বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ নানার বাড়ি কলকাতায়। মা-বাবা ও ভাই-বোনদের সাথে বছরে তিন-চারবার যাওয়া হয় কলকাতা শহরে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কখনো যাওয়া হয়নি। জীবনে প্রথমবারের মত কলকাতার বাইরে আগ্রায় সম্রাট শাহজাহান ও পত্নী মমতাজের ভালোবাসার নির্দশন তাজমহল যাওয়া। কলকাতা থেকে ১২৫০ কিমি পথ ভ্রমণ, মনে ভয় ভয় কাজ করছে। শিয়ালদহ স্টেশনে এসে মনে একটু সাহস সঞ্চার হল।
শিয়ালদহ থেকে আগ্রা যাওয়ার ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী বাঙ্গালি। ভ্রমণসঙ্গী ছিল আমার ঘনিষ্ট এক বন্ধু। শিয়ালদহ-আজমীর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৯/সি নং প্লাটফোর্ম দাঁড়িয়ে আছে, রাত ১০টা ৫৫মিনিটে আজমীরির উদ্দেশ্য স্টেশন ছেড়ে যাবে। ট্রেনে উঠে সিট খুঁজে বসে পড়লাম। কিছু সময় পর ট্রেন হর্ন দিয়ে যাত্রা শুরু করল। ট্রেনের ভেতরে খাওয়া, গোসল ও টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। ৩৭ ঘণ্টা পরে আগ্রা ফোর্ট স্টেশনে পৌঁছল আমাদের ট্রেন। ট্রেন থেকে নামার পর সিএনজি ধরে আগ্রার বেলুগঞ্জের এক বিদেশি হোটেলে উঠলাম।
পরদিন খুব ভোরে উঠে তাজমহলের দক্ষিণ গেটে গিয়ে দেখি বিদেশিদের লম্বা লাইন। বিদেশিদের টিকিট মূল্য ৫৫০ রুপি। ১:৪০ ঘণ্টা পরে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম, সাথে আছে একজন গাইড।
চমৎকার এ সমাধি সৌধটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। গেট পেরিয়ে মূল ফটকে যেতে বেশ খানিকটা পথ হাটতে হবে। দক্ষিণ গেট থেকে যখন তাজমহলকে দেখা যায়, তখন মনে হয় দরজা পার হলেই তাজকে ছোঁওয়া যাবে। কিন্তু যত এগিয়ে যাওয়া হয় ততই পারস্পেক্টিভ বদলে যায়, তাজ ধীরে ধীরে সরতে থাকে, ক্রমশ নজরে পড়ে উঁচু বিরাট ভিত্তিভূমি যার চার কোণে চারটি মিনার, আর পশ্চিম ও পূর্ব দিকে বড় বড় গাছের আড়ালে অবিকল এক রকম দেখতে লাল পাথরের মসজিদ ও মেহমানখানা। আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে ভাল করে নজরে পড়বে মাঝখানে ফোয়ারার সারি দিয়ে চারটি সমান মাপের ‘চারবাগ’ বাগান, ঠিক মাঝখানে বড় মাপের চৌবাচ্চা, তার জলে তাজের প্রতিবিম্ব। তখন বিস্ময়ে কথা বন্ধ হয়ে যায়, মন হারিয়ে যায় মোহময় জাদুজগতে। এরপর মূল বেদিতে পৌঁছতে নিচ থেকে ২১টি চমকপ্রদ সিঁড়ি পার হতে হবে।
শুধু সমাধি সৌধ নয় সম্পূর্ণ তাজমহলের বেষ্টনি ও এর আশপাশ যেন এক স্বপ্ন রাজ্য। নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৩৭০ বছর আগে, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাজ দেখতে এসেছেন-সকলেই ফিরেছেন এক অনির্বচনীয় অনুভূতি নিয়ে। তেমনি এক অনুভূতি নিয়ে ফিরে এসেছি আমি।
একজন বৃটিশ নাগরিকের কাছে জানতে চাইলাম তাজমহল নিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন? তিনি বললেন, আমার স্বপ্ন ছিল ইন্ডিয়ায় গিয়ে সবার আগে তাজমহল দেখবো এবং তাই এখানে এসেছি। আজ তিন দিন এখানে আসছি, তবুও তাজমহল দেখার শেষ হচ্ছে না। ভালোবাসার স্বাক্ষী তাজমহলকে আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছি। তাজমহল আমার কাছে সেরা বিস্ময়। তাজমহল তৈরি করার যে কৌশল ও ঘটনা শুনলাম, তা আমাকে খুব বেশি মোহিত করেছে। আমি এখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবো, সন্ধ্যার সময়ে তাজমহলের যাদুকরি পরিবর্তন দেখার জন্য।
মুঘল সম্রাটদের নজরকাড়া সমাধিসৌধ আগেও তৈরি হয়েছে, যেমন দিল্লিতে হুমায়ুনের সমাধি ও আগরার সেকেন্দ্রায় আকবরের সমাধি। কিন্তু শাহজাহান একটু অন্য ভাবে তাঁর ভাবনাকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। ওই তিনটি সমাধিসৌধ বাগানের ঠিক মধ্যিখানে নির্মিত হলেও তাজ নির্মিত হয়েছে বাগানের একেবারে উত্তর ভাগে, যমুনা নদীর কিনারায়।
তাজমহল, সম্রাট শাহজাহানের মহান, অমর ও অনবদ্য এক কীর্তি যা তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজকে ভালবেসে তৈরি করেছিলেন। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে ভালবাসার এত বড় নিদর্শন কেউ তৈরি করে দেখাতে পারেননি। ভাবতেই যেন অবাক লাগে ২০ হাজার শ্রমিক ২২ বছর সময় নিয়ে তাদের নিপুন হাতে এই মহাকীর্তিটি নির্মাণ করেছেন। এই তাজমহল দেখার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রত্যহ ভিড় জমায় হাজারো পর্যটক। বর্তমানে তাজমহলে বছরে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন পর্যটক আসে যার মধ্যে দুই লাখ পর্যটক বিদেশি।
প্রতিটি দর্শনার্থীর কাছে তাজমহল এক বিষ্ময়কর সৃষ্টি। যতবার দেখা হয় ততবার ভালো লাগে। চাঁদনী রাতের তাজমহল দেখতে খুব সুন্দর। এটি ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র।