বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বেড়ানোর সময় পেলে আমরা অনেকেই বেছে নিই পাহাড় বা সমুদ্রকে৷ কিন্তু শহুরে জীবনে অভ্যস্ত মানুষ প্রকৃতির কাছে খুব একটা যাই না৷ তাই শীতে প্রকৃতি উপভোগ করতে ঘুরে আসতে পারেন খেজুর আর সরষে ক্ষেতে ভরা বাংলার কিছু গ্রাম থেকে৷
‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া, একটি ঘাসের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু’৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের এই কথা যুগে যুগে যথার্থই৷ কনকনে শীতের সকালে গাছতলায় বসে এক পেয়ালা খেজুর রস শেষ কবে পান করেছেন মনে আছে? অনেকের জীবনে হয়ত সে সুযোগই হয়নি৷ আবার যাঁদের সে সুযোগ হয়েছে, কর্মব্যস্ততার কারণে হয়ত তা ভুলতেই বসেছেন৷ এই শীতেই তাই কিছুটা সময় বের করে ফেলুন৷ ঘর থেকে মাত্র দু’পা দূরে গিয়েদেখে আসুন বাংলার প্রকৃতিকে৷
গ্রাম বাংলায় শীতের সঙ্গে খেজুর রসের সম্পর্ক নিবিড়৷ যাঁদের বেশি সময় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই, তাঁরা যেতে পারেন ঢাকার কাছেই মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা গ্রামে৷ এ গ্রামের মেঠো পথগুলোর দু’পাশ জুড়ে আছে প্রচুর খেজুর গাছ৷ শীতে এ গ্রামের মানুষের ব্যস্ততা তাই বেড়ে যায়৷ খেজুর গাছের রস সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন বিকেলে গাছ কাটা আর প্রত্যুষে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড় তৈরি করা হয়৷ ডিসেম্বরের শুরু থেকে জানুয়ারির শেষ অবধি বাংলাদেশে খেজুর রস পাওয়া যায়৷ এ সময়ে জায়গাটির ‘ল্যান্ডস্কেপ’-এ বৈচিত্র্য আনে অপূর্ব সরিষা ক্ষেত৷ এ সময় এখানে দেখা যায় ভ্রাম্যমাণ মধুচাষীদেরও৷ ঝিটকার খেজুর গুড়েরও সুনাম আছে৷ তাই এর স্বাদ নিতেও ভুলবেন না৷ তাছাড়া ঝিটকা গ্রামের মিনহাজ উদ্দিন হাজারীর উদ্ভাবিত সাদা রঙের খেজুর গুড়ের সুনাম কিন্তু দেশজোড়া৷ যুগ যুগ ধরে হাজারী পরিবারসহ গ্রামের বেশ কয়েকজন কারিগর এখনও ধরে রেখেছেন এই হাজারী গুড়ের ঐতিহ্য৷
এই শীতে যাঁদের দু-তিন দিনের সময় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ার সুযোগ আছে, তাঁরা কিন্তু যশোর যেতে ভুলবেন না৷ ইটের ভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খেজুর গাছ হারিয়ে গেলেও যশোর অঞ্চল ব্যতিক্রম৷ যশোরের বিভিন্ন এলাকায় এখনো প্রচুর খেজুর গাছ আছে৷ এই যেমন যশোর শহরের কাছেই একটি এলাকা আছে, যার নাম ‘খাজুরা’৷ জায়গাটিতে গেলে এর নামের সার্থকতা খুঁজে পাবেন৷ মাইলের পর মাইল শীতের সবজি ক্ষেত, মাঝে সারি সারি খেজুর গাছ৷ সূর্য ওঠার আগে এখানে গাছিরা ব্যস্ত থাকেন রস নামাতে৷ সেই রস নিয়েই পরে গৃহবধূরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন গুড় তৈরিতে৷
যশোরের আরেকটি এলাকা অভয়নগর৷ শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরের এ অঞ্চলও খেজুর রসের জন্য বিখ্যাত৷ অভয়নগর বাস স্টেশন থেকে পূর্ব দিকে বুড়ি ভৈরব নদী পার হয়ে ওপারে গেলে মাইলের পর মাইল খেজুর গাছ৷ শীতকালে এখানে কৃষি ক্ষেতগুলো ভরপুর থাকে সরিষায়৷ এখানকার মেঠো পথে চলতে চলতে নাকে তাই ছোঁয়া দিয়ে যায় সরিষা ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ৷ চাইলে এখানকার মেঠোপথে ঘুরে বেড়াতে পারবেন গরুর গাড়িতে করেও৷
এছাড়া শীতে বাংলাদেশের আরো অনেক এলাকায় প্রকৃতিতে বড় পরিবর্তন আনে সরিষা ক্ষেত৷ সবজু মাঠ যেন ঢেকে যায় হলুদ গালিচায়৷ যে কোনো দিন কিছুটা সময় করে তাই ঘুরে আসতে পারেন কাছে-দূরের কোনো এক সরিষা ক্ষেতের হলুদ প্রান্তর থেকেও৷
ঢাকার খুব কাছাকাছি সরিষা ফুলের জন্য সুন্দর আর একটি জায়গা মানিকগঞ্জের মানিকনগর৷ সাভারের হেমায়েতপুর থেকে সিঙ্গাইরের সড়ক ধরে কিছুদূর গেলে ধলেশ্বরী সেতু৷ ওপারে বিন্নাডিঙ্গি বাজার থেকে বাঁয়ের সড়কে কয়েক কিলোমিটার চললেই মানিক নগর৷ শীতে প্রকৃতি যেখানে ছবির মতো৷
ঢাকার কাছাকাছি সরিষা ফুলের আরেক জগত মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, সিরাজদিখান আর টঙ্গিবাড়ী৷ এখানকার আড়িয়াল বিল কিংবা সোনারং এলাকাতেও আছে প্রচুর সরিষা ক্ষেত৷ ঢাকা থেকে খুব সকালে শুরু করলে সারাদিন বেড়িয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসা সম্ভব এ সব জায়গা থেকে৷
সরিষা ক্ষেতে বেড়ানোর আরেক অপূর্ব জায়গা চলনবিল৷ সিরাজগঞ্জ, নাটোর এবং পাবনা জেলাজুড়ে বিশাল এই বিল শীত মৌসুমে হলুদ এক স্বর্গের রূপ নেয়৷ শীতে শুকিয়ে যাওয়া চলনবিলের বেশিরভাগ জমিতেই এ সময়ে চাষ হয় সরিষার৷ বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পেরিয়ে হাটিকুমড়ুল-বনপাড়া সড়কে কিছুক্ষণ চললেই পাওয়া যাবে চলনবিলের বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের৷ চলনবিলের সালঙ্গা, তাড়াশ, হরিণচড়া, দবিলা, কাছকাটা, প্রভৃতি জায়গায় সরিষা ক্ষেতের প্রাধান্য বেশি৷ তাই আর দেরি কেন? এখনই বেড়িয়ে পড়ুন গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথে…৷ -ডয়েচেভেলে