ঢাকায় বৃহৎ পরিসরে জমায়েত করে নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি আরও জোরালো করবে বিএনপি। পাশাপাশি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে রাজপথে সোচ্চার থাকবে দলটি। নির্বাচনের দাবি জোরালো ও গণতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বন্ধে দশ সাংগঠনিক বিভাগে বড় সমাবেশ করারও চিন্তা করছে বিএনপি। আগামী মাস থেকে এসব সমাবেশ শুরু হতে পারে। গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। শিগগির সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিভাগীয় সমাবেশের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হবে বলে বৈঠকসূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি মনে করে, যেভাবে বিপ্লবকে ব্যর্থ করতে পতিত আওয়ামী লীগের দোসররা ষড়যন্ত্র করছে, এই ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হলে দ্রুত নির্বাচিত সরকার গঠন করা প্রয়োজন। তাই নির্বাচনের দাবিতে মাঠে থাকা ছাড়া বিকল্প দেখছে না বিএনপি। গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা বারবার নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি- জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সংস্কার উদ্যোগ সফল হতে পারে না। এ ধরনের অংশগ্রহণ কেবল নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই সম্ভব।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা- এই দুই ইস্যুতে মাঠের কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই এবার দশ সাংগঠনিক বিভাগে বড় সমাবেশ করার চিন্তা। এ ছাড়া মহান বিজয় দিবস ঘিরেও বড় শোডাউনের পরিকল্পনা রয়েছে। তাই আগামী ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আরেকটি বড় জমায়েত করবে দলটি।
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মেয়াদের তিন মাসেও নির্বাচনী রোডম্যাপের বিষয়টি স্পষ্ট করেনি। তাই চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। অন্যথায় আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে সোচ্চার হবে দলটি। গত ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া দুটিই সমান্তরালভাবে চলা উচিত। এ জন্য সরকারকে অবিলম্বে একটি রোডম্যাপ দিয়ে সামনে এগোনো দরকার। যতদিন পর্যন্ত এই রোডম্যাপ দেওয়া না হবে, ততদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার যে শঙ্কা’ রয়েছে, সেটা কাটবে না। তারা বলছেন, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে এবং এই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। তবে সরকারের সব কার্যক্রমের ফোকাস হওয়া উচিত নির্বাচন।
ঢাকার জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের শোভাযাত্রার মূল্যায়ন: বৈঠকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে গত শুক্রবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিএনপির বর্ণাঢ্য র্যালির মূল্যায়ন করেন নেতারা। তারা বলেন, ঢাকায় যে র্যালি হয়েছে, বিএনপির বিবেচনায় সেটা সর্বকালের সর্ববৃহৎ র্যালি। এই র্যালির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি। সুতরাং বিএনপিকে বাইরে রেখে কিংবা এড়িয়ে কোনো কিছু করা যাবে না। তা ছাড়া বিএনপি এই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় সহযোগী এবং সহায়ক শক্তি। তাই বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেই সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে আলোচনা: বৈঠকে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে সম্প্রতি তিনজনের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিএনপি নেতারা অভিমত, এদের মধ্যে দুজনকে নিয়ে নানা মহলে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতা এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং তারা আন্দোলন করছেন। এই নিয়োগ নিয়ে তারাও (বিএনপি) বিস্মিত। যথেষ্ট যাচাই-বাছাই ও চিন্তাভাবনা করে তাদের নিয়োগ দিলে এই বিতর্ক হতো না। তাই সরকারের উচিত যথাসম্ভব বিতর্ক এড়িয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া।
এর আগে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারকে উপদেষ্টা করায় প্রশ্ন তুলে তার পদত্যাগ দাবি করেছিল বিএনপি। দলটির অভিমত, তিনি ছিলেন প্রশাসনের বিতর্কিত কর্মকর্তা। আলী ইমামকে উপদেষ্টা নিয়োগের পর তাকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছিল। এরপর গত রবিবার তাকে সেখান থেকে সরিয়ে খাদ্য উপদেষ্টা করা হয়। এটি বিতর্কেরই ফল বলে মনে করে বিএনপি।
জামায়াত নিয়ে আলোচনা: স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের কেউ কেউ বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক নিয়ে অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বরাবরই কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনে তারা একসঙ্গে আন্দোলন করেছেন। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন এক অনানুষ্ঠানিক সভায় শরিকদের ডেকে তৎকালীন ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয় দলটি। জোট ভেঙে দেওয়ার পরও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ ছিল। ১০ দফা দাবিতে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। শুরুতে জামায়াত দুটি কর্মসূচি যুগপৎভাবে পালন করলেও পরে দলটি নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিল।
স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়ন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। যেটাতে দল দুটির মধ্যে এক ধরনের মতদ্বৈততা তৈরি হচ্ছে বলে অনেক মনে করছেন। এ ক্ষেত্রে জামায়াত বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে কিনা, সে প্রশ্নও সামনে আসছে। এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াতের সঙ্গে যাতে কোনো দূরত্ব তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত বলে বৈঠকে অভিমত দেন বিএনপির কয়েকজন নেতা।