বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ নীলদিঘী। ভালোবাসার বিন্দু বিন্দু জলে গড়া এক দিঘী। এ যেন রূপকথার রাজকন্যার হারিয়ে ফেলা নাকের নথ খুঁজে না পাওয়ায় অঝোর কান্নায় সৃষ্টি এক দিঘী। যেখানে আকাশ আর জলরাশি মিলেমিশে একাকার। নীলদিঘীর বুকে হিমেল হাওয়ার স্পর্শে ভেসে আসা প্রতিটি ঢেউ যেন বয়ে নিয়ে আসে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা।
দিঘীর প্রতিটি জল কনা বৃষ্টি স্নাত একগুচ্ছ কদম ফুলের মত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। যা হৃদয়কে করে সিক্ত আর অপার জলরাশির সাথে মুহূর্ত গুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেয়। বলছিলাম, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে মায়া ভালোবাসা আর প্রেমের প্রতিচ্ছবি হয়ে সেঁটে থাকা নীলদিঘীর গল্প। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক মাঝেই এটির অবস্থান।
নীলদিঘীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রূপকথার কবি হয়ত নীলাদ্রি ওই মেয়ের ভেলায় ভেসে ফিরে ফিরে আসতো এই নীল জলে স্নান করতে। দিঘীর ধারে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই যেন এক একটা প্রেমের কাব্য হয়ে স্মৃতির পাতায় ঠাঁই করে নেয়।
নীলদিঘী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে প্রাকৃতিকভাবেই নির্মল করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে আসলে যে কেউ প্রকৃতির পূর্ণ স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে এই নীলদিঘী জলে পা ডুবিয়ে। নোবিপ্রবির পরিবার কিংবা এখানে ঘুরতে আসা সকলের কাছেই নোবিপ্রবির নীলদীঘি লোভনীয় এক নাম। দিঘীর জল বাস্তবে অতটা নীল না হলেও, কল্পনায় নীলের আভা খুজে সবাই একে নীল দিঘী নামেই চেনে। অন্নদা সংকর রায় এর সেই বিখ্যাত উক্তি নিয়ে বলতে হয়, ‘অর্ধেক দিঘী তুমি অর্ধেক কল্পনা’।
প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে নীল দিঘির বিস্তার। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে আছে দুটি পাকা ঘাট। পশ্চিম পাশে বিভিন্ন গাছে পরিপূর্ণ বাগান। আর দিঘীর চারপাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তৈরি করে দিয়েছে সরু পথ, পথের পাশে আছে বেঞ্চ। দিঘীর সৌন্দর্য আরো অনেক আংশে বাড়িয়ে দিয়েছে এর চারপাশ ঘেরা নারিকেল গাছসহ হরেক রকমের গাছ। সবমিলিয়ে নীল দিঘিকে বলা চলে একটি পরিপূর্ণ প্যাকেজ।
মন চাইলে প্রিয়জনকে বা প্রিয়জনদের নিয়ে পুকুর ঘাটে পার করা যায় ভালোবাসার কিছু সময় কিংবা দিঘীর ধারে সরুপথ ধরে হেটে যাওয়ায় যায় মহাকালের পথে। তাছাড়াও এখানকার ঠাণ্ডা নির্মল হাওয়া, প্রকৃতির স্পর্শ, পাখিদের কোলাহল মুহূর্তেই মন করে ভরিয়ে দেবে একরাশ ভালোবাসায়। তাই হয়ত মন খারাপের কোনো এক সময়ে যেকোনো কারো মন ভালো করে দেয়ার জন্য এই নীলদিঘী একাই যথেষ্ট।
দিঘীর চতুর্দিকে বিভিন্ন ইমারতগুলো যেন এই দিঘীর দিকে তাকিয়েই সস্তির নিশ্বাস ফেলে। দিঘীর দক্ষিন কোনে আছে লাইব্রেরি ভবন। সারাদিনের ক্লাস, পড়াশুনা, পরীক্ষা শেষে একটু সস্তির জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই চলে আসে দিঘীর পাড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ কপোত-কপোতিরো প্রিয় জায়গা এই নীল দিঘী।
দিঘীর ধারে একে অপরের পাশে বসে হয়ত অদেখা ভবিষ্যতের নানান স্বপ্ন বোনে তারা। দিঘীর পশ্চিম পাশের বাগানে প্রায়ই ছুটির দিনে চড়ুই ভাতির আয়োজন করে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা আর আড্ডা, গানবাজনায় মুখরিত হয়ে উঠে নীলদিঘী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন নাটক বা মিউজিক ভিডিও তৈরির অন্যতম একটি স্থান এই নীল দিঘী। দিঘীর একটু পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ। খেলা শেষ করেই ছাত্ররা ঝাপিয়ে পড়ে নীলাভ এই দিঘীর বুকে। এইতো গেল দিনের চিত্র, দিঘীর রাতের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। রাতে দিঘীর পুরো রাজত্ব থাকে ছেলেদের দখলে। পড়ালেখা, ক্যারিয়ার বা ফ্যামিলির ভাবনা ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত ছেলেগুলো দিঘীর জলে পা ডুবিয়ে আপন মনে খুঁজতে থাকে হারিয়ে ফেলা অজানা সুখ দুঃখ। সেই সাথেই হয়তো দিঘীর অপার জলে নিজের দুফোঁটা অশ্রু জমা রেখে ভুলতে চায় অজানা সব দুঃখ কষ্ট।
নীলদিঘী নিজের সৌন্দর্য বিলিয়ে ক্ষান্ত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ে পানির চাহিদাও মিটিয়ে যাচ্ছে দিঘীর এই জলরাশি। উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় ক্যাম্পাসের পানি কিছুটা লবনাক্ত, এই পানি খাওয়া এবং ব্যবহারের অনুপযোগী। চারিদিকে লবণাক্ততার মধ্যে দিঘীর এই স্বাধু পানি যেন মহান সৃষ্টিকর্তার এক অনন্য দান। বর্তমানে দীঘির পানি আবাসিক হলগুলোর শিক্ষার্থীদের ব্যাবহার ও প্রক্রিয়া জাত করে তাদের খাওয়ার ব্যাবস্থাও করা হচ্ছে।
নীলদিঘীর উত্তর পাশের ঘাটের নাম সৃজন ঘাট। চলতি বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী সামসুদ্দিন সৃজন এর সলিল সমাধি হয় এই দিঘীতে। তাই এই ঘাটের নাম সৃজন ঘাট। বলা যায় নীলদিঘীর এই নীল জল আনন্দ নয়, না পাওয়া কিংবা হারানোর ও এক গল্প গাঁথা।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেলে এই দীঘির টানে হলেও ফিরে আসবে নোবিপ্রবির কাছে। ফিরে তাদের আসতে হয় কারণ কতো স্বপ্ন বোনা আর স্বপ্ন ভাঙার সাক্ষী এই নীলদিঘী। তাইতো নীলদিঘী শুধু দিঘী নয় যেন এক প্রেমের সিন্ধু।