা হয়েছে।
পাতি-মাছরাঙার একটি উপপ্রজাতি বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচিন, চীন, রাশিয়া ও জাপানে বাস করে। এই উপপ্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম ‘অলসেডো আত্তিস বেঙ্গালেনসিস’। এই নামের কারণে পাখিপ্রেমীদের মাঝে এ পাখি একই সঙ্গে সুন্দরী আত্তিস, কবি সাফো ও শ্যামলী বাংলাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে পাতি-মাছরাঙার পোশাকের অনেক মিল আছে। পুচ্ছের নীল রঙ ছাড়া এর পুরো পিঠ সবুজ আর পুরো পেট লাল। ক্ষুদ্র দুইটি পা প্রবাল-লাল। প্রজননকালে পাতি-মাছরাঙাদের রঙ উজ্জ্বলতর হয়। মলিন পালক ছেড়ে এরা সে সময় প্রগাঢ়, নিখাদ রঙের নতুন পোশাকে সাজতে ভালোবাসে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

গ্রিক কবি সাফো, পরমাসুন্দরী আত্তিস ও পাতি-মাছরাঙা

আপডেট টাইম : ০৫:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ জুন ২০১৭

প্রাচীন গ্রিসের অতি বড় এক কবির নাম ‘সাফো’। তিনি লেসবো দ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন। আজ থেকে ছাব্বিশ শত বছর আগের কথা। লেসবো সেদিনের বিশ্বে জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্য চর্চার তুঙ্গে ছিল। লেসবোর শিল্পকর্ম, মদ ও অন্যান্য পণ্য ‘লেসবিয়ান সামগ্রী’ নামে গ্রিসের সর্বত্র সমাদৃত ছিল। এই খ্যাতির সঙ্গে সাফোর কাব্য প্রতিভা যুক্ত হয়ে লেসবো দ্বীপ মর্যাদার শীর্ষে আরোহণ করেছিল।
প্লেটো বলেছিলেন, জগতের সেরা কবির সংখ্যা ‘নয়’ বলা ঠিক নয়, কারণ দশম জন সাফো। সাফো উদ্ভাবিত সরল ও হ্রস্ব কবিতার স্তবক অনেক কবি অনুকরণ করেছেন। সেসব কবিতাকে বলা হয় ‘সাফো-স্তবক’। কবি হিসেবে সাফোর প্রভাব হাজার হাজার বছর পরেও ম্লান হয়নি। উনিশ শতকের শক্তিমান কবি বায়রন, শেলি ও টেনিসন তার কবিতা অনুবাদ করেছেন।
অনেকেই বলেন, সাফো ছিলেন সে কালের সেরা নারী কবি। গ্রিসের প্রাগ্রসর দ্বীপ আর কবি সাফোর উজ্জ্বল সেই দিন নিয়ে বায়রন যে কবিতা লিখেছেন তার একটি অংশের বাংলা অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত হলো।

গ্রিসের সে দ্বীপ, গ্রিসের সে দ্বীপপুঞ্জ!
যেথায় প্রোজ্জ্বল সাফোর প্রেম ও গান,
যেখানে শানিত সংঘাত ও শান্তি-কুঞ্জ
যেথায় ঢেলস এবং ফিবাসের উত্থান,
সূর্যকিরণে যা ছিল সোনারং-এ রঞ্জিত
সেই সূর্যটি ছাড়া আজ সবই অস্তÍমিত।

সাফো নিঃসন্দেহে সুন্দরী ছিলেন। তার সৌন্দর্যের মোহনীয় দিক নিয়ে সমসাময়িক কবি ‘আলসাউজ’ লিখেছেন, বেগুনি চুল, নির্মল চেহারা ও মধুর হাসি। নিজের সৌন্দর্য যা-ই থাক, সাফো ছিলেন সৌন্দর্যের পূজারি। সুদর্শন পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রতি সাফোর গভীর প্রেমই তার কাব্যের মূল উপজীব্য। লেসবো রাজ্যের বর্ষপূর্তি উৎসবে নারী সঙ্গীদের নিয়ে সাফো স্বরচিত গান পরিবেশন করতেন। সে পরিবেশনাকে আলসাউজ তার কাব্যে ‘স্বর্গীয়’ বলে মহিমান্বিত করেছেন।
সাফোর একজন প্রণয়িনী ছিলেন পরমাসুন্দরী আত্তিস। তিনিও লেসবোর বাসিন্দা। সাফোর কাব্য ছাড়া কবি প্রিয়া আত্তিস সম্বন্ধে বেশি কিছু জানা যায় না। জানাটা তেমন জরুরিও নয়। তার জন্য সাফোর প্রেম যে অমর কাব্যের জন্ম দিয়েছে, সেটা তো আমরা জানি। আদি নারী প্রণয়িনী জুটি হিসেবে সাফো ও আত্তিস বিশ্বে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
কবি প্রিয়া আত্তিসের নামে বাংলাদেশে একটি পাখি আছে। ‘পাতি-মাছরাঙা’ নামে আমরা একে চিনি। এ দেশের সব গ্রামেই একে পাওয়া যায়। খানা-ডোবা, নীদ-নালা, ঝিরি-ঝরনা, হাওর-বাঁওড়, উপকূল, উপবন সর্বত্রই পাখিটি চোখে পড়ে। আমাদের দেশের বারো প্রজাতির মাছরাঙার মধ্যে এ পাখিটিই সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে রয়েছে।
সাফো হয়তো কোনোদিন পাতি-মাছরাঙা দেখেননি। দেখলেও একে আত্তিসতুল্য আকর্ষণীয় বলে মনে করেননি। তা মনে করলে তো এ পাখি নিয়ে তার দু-চারটি অবিস্মরণীয় স্তবক আমরা পেতাম। পাতি-মাছরাঙাকে সাফো তার প্রিয়তমা আত্তিসের সঙ্গে তুলনা না করলেও আঠারো শতকের একজন রসিক বিজ্ঞানী তা করেছেন। তার নাম ক্যারোলাস লিনিয়াস।
আঠারো শতকের কথা। সুইডেনের বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস বিশ্বের সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর ল্যাটিন নাম দিতে শুরু করলেন। প্রতিটি উদ্ভিদ অথবা প্রাণীর নানা ভাষায় নানা নাম থাকে। এক দেশের নাম অন্য দেশের মানুষ বোঝে না। তাই তিনি এই আন্তর্জাতিক নামের উদ্ভাবন করেছিলেন। তার উদ্ভাবিত নাম ও নামকরণের প্রক্রিয়াই বিশ্বের সর্বত্র ব্যবহৃত হয়।
ক্যারোলাস লিনিয়াস পাতি-মাছরাঙার আন্তর্জাতিক নাম রেখেছেন ‘অলসেডো আত্তিস’। এই গ্রিক নামটির অর্থ ‘মাছরাঙা আত্তিস’। আত্তিসের রূপ-যৌবন লেসবোর মাটিতে মিশে গেছে আড়ই হাজার বছর আগে। তুচ্ছ পাতি-মাছরাঙা আজও টিকে আছে। এই খুদে পাখিটিই এখন আত্তিসের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
পাতি-মাছরাঙ্গা ছোট্ট একটি পাখি। চড়–ইয়ের চেয়ে কিছুটা বড়। ওজন পঁচিশ গ্রামের বেশি নয়। কিন্তু টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা এর। ইউরোপ, আফ্রিকা আর এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এর বিচরণ। আমাদের দেশে অনেক প্রতিকূল পরিবেশেও পাখিটি টিকে রয়েছে। দু-একটি ব্যাঙাচি, পোনামাছ, মলা কিংবা ঢেলা শিকার করতে পারলেই এর দিন চলে যায়।
একাধিক মহাদেশে বসবাস করে বলে পাতি-মাছরাঙার চেহারা ও কণ্ঠস্বর সর্বত্র হুবহু এক নয়। ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের এবং আন্দামান ও বেগনভিলা দ্বীপের পাতি-মাছরাঙার মধ্যে ছোট ছোট পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যের ভিত্তিতে পাতি-মাছরাঙাকে সাতটি উপপ্রজাতিতে ভাগ করা হয়েছে।
পাতি-মাছরাঙার একটি উপপ্রজাতি বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচিন, চীন, রাশিয়া ও জাপানে বাস করে। এই উপপ্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম ‘অলসেডো আত্তিস বেঙ্গালেনসিস’। এই নামের কারণে পাখিপ্রেমীদের মাঝে এ পাখি একই সঙ্গে সুন্দরী আত্তিস, কবি সাফো ও শ্যামলী বাংলাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে পাতি-মাছরাঙার পোশাকের অনেক মিল আছে। পুচ্ছের নীল রঙ ছাড়া এর পুরো পিঠ সবুজ আর পুরো পেট লাল। ক্ষুদ্র দুইটি পা প্রবাল-লাল। প্রজননকালে পাতি-মাছরাঙাদের রঙ উজ্জ্বলতর হয়। মলিন পালক ছেড়ে এরা সে সময় প্রগাঢ়, নিখাদ রঙের নতুন পোশাকে সাজতে ভালোবাসে।