বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রাস্তার ধুলাবালিতে সারাদিন কাটে। একেকটা গাড়ি আসে, চোখমুখ সব বালুতে ভরিয়ে দিয়ে যা। তবুও কি আর করা। এটিই যে কর্ম। এটিই যে জীবিকা। একদিন না এলে কি আর পেট চলবে। মানুষের হাত দেখে যা পাই তা দিয়ে কোনরকম দিন চলে যায়’-কথাগুলো বিমর্ষ মুখে বলছিলেন মনসুর আলী।
নিজের ভাগ্য বদলাতে চল্লিশ বছর আগে নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা থেকে রাজধানীতে এসেছিলেন তিনি। অথচ তা আর হলো না। নিজের ভাগ্য বদলানোর পরিবর্তে শুরু করেন মানুষের ভাগ্য নিয়ে কাজ।
ভোরের আলো ফুটতেই টিয়া পাখি নিয়ে বসে পড়েন তিনি গুলিস্তানে। শুরু করেন মানুষের রাশিফল গণনার কাজ। বাঙালী কণ্ঠর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, রাশিফল হচ্ছে ভালো মন্দ জানা, মনের শান্তি। এছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন ভাগ্য হাতেই থাকে। এটি ভুল ধারণা। ভাগ্য থাকে মানুষের কর্মে।
লেখাপড়া কতদূর জানতে চাইলে মাথা চুলকে তিনি বলেন, বেশিদূর না। এই একটু আধতু। কোন রকম বাংলা পড়তে পারি। লেখাপড়া জানলে কি আর ফুটপাতে বসে জীবনের চল্লিশটি বছর পার করতাম?
আয়-রোজগার এখন আর আগেরমত হয়না মনসুরের।
বললেন, আগের মত আয় নাই। মানুষ তেমন একটা আসে না। কোনদিন ইনকাম হয় দু’শ। আবার কোনদিন বা তিন’শ। কখনো কখনো তো বসতেই পারি না। এপথ দিয়ে ভিআইপি গেলেই, উঠিয়ে দেয়।
তবে বিয়ের পাত্র-পাত্রীর ভাগ্য দেখে মাঝে মধ্যে মোটা বকশিশ পান তিনি। বলেন, বিয়ের আগে ভাগ্য দেখার জন্য কেউ ডেকে নিয়ে গেলে ভালো টাকা পাই।
কোন ধরণের লোক হাত দেখাতে বেশি আসেন, জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের হতাশাগ্রস্ত মানুষরা্ই বেশি আসে। কারণ তারা ভাবেন টিয়া পাখিই বোধহয় সব বলে দিতে পারে। আর গণক যা বলবেন, তা মিথ্যে হতেই পারেনা।
হাত দেখে মানুষের কাছ থেকে খুব বেশি টাকা পান না মনসুর।
বললেন, ১০/২০ টাকার বেশি কেউ দিতে চায়না। কিপটামি করে। কেউ বুঝতেই চায়না এটি করে আমার পেট চলে। মানুষগুলো কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে।
নিমিষেই অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারা এমন আরেকজন মানুষ হচ্ছেন জামালপুর সরিষাবাড়ীর আতিকুর রহমান।
তিনি বলেন, এটি বিনোদন ছাড়া কিচ্ছু না। ভাগ্য থাকলে নিজেরাই তো এতোদিনে বড়লোক হয়ে যেতাম। মানুষ কত বোকা দেখেন, আমার এই শাস্ত্রের ওপর দখল নেই। বই-পুস্তক দেখে যা পারি বলে দেই, তাতেই মানুষ মহাখুশি।
রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে ত্রিশ বছর ধরে মানুষের হাত দেখেন মিজানুর রহমান। সেখানে গেলেই চোখে পড়বে, গাছের দু’পাশে দুটি ব্যানার টানানো।
ব্যানারের একপাশে লেখা আছে, ‘এখানে হাত দেখে গ্রহের সম্মন্দে বলা হয়। গ্রহ খারাপ হইলে-দাম্পত্য জীবনে কলহ ফ্যাসাদ হয়, জমা-জমি ব্যাপারে মামলা মকদ্যমা হয়, কর্মে বাধা, অর্থ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, মানুসিক অশান্তি বৃদ্ধি পায়।’ অপর পাশে লেখা ‘গ্রহ পক্ষ থাকলে কর্মে সুফল পাওয়া যায়। কর্ম মানে ভাগ্য। কু-চিন্তা থেকে সু-চিন্তা আনয়ন করে। অর্থ যস বৃদ্ধি করে, বিপদ হইতে মুক্ত রাখে।’
মিজানুর রহমানের সঙ্গে আপালকালে জানা যায়, জ্যোতিষ শাস্ত্রে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তবুও মানুষের হাত দেখেন তিনি। হাত দেখার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পথের ধারে বসে থাকেন। ধুলাবলিতে ছেয়ে যায় সমস্ত শরীর। ধুলোমাখা শরীর নিয়েই রাতে ফিরেন বাসায়।
সারাদিন বেশি টাকা উপার্জন করতে পারেন না তিনি। ২শ থেকে ৩শ টাকাই সাধারণ হয় বেশি। আবার কোনদিন আয় ১ থেকে দেড়’শ টাকাও হয় না।
চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিজানুর বাঙালী কণ্ঠ কে বললেন, প্রতিদিন কত মানুষই আসে জীবনের সমস্যা নিয়ে। অথচ আমার সমস্যা নিয়ে কারো কাছে যেতে পারিনা। এটাও জীবন। কেউ ভুলেও জিজ্ঞাসা করেনা কিভাবে চলে আমার জীবনসংসার।
তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যায় কোনো উপায় না পেয়ে ঢাকায় চলে আসি। মুক্তাঙ্গনেই ৩০ বছর কাটিয়েছি। এর আগে বিল্ডিং কন্সট্রাকশনে কাজ করতাম। সাব কন্টাকটারিও করেছি। জ্যোতিষ শাস্ত্রে কোনো পড়া-লেখা নাই। যা শেখার, তা এক লেবারের কাছ থেকে শিখেছি।
মিজানুর বলেন, আমি অচল। আমার বাম পা অপারেশন করে জোড়া লাগানো। একটি দুর্ঘটনায় রান থেকে পা পৃথক হয়ে গিয়েছিলো। চেয়েও খেতে পারিনা, কোনো বোঝাও টানতে পারি না। সামান্য এই উপার্জন দিয়ে কেবল লবনের পয়সা জোটে।
এরপর আর কোন কথা বলেন নি তিনি। উদাস মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটি সিগারেট ধরালেন।
তার একটু সামনেই হাত দেখছিলেন মুজিবর।
তিনিও বললেন, আমি ভাগ্য বলিনা। হাতের রেখায় যা আছে তাই বলি। এই শাস্ত্র নিয়ে কোন পড়াশোনা নেই আমার। তবুও কিছু মানুষ আসে, আমিও তাদের আশাহত করিনা। চেষ্টা করি ‘ভালো’ খবরটি দেয়ার।