ঢাকা , রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সে এক অন্য রকম কিচিরমিচির

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ প্রথম দর্শনে মনে হবে হাঁসের খামার। আরেকটু ভালো করে দেখলে ভুল ভাঙবে। কারণ, খামারের হাঁসগুলো এমন নয়। আর প্রাকৃতিক পরিবেশে একসঙ্গে এত হাঁস দেখাও যায় না। তাহলে ওরা কারা?

ওরা হলো পরিযায়ী পাখি, আমাদের শীতের অতিথি। পাতিসরালি বলে পরিচিত হাঁসের এই প্রজাতি। নাটোর-ঢাকা মহাসড়কের পাশে ওদের সেই বিচরণ ক্ষেত্র—জলাভূমি। সেখানে ট্রাক-বাসের শব্দ ছাপিয়ে কানে ভেসে আসে হাজারো পাখির কিচিরমিচির। কচুরিপানা আর জলজ দামে খাবার খোঁজে ওরা। থাকছেও ওই জলাশয়ে।

জলাভূমির পাশেই রয়েছে জনবসতি। মাঠে কাজ করছেন কৃষক। মহাসড়কে চলছে গাড়ি। হাঁসগুলোর সেদিকে কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই। এত সাহস পাখিরা পেল কোথায়! শুনেই রিকশাচালক মাসুদ রানা বললেন, ‘কাউকে মারতে দিই না যে!’

ডানা মেলে উড়ছে হাঁসগুলো। ছবি: তানভীর-উল-হোসেনডানা মেলে উড়ছে হাঁসগুলো। গত শনিবার সকালে নাটোরের পিটিআই মোড়ে নেমে পাখির কথা তুলতেই চা দোকানি লিখন বলে দিলেন, পাশের বিলেই হাজার হাজার পাখি থাকে। কাউকে মারতে দেওয়া হয় না। এখানে কেউ পাখিকে বিরক্তও করে না। পাখির প্রতি তাঁদের এই ভালোবাসার কারণ জানতে চাইলে লিখন বলেন, ‘আমরা মানুষই আমাদের পরিবেশটা নষ্ট করি। আর পাখি সেটা রক্ষা করে। এখানকার মানুষ এটা বোঝে। এই জন্য কেউ মারে না। তাই প্রচুর পাখি আসে।’ লিখনের দেখানো পথে ওই জলাভূমির কাছাকাছি যেতেই পাখির কিচিরমিচির কানে আসতে লাগল। আরেকটু কাছে গিয়ে দেখা গেল মজার দৃশ্য। একটি হাঁস উড়লেই তার সঙ্গে উড়ছে অন্তত এক হাজার হাঁস। অল্প পানির এই জলাভূমির এক পাশ থেকে তারা আরেক পাশে গিয়ে বসছে। সকালের আলো–ঝলমলে আকাশে উড়ে তারা অপূর্ব সৌন্দর্যের আয়োজন করছে। দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে সেই দৃশ্য।

ওরা আছে ঝাঁকে ঝাঁকে। ছবি: তানভীর-উল-হোসেনওরা আছে ঝাঁকে ঝাঁকে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বোধ হয় পাখিদের সখ্য হয়ে গেছে। জলাধারের পাশেই নিজের রিকশা রং করছিলেন দাদাপুর এলাকার মাসুদ রানা। বললেন, ‘রাত তিনটা থেকে পাখি আসা শুরু করে। সন্ধ্যার পরে চলে যায়। আমরা কাউকে একটা গুলতি ছুড়তে দিই না। এই গ্রামে যে পাখি মারতে আসবে, সেই মার খাবে।’

দাদাপুর বস্তির নাছিমা খাতুন (৪৫) গৃহকর্মী। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পাখির গল্পে যোগ দিয়ে বললেন, ‘আমাদের ভাগ্যটা বড় ভালো, কোন দ্যাশ থাইকে পাখি আইসে পড়েছে। কী সুন্দর লাগছে! আমি কাজে যাই আর দেখি, কাউকে মারতে দিইনি।’

সেখানে উপস্থিত ছিলেন নাটোরের তমালতলা কৃষি ও কারিগরি কলেজের উপাধ্যক্ষ বাবুল আক্তার। বললেন, দেশের মানুষ এখন অনেকটা পরিবেশসচেতন হয়ে উঠেছে। পাখি রক্ষায় এই এলাকার মানুষের উদ্যোগই তার বড় প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘পাখির অভয়ারণ্যের খবর গণমাধ্যমে এলে অনেক মানুষ পাখি দেখতে আসে। নাটোরের মানুষ হিসেবে আমার একটা চাওয়া, যারাই পাখি দেখতে আসুন, তাঁরা যেন পাখিকে বিরক্ত না করেন। বিরক্ত হলে পাখিরা উড়ে যায়। একবার উড়তে যে পরিমাণ “ক্যালরি” খরচ হয়, তা জোগাড় করতে পাখিকে অনেক বেগ পেতে হয়।’

ভেসে চলেছে পানিতে। ছবি: তানভীর-উল-হোসেনভেসে চলেছে পানিতে। চা দোকানি লিখন বলেছিলেন, এগুলো সরালি। বোঝা গেল, এই এলাকার মানুষ পাখি চেনেন। পাখিবিশারদেরা বলছেন, এরা পাতিসরালি। পাখিগুলো কালচে বাদামি রঙের লম্বা ঘাড়ওয়ালা। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির ধূসরাভ ও পীত রঙের মাথায় গাঢ় বাদামি টুপি রয়েছে। এর চোখ মলিন বাদামি, ঠোঁট ধূসর ও চোখের পাতা উজ্জ্বল হলুদ। পা ও পায়ের পাতা ফিকে নীল। আঙুলের পর্দা ও নোখর কালচে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা একই।

পাতিসরালি মিঠা পানির পুকুর, বিল, ঝিল, নদীতীর ইত্যাদি অগভীর জলাশয়ে বিচরণ করে। সাধারণত ঝাঁকে থাকতে দেখা যায়। রাতে জলমগ্ন জমিতে অল্প ডুব দিয়ে, সাঁতরে বা হেঁটে এরা আহার খোঁজে। খাদ্যতালিকায় আছে জলজ আগাছা, কচিকা, শস্যদানা, মরা মাছ, পোকামাকড় ও জলজ অমেরুদণ্ডী প্রাণী। দিনে এরা পানিতে, মাটিতে অথবা গাছে বিশ্রাম নেয়। অথবা ঘুমায়।

পাতিসরালির দল। ছবি: তানভীর-উল-হোসেনপাতিসরালির দল। পাতিসরালি বাংলাদেশে সুলভ আবাসিক পাখি। শীতে অনেক পাতিসরালি এ দেশে আসে। এরা বাংলাদেশ ও বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে এই প্রজাতি সংরক্ষিত।

বিলে দেওয়া জেলা প্রশাসনের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘এই সংরক্ষিত বিলে পাখি ধরা, শিকার করা, বিক্রি করা ও বিরক্ত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।’ নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজ্জাকুল ইসলাম বলেন, কোনো জলাভূমিতে অতিথি পাখির বিচরণ থাকলে, সরকার চাইলে সেটাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করতে পারে। সেই দিক চিন্তা করেই নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহ্ রিয়াজ সম্প্রতি জায়গাটি পাখির জন্য সংরক্ষিত ঘোষণা করেছেন।

সূত্রঃ প্রথম আলো

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

সে এক অন্য রকম কিচিরমিচির

আপডেট টাইম : ০৬:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ প্রথম দর্শনে মনে হবে হাঁসের খামার। আরেকটু ভালো করে দেখলে ভুল ভাঙবে। কারণ, খামারের হাঁসগুলো এমন নয়। আর প্রাকৃতিক পরিবেশে একসঙ্গে এত হাঁস দেখাও যায় না। তাহলে ওরা কারা?

ওরা হলো পরিযায়ী পাখি, আমাদের শীতের অতিথি। পাতিসরালি বলে পরিচিত হাঁসের এই প্রজাতি। নাটোর-ঢাকা মহাসড়কের পাশে ওদের সেই বিচরণ ক্ষেত্র—জলাভূমি। সেখানে ট্রাক-বাসের শব্দ ছাপিয়ে কানে ভেসে আসে হাজারো পাখির কিচিরমিচির। কচুরিপানা আর জলজ দামে খাবার খোঁজে ওরা। থাকছেও ওই জলাশয়ে।

জলাভূমির পাশেই রয়েছে জনবসতি। মাঠে কাজ করছেন কৃষক। মহাসড়কে চলছে গাড়ি। হাঁসগুলোর সেদিকে কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই। এত সাহস পাখিরা পেল কোথায়! শুনেই রিকশাচালক মাসুদ রানা বললেন, ‘কাউকে মারতে দিই না যে!’

ডানা মেলে উড়ছে হাঁসগুলো। ছবি: তানভীর-উল-হোসেনডানা মেলে উড়ছে হাঁসগুলো। গত শনিবার সকালে নাটোরের পিটিআই মোড়ে নেমে পাখির কথা তুলতেই চা দোকানি লিখন বলে দিলেন, পাশের বিলেই হাজার হাজার পাখি থাকে। কাউকে মারতে দেওয়া হয় না। এখানে কেউ পাখিকে বিরক্তও করে না। পাখির প্রতি তাঁদের এই ভালোবাসার কারণ জানতে চাইলে লিখন বলেন, ‘আমরা মানুষই আমাদের পরিবেশটা নষ্ট করি। আর পাখি সেটা রক্ষা করে। এখানকার মানুষ এটা বোঝে। এই জন্য কেউ মারে না। তাই প্রচুর পাখি আসে।’ লিখনের দেখানো পথে ওই জলাভূমির কাছাকাছি যেতেই পাখির কিচিরমিচির কানে আসতে লাগল। আরেকটু কাছে গিয়ে দেখা গেল মজার দৃশ্য। একটি হাঁস উড়লেই তার সঙ্গে উড়ছে অন্তত এক হাজার হাঁস। অল্প পানির এই জলাভূমির এক পাশ থেকে তারা আরেক পাশে গিয়ে বসছে। সকালের আলো–ঝলমলে আকাশে উড়ে তারা অপূর্ব সৌন্দর্যের আয়োজন করছে। দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে সেই দৃশ্য।

ওরা আছে ঝাঁকে ঝাঁকে। ছবি: তানভীর-উল-হোসেনওরা আছে ঝাঁকে ঝাঁকে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বোধ হয় পাখিদের সখ্য হয়ে গেছে। জলাধারের পাশেই নিজের রিকশা রং করছিলেন দাদাপুর এলাকার মাসুদ রানা। বললেন, ‘রাত তিনটা থেকে পাখি আসা শুরু করে। সন্ধ্যার পরে চলে যায়। আমরা কাউকে একটা গুলতি ছুড়তে দিই না। এই গ্রামে যে পাখি মারতে আসবে, সেই মার খাবে।’

দাদাপুর বস্তির নাছিমা খাতুন (৪৫) গৃহকর্মী। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পাখির গল্পে যোগ দিয়ে বললেন, ‘আমাদের ভাগ্যটা বড় ভালো, কোন দ্যাশ থাইকে পাখি আইসে পড়েছে। কী সুন্দর লাগছে! আমি কাজে যাই আর দেখি, কাউকে মারতে দিইনি।’

সেখানে উপস্থিত ছিলেন নাটোরের তমালতলা কৃষি ও কারিগরি কলেজের উপাধ্যক্ষ বাবুল আক্তার। বললেন, দেশের মানুষ এখন অনেকটা পরিবেশসচেতন হয়ে উঠেছে। পাখি রক্ষায় এই এলাকার মানুষের উদ্যোগই তার বড় প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘পাখির অভয়ারণ্যের খবর গণমাধ্যমে এলে অনেক মানুষ পাখি দেখতে আসে। নাটোরের মানুষ হিসেবে আমার একটা চাওয়া, যারাই পাখি দেখতে আসুন, তাঁরা যেন পাখিকে বিরক্ত না করেন। বিরক্ত হলে পাখিরা উড়ে যায়। একবার উড়তে যে পরিমাণ “ক্যালরি” খরচ হয়, তা জোগাড় করতে পাখিকে অনেক বেগ পেতে হয়।’

ভেসে চলেছে পানিতে। ছবি: তানভীর-উল-হোসেনভেসে চলেছে পানিতে। চা দোকানি লিখন বলেছিলেন, এগুলো সরালি। বোঝা গেল, এই এলাকার মানুষ পাখি চেনেন। পাখিবিশারদেরা বলছেন, এরা পাতিসরালি। পাখিগুলো কালচে বাদামি রঙের লম্বা ঘাড়ওয়ালা। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির ধূসরাভ ও পীত রঙের মাথায় গাঢ় বাদামি টুপি রয়েছে। এর চোখ মলিন বাদামি, ঠোঁট ধূসর ও চোখের পাতা উজ্জ্বল হলুদ। পা ও পায়ের পাতা ফিকে নীল। আঙুলের পর্দা ও নোখর কালচে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা একই।

পাতিসরালি মিঠা পানির পুকুর, বিল, ঝিল, নদীতীর ইত্যাদি অগভীর জলাশয়ে বিচরণ করে। সাধারণত ঝাঁকে থাকতে দেখা যায়। রাতে জলমগ্ন জমিতে অল্প ডুব দিয়ে, সাঁতরে বা হেঁটে এরা আহার খোঁজে। খাদ্যতালিকায় আছে জলজ আগাছা, কচিকা, শস্যদানা, মরা মাছ, পোকামাকড় ও জলজ অমেরুদণ্ডী প্রাণী। দিনে এরা পানিতে, মাটিতে অথবা গাছে বিশ্রাম নেয়। অথবা ঘুমায়।

পাতিসরালির দল। ছবি: তানভীর-উল-হোসেনপাতিসরালির দল। পাতিসরালি বাংলাদেশে সুলভ আবাসিক পাখি। শীতে অনেক পাতিসরালি এ দেশে আসে। এরা বাংলাদেশ ও বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে এই প্রজাতি সংরক্ষিত।

বিলে দেওয়া জেলা প্রশাসনের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘এই সংরক্ষিত বিলে পাখি ধরা, শিকার করা, বিক্রি করা ও বিরক্ত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।’ নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজ্জাকুল ইসলাম বলেন, কোনো জলাভূমিতে অতিথি পাখির বিচরণ থাকলে, সরকার চাইলে সেটাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করতে পারে। সেই দিক চিন্তা করেই নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহ্ রিয়াজ সম্প্রতি জায়গাটি পাখির জন্য সংরক্ষিত ঘোষণা করেছেন।

সূত্রঃ প্রথম আলো