বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ হরিরামপুর ও শিবালয় উপজেলার প্রায় ২০০ গাছির আয়ের উৎস খেজুর রসের তৈরি হাজারী গুড়। এই হাজারী গুড়ের মাধ্যমে মানিকগঞ্জ জেলাকে দেশ-বিদেশে পরিচিত করে তুলেছেন ওইসব গাছি। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হাজারী গুড় ১৫০ বছরের ঐতিহ্য। তীব্র শীত আর ঘনকুয়াশায় এ বছর হাজারী গুড়ের উৎপাদন কিছুটা কম বলে জানিয়েছেন ওই অঞ্চলের গুড় তৈরির কারিগররা।
সরজমিন শিবালয় উপজেলার আরুয়া গ্রামের সুর্য মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখা গেল হাজারী গুড় তৈরির উৎসব। বাড়ির উঠানে তৈরি করা হয়েছে মস্ত বড় মাটির চুলা। সেই চুলায় কমপক্ষে ৬টি মাটির পাত্রে জ্বাল দেয়া হচ্ছে খেজুর রস। টাটকা খেজুর রসের গন্ধে ভরে গেছে পুরো বাড়িটি। বাড়ির গৃহিণী থেকে শুরু করে ছোট্ট শিশুরাও রস তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
কথা হয় বাড়ির গৃহকর্ত্রী মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। বলেন, সেই ৩০ বছর আগে যেদিন নতুন বউ হয়ে এই বাড়িতে আসি তখন দেখেছি আমার শাশুড়ি ও শ্বশুর কিভাবে পরম মমতা দিয়ে হাজারী গুড় তেরি করতো। আমি নতুন বউ ছিলাম, তাই শীতের সকালে তারা আমাকে চুলার কাছে আসতে দিতো না। তারপরও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম কিভাবে গুড় তৈরি করেন। আমার ভীষণ ইচ্ছে জাগতো তাদের সঙ্গে গুড় তৈরি করতে। এরপর বেশি দিন আমাকে দূরে রাখতে পারেনি।
আমি ইচ্ছে করেই শাশুড়িকে সহযোগিতা করতে করতে অল্প কয়েক দিনেই গুড় তৈরি করা শিখে গেলাম। এই হাজারী গুড় আমার শ্বশুর বাড়ির পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য। গুড় তৈরি করতে প্রচুর কষ্ট হয়, তারপরও এই ঐতিহ্যকে আমরা এখনো ধরে রেখেছি। কথা মনোনয়রা বেগমের স্বামী সূর্য মিয়ার সঙ্গে। যিনি এ অঞ্চলের সবচেয়ে স্বনামধন্য গাছি। এ বছর তিনি মোট ১৫০টি খেজুর গাছ অন্যের কাছ থেকে বছর চুক্তি রেখেছেন। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি গাছ কাটেন তিনি ও তার এক কর্মচারী।
জানালেন কিভাবে খেজুর রস থেকে হাজারী গুড় তৈরি করা হয় সেই গল্প। প্রতিদিন দুপুর থেকে উঠে পড়েন খেজুর গাছের আগ মাথায়। ধারালো ছ্যান দিয়ে ঠক ঠক শব্দে রস আহরণের জন্য গাছ কাটেন। এরপর নল গেঁথে তার ভেতর মাটির গাড়ি গাছের ঢালের সাথে রশি দিয়ে বেঁধে নিচে নেমে আসেন। রাতভর নল চ্যুয়ে গাড়ি ভরে যায় খেজুর রসে। এরপন আযানের ধ্বনী কানে আসার আগেই কনকনে শীতের মধ্যে বেরিয়ে পড়েন গাছ থেকে হাঁড়ি নামানোর কাজে।
সকালের সূর্য উঠার আগেই সবগুলো গাছ থেকে হাঁড়ি নামিয়ে সোজা বাসায় চলে আসেন। এরপর রস ভালো করে ছেকে চুলায় রাখা মাটির বড় বড় পাত্রে জ্বাল করা হয়। রসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে একটি মাটির হাঁড়িতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘুটে ঘুটে তৈরি করা হয় সাদা রঙের হাজারী গুড়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় নাড়া ও কাশবন। প্রচুর খাটুনির পর এই গুড় তৈরি হয়। এ গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। ৪০-৪৫টি গাছের রস থেকে প্রতিদিন ৪-৫ কেজি করে হাজারী গুড় তৈরি করা যায়। মিষ্টি ও টল টলে রস ছাড়া এ গুড় হয় না। তবে এবছর প্রচুর শীত আর ঘনকুয়াশার কারণে গুড় তৈরি ব্যাহত হচ্ছে।
সূর্য গাছি বলেন, বর্তমানে ভালোমানের এক কেজি হাজারী গুড় ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। তবে হাজারী গুড়ের চাহিদা এতই বেশি যার কারণে তৈরি করার আগেই অর্ডার থাকে। নামি দামি মানুষ গাড়ি নিয়ে আসেন গুড় নিতে। তবে আগের মতো এখন আর গুড় তৈরি করা যায় না। তার কারণ বর্তমানে খেজুর গাছের সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি রস জ্বাল করার জ্বালানির বড়ই অভাব। শীতে প্রায় তিন মাস গাছ কাটা যায়। এতে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকার মতো আয় হয় বলে জানান সূর্য গাছি।