অতীত ইতিহাস সামনে আনায় বিএনপির ওপর ক্ষেপেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি মনে করছে, পটপরিবর্তনের বর্তমান বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বিএনপি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জামায়াতকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। এতে রাজনৈতিক মাঠে তাদের খাটো করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভোটের মাঠে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ জন্য বিএনপিকে এখন থেকেই পাল্টা জবাব দেওয়ার চিন্তা করছে জামায়াত।
একই সঙ্গে বিএনপির শক্ত প্রতিপক্ষ হতে মাঠে মিত্র বাড়াচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির এখন মূল লক্ষ্য ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। যাতে কোনোভাবেই ইসলামপšি’ কোনো দলকে বিএনপি নিজেদের ঘরে নিতে না পারে। জামায়াত মনে করছে ইসলামি জোট তৈরি হয়ে গেলে ভোটের রাজনীতিতে অনেকটা বেকায়দায় পড়বে বিএনপি। ইসলামি দলগুলোকে নিজেদের মুঠোয় রেখে নির্বাচন করে ভালো ফল করা সম্ভব। মাঠেও সবাইকে এক সুরে আনতে চায় জামায়াত। প্রকাশ্যে সব ইসলামি দল যাতে বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলে, সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পটপরিবর্তনের পর ফ্রন্টলাইনে চলে আসা জামায়াত।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সমালোচনা করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, একাত্তরে আপনাদের ভূমিকা কী ছিল? আপনারা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? আপনারা কোন সেক্টর কমান্ডারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন? জামায়াত সবসময় মুনাফেকি করেছে বলেও একাধিকবার মন্তব্য করেন রিজভী। এরপর ধীরে ধীরে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জামায়াতের অতীত ইতিহাস টেনে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। জামায়াত ভেতরে ভেতরে বিষয়টি নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধ। মাঠ পর্যায়ের নেতারা বিএনপির বক্তব্য কোনোভাবেই মানতে পারছে না। সম্প্রতি যার রেশ পড়েছে মাঠে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা। দুই দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির জড়িয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম সময়ের আলোকে বলেন, রাজনীতির মাঠে প্রতিযোগিতা থাকবে। আদর্শিক জায়গা থেকে যুক্তি দিয়ে নিজেদের এগিয়ে থাকার চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু কারও অতীত নিয়ে চর্চা ভালো কিছু বয়ে আনে না। অতীত দিয়ে বিএনপি আমাদের ঘায়েল করতে চায়। এটি ঘায়েল করার গঠনমূলক টুলস (হাতিয়ার) হতে পারে না। আমরা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দিকে মনোযোগ দিতে চাই। আর মনে রাখতে হবে সবার অতীত ইতিহাসেই ভালোমন্দ কম-বেশি আছে। এগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে। অতীত কারণে আমরা বিভেদ চাই না।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় দুজন দায়িত্বশীল নেতা সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য নির্বাচনে ভালো রেজাল্ট করা। প্রথমেই হয়তো আমরা ক্ষমতায় নাও যেতে পারি। ১০০ আসন পেলেও রাষ্ট্রের বড় একটি অংশীদার হতে পারবে জামায়াত। এতে ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্য সফল হবে। ইসলামি শাসনব্যবস্থা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে এটি হবে। এ জন্য আমরা জোর দিচ্ছি ইসলামি ঐক্যে। ইসলামপšি’দের নেতৃত্বে থাকতে চায় জামায়াত। কোনোভাবে যাতে ইসলামপšি’দের নিজের ঘরে নিতে না পারে বিএনপি; সেই চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। আশা করি জামায়াত এ যাত্রায় সফল হবে। ইসলামি দলগুলো অন্তত একটি জায়গায় একমত হবে। সবাই ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়।
তারা বলেন, আমরা এই সরকারকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ মনে করছি না। তারা মূলত বাম ও বিএনপি ঘরানার। নইলে এখন পর্যন্ত আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে কেন মুক্তি দিচ্ছে না। এমনকি জামায়াতের নিবন্ধনও ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এটি আমাদের সঙ্গে প্রহসন করা হচ্ছে। ছাত্র সমন্বয়করাও নিজেদের বলয়কে শক্তিশালী করতে ছাত্রশিবিরকে নিচের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। অথচ গণঅভ্যুত্থানে মূল ভূমিকা পালন করেছে জামায়াত। কিন্তু কৌশলগত কারণে বাম ছাত্রদের সামনে রাখা হয়েছে।
ঢাকা উত্তর জামায়াতের এক নেতা সময়ের আলোকে বলেন, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় নির্বাচনের জন্য তাদের দলীয় প্রার্থী দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা স্থানীয় নির্বাচন চান। এতে তাদের তৃণমূলের অবস্থান পোক্ত হবে। আর সব ক্যাম্পাসে ইসলামি ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে আসবে না। কৌশলগত কারণে নিজস্ব ব্যানারে কাজ করবে না। পরিস্থিতি বুঝে তারা সামনে আসবে। তবে ইতিমধ্যে জামায়াতের ৭৯টি জেলা কমিটি সম্পন্ন হয়েছে। রুকন সম্মেলনের মাধ্যমে ভোটে জেলা আমির নির্বাচিত করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে ইসলামপন্থিদের ভোট ‘এক বাক্সে’ আনার চেষ্টায় কয়েক ধাপ এগিয়েছে জামায়াত। মোটামুটি শক্তিশালী চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, পরিচিত দল খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে কয়েক দফায় কথাবার্তা বলেছে জামায়াত। এমনকি বৃহৎ সংগঠন হেফাজতে ইসলামকেও সঙ্গে রাখতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। সম্প্রতি ইসলামী আন্দোলনের প্রধান নেতা সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের বরিশালের বাড়িতে যান জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। এরপর বিভিন্ন বিষয়ে দল দুটির শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য এবং আগামী নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে প্রায় অভিন্ন অবস্থান প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) বলেন, দুটি ইসলামি দলের সৌজন্য সাক্ষাতে অনেকের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে, ৫৩ বছরে যারা দেশকে ফ্যাসিবাদ ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। বিএনপি নতুন করে আর কী দেখাবে, এই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘তারা যা করবে, তা আমরা এখন তো দেখছি। যদিও কয়েক দিন পর ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। সম্প্রতি তিনি বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ওরা ক্ষমতার মসনদে বসে ইসলাম বা ইসলামি দলের কথা মনে রাখে না। আমরা চাই, আমাদের আর কেউ ব্যবহার করে ইসলাম যেন ধ্বংস না করতে পারে।
জামায়াত নেতা আবদুল হালিম সময়ের আলোকে বলেন, আমরাও চেষ্টা করছি ইসলামপন্থিদের সঙ্গে রাখতে। বিএনপিও চেষ্টা করছে। চরমোনাই পীর ও মামুনুল হকদের কাছ থেকে আমরা ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। এখন দেখা যাক ইসলামি দলগুলো কাদের সঙ্গে থাকে। আমরা নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভালো ফল করতে চাই। বিএনপিকে মূল প্রতিপক্ষ ধরেই মাঠে কাজ করছি। আমরা অন্যায় ও অনিয়মের প্রতিবাদ করে যাব। বিএনপি পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করলে পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, বিএনপি সবখানে আধিপত্য বিস্তার করছে। আমরা শুধু দুয়েকটির প্রতিবাদ করছি এতেই তারা বিভেদ সৃষ্টি করছে। আমরা নেতাকর্মীদের সহনীয় আচরণ ও ধৈর্য ধরতে বলেছি। বিএনপির মূল অবস্থা আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করায় এবং ক্ষমতায় যেতে চাই এই বক্তব্য দেওয়ায়। ক্ষমতায় যাওয়াই তো লক্ষ্য হওয়া উচিত। নইলে জনগণ জামায়াতকে কেন ভোট দেবে। গত ১৫ বছরের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে ভালো সাংগঠনিক অবস্থানে আছে জামায়াত। নারী ও অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও নানাভাবে কাছে টানার চেষ্টা করছি আমরা। এসব নিয়ে আমাদের গ্রাউন্ড ওয়ার্ক চলছে। সামনে চমক অপেক্ষা করছে।