ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রকৌশলীর কাজ করছেন চিকিৎসক, পিছিয়ে পড়ছে প্রকল্প

দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে সরকার বিপুল অর্থ বরাদ্দ দিলেও তা পুরোপুরি ব্যয় করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যোগ্য লোক ও অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন যেমন পিছিয়ে পড়ছে, তেমনি বরাদ্দ করা অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে না। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো বছরই স্বাস্থ্য খাতে ৮০ শতাংশের বেশি এডিপি বাস্তবায়িত হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নমূলক কাজে মূলত প্রকৌশলীদের প্রয়োজন হলেও এসব কাজের দায়িত্বে থাকছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকরা।

অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাবে তাঁরা এসব প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। এতে প্রকল্প যেমন পিছিয়ে পড়ছে, এ খাতে বরাদ্দ করা অর্থও খরচ হচ্ছে না

হাসপাতালগুলোতে দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও করোনার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সঠিক চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের।

অথচ সরকার প্রতিবছরই এ খাতের উন্নয়নে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে। এর বড় একটি অংশ খরচ করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। তাই এ খাতের উন্নয়নে পিছিয়ে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে চিকিৎসক নয়, প্রকৌশলী দরকার।

চিকিৎসকরা নিজ পেশায় ব্যস্ত থাকায় প্রকল্পে সময় দিতে পারেন না, এ জন্য স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পের কাজ সময়মতো এগোয় না।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে ছয় হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরের জন্য ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপিয়ার্ডনেস’ প্রকল্প নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অথচ আড়াই বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ৭০ শতাংশ। এই অর্থ শুধু টিকার পেছনেই গেছে, অবকাঠামোগত কোনো কাজ হয়নি। প্রকল্পের অন্যান্য কাজের মধ্যে ছিল ২৭টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা শনাক্তের পিসিআর মেশিনসহ ল্যাব এবং ১০ শয্যাবিশিষ্ট নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপন, ৪৩ জেলার সদর হাসপাতালে ২০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট স্থাপন, ১০ জেলায় মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট স্থাপন করা।

এগুলোর মধ্যে টিকাসংক্রান্ত কার্যক্রম ছাড়া আর কোনোটিতে তেমন কাজ হয়নি। অথচ প্রকল্পটি শেষ করতে ফের ৩১০ কোটি টাকা ব্যয় ও আরো আড়াই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বলে সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী বলেন, ‘প্রকল্পের শুরু থেকে প্রথম দুই বছরে তেমন কাজ হয়নি। আমি এসে ভ্যাকসিন কেনার যে চার হাজার ২৩৬ কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছি, সেটা বিশ্বব্যাংক থেকে নেওয়া। আমি আসার পর গত এক বছরে অগ্রগতি হয়েছে ৬৯ শতাংশ।’

স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোনোটি পাঁচ বছর, কোনোটি সাত বছর, কোনোটিবা ৯ বছর ধরে চলছে। এর মধ্যে কোনো প্রকল্পই নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি। গোপালগঞ্জের শেখ লুত্ফর রহমান ডেন্টাল কলেজ প্রকল্প চলছে ২০১৪ সাল থেকে। এর মধ্যে প্রকল্পের ৯ বছর পেরিয়ে গেছে। পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্প চলছে সাত বছর ধরে। এটি শুরু হয় ২০১৬ সালে। কাজ শেষ হয়েছে ৭৫ শতাংশ।

আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোনো বছরই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ তাদের দেওয়া অর্থ বরাদ্দ খরচ করতে পারে না। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ৪৪ প্রকল্পের আওতায় ৯ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও খরচ হয়েছে মাত্র ছয় হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। বরাদ্দের মাত্র ৬৮.২০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দ দুই হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে এক হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। এখানেও বাস্তবায়ন হয়েছে ৬৯.৪৬ শতাংশ।

এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৯.০৬ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭.৮৮ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৩.৯৬ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র ১৪.৯৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৩৯ প্রকল্পের আওতায় ১২ হাজার সাত কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগেরও গত কয়েক বছরে ৮০ শতাংশের বেশি এডিপি বাস্তবায়িত হয়নি।

স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা আইএমইডির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, সে সম্পর্কে বেশির ভাগ চিকিৎসকের ধারণা নেই। প্রকল্পের দায়িত্বে থাকলেও অন্যদের দিয়ে তাঁরা কাজ করান। এ জন্য প্রকল্পের কোনো বিষয়ে তাঁরা কিছু বলতে পারেন না। অন্যের সহায়তা নেন। কোনো তথ্য চেয়েও তাঁদের কাছ থেকে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে চিকিৎসকদের বদলে প্রকৌশলী নিয়োগ করা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটা বিষয় হচ্ছে, প্রকল্পে কেনাকাটায় অনিয়মের কারণে দেরি হয়। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, এ খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে যোগ্য লোক নেই। চিকিৎসকরা অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে প্রকল্প দেখাশোনা করেন। এখন তাঁরা রোগী দেখবেন, না প্রকল্প দেখবেন? দেখলেও টাকার জন্যই দেখবেন। তাঁদের তো এ বিষয়ে যোগ্যতা নেই। তাই এ খাতে প্রকল্প দক্ষ জনবল বা উপযুক্ত প্রকৌশলী দরকার।’

এ বিষয়ে সম্প্রতি সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এক অনুষ্ঠানে বলেন, এখানে অনেক বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীও ব্লাংক চেক দেওয়ার মতো বরাদ্দ দেন, যা খরচ করার করা হোক। কিন্তু যেসব চিকিৎসক প্রকল্পের দায়িত্বে থাকেন, তাঁরা মূল কাজ ফেলে প্রকল্পে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটাতে কী করা দরকার, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।

এ বিষয়ে উন্নয়ন প্রকল্প মনিটরিং ও যাচাইয়ের দায়িত্বে থাকা আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাস্থ্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কম থাকে, এটা ঠিক। অর্থ ছাড় কম হওয়ার কারণেও প্রকল্প শেষ হতে দেরি হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজনও আসলে চায় না বাইরের কেউ প্রকল্প বাস্তবায়ন করুক বা প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হোক। তবে পিডি একটু অ্যাকটিভ হলে প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

চিকিৎসকের বদলে প্রকৌশলী নিয়োগ করলে প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুত সম্পন্ন হবে কি না, জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব বলেন, এখানে প্রকৌশলী বা চিকিৎসক বিষয় নয়। চিকিৎসক হয়ে পিডির দায়িত্ব নিলে তো কাজ করতে হবে। একটু পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পে সময় দিলেই যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের তো একই রকম কাজ। তবে আমাদের প্রকল্পে অনেক ভিন্নতা রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি আইন-কানুন মেনে কাজ করতে গেলে সময় বেশি লাগে। বিভিন্ন কারণে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প পড়ে থাকে। এ কারণেও দেরি হয়।’

স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনের বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সমন্বিত টিম ম্যানেজমেন্ট দরকার। সেই টিমে সিএমএসডি, মন্ত্রণালয়, এজি অফিস, অধিদপ্তরের সব কর্মকর্তার সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। তা ছাড়া এটার কোনো সমাধান হবে না। মন্ত্রণালয়ের সহায়তা যদি অধিদপ্তর না পায়, তাহলে কাজ করা খুব কঠিন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

প্রকৌশলীর কাজ করছেন চিকিৎসক, পিছিয়ে পড়ছে প্রকল্প

আপডেট টাইম : ০৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে সরকার বিপুল অর্থ বরাদ্দ দিলেও তা পুরোপুরি ব্যয় করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যোগ্য লোক ও অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন যেমন পিছিয়ে পড়ছে, তেমনি বরাদ্দ করা অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে না। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো বছরই স্বাস্থ্য খাতে ৮০ শতাংশের বেশি এডিপি বাস্তবায়িত হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নমূলক কাজে মূলত প্রকৌশলীদের প্রয়োজন হলেও এসব কাজের দায়িত্বে থাকছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকরা।

অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাবে তাঁরা এসব প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। এতে প্রকল্প যেমন পিছিয়ে পড়ছে, এ খাতে বরাদ্দ করা অর্থও খরচ হচ্ছে না

হাসপাতালগুলোতে দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও করোনার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সঠিক চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের।

অথচ সরকার প্রতিবছরই এ খাতের উন্নয়নে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে। এর বড় একটি অংশ খরচ করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। তাই এ খাতের উন্নয়নে পিছিয়ে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে চিকিৎসক নয়, প্রকৌশলী দরকার।

চিকিৎসকরা নিজ পেশায় ব্যস্ত থাকায় প্রকল্পে সময় দিতে পারেন না, এ জন্য স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পের কাজ সময়মতো এগোয় না।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে ছয় হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরের জন্য ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপিয়ার্ডনেস’ প্রকল্প নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অথচ আড়াই বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ৭০ শতাংশ। এই অর্থ শুধু টিকার পেছনেই গেছে, অবকাঠামোগত কোনো কাজ হয়নি। প্রকল্পের অন্যান্য কাজের মধ্যে ছিল ২৭টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা শনাক্তের পিসিআর মেশিনসহ ল্যাব এবং ১০ শয্যাবিশিষ্ট নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপন, ৪৩ জেলার সদর হাসপাতালে ২০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট স্থাপন, ১০ জেলায় মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট স্থাপন করা।

এগুলোর মধ্যে টিকাসংক্রান্ত কার্যক্রম ছাড়া আর কোনোটিতে তেমন কাজ হয়নি। অথচ প্রকল্পটি শেষ করতে ফের ৩১০ কোটি টাকা ব্যয় ও আরো আড়াই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বলে সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী বলেন, ‘প্রকল্পের শুরু থেকে প্রথম দুই বছরে তেমন কাজ হয়নি। আমি এসে ভ্যাকসিন কেনার যে চার হাজার ২৩৬ কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছি, সেটা বিশ্বব্যাংক থেকে নেওয়া। আমি আসার পর গত এক বছরে অগ্রগতি হয়েছে ৬৯ শতাংশ।’

স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোনোটি পাঁচ বছর, কোনোটি সাত বছর, কোনোটিবা ৯ বছর ধরে চলছে। এর মধ্যে কোনো প্রকল্পই নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি। গোপালগঞ্জের শেখ লুত্ফর রহমান ডেন্টাল কলেজ প্রকল্প চলছে ২০১৪ সাল থেকে। এর মধ্যে প্রকল্পের ৯ বছর পেরিয়ে গেছে। পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্প চলছে সাত বছর ধরে। এটি শুরু হয় ২০১৬ সালে। কাজ শেষ হয়েছে ৭৫ শতাংশ।

আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোনো বছরই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ তাদের দেওয়া অর্থ বরাদ্দ খরচ করতে পারে না। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ৪৪ প্রকল্পের আওতায় ৯ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও খরচ হয়েছে মাত্র ছয় হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। বরাদ্দের মাত্র ৬৮.২০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দ দুই হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে এক হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। এখানেও বাস্তবায়ন হয়েছে ৬৯.৪৬ শতাংশ।

এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৯.০৬ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭.৮৮ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৩.৯৬ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র ১৪.৯৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৩৯ প্রকল্পের আওতায় ১২ হাজার সাত কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগেরও গত কয়েক বছরে ৮০ শতাংশের বেশি এডিপি বাস্তবায়িত হয়নি।

স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা আইএমইডির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, সে সম্পর্কে বেশির ভাগ চিকিৎসকের ধারণা নেই। প্রকল্পের দায়িত্বে থাকলেও অন্যদের দিয়ে তাঁরা কাজ করান। এ জন্য প্রকল্পের কোনো বিষয়ে তাঁরা কিছু বলতে পারেন না। অন্যের সহায়তা নেন। কোনো তথ্য চেয়েও তাঁদের কাছ থেকে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে চিকিৎসকদের বদলে প্রকৌশলী নিয়োগ করা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটা বিষয় হচ্ছে, প্রকল্পে কেনাকাটায় অনিয়মের কারণে দেরি হয়। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, এ খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে যোগ্য লোক নেই। চিকিৎসকরা অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে প্রকল্প দেখাশোনা করেন। এখন তাঁরা রোগী দেখবেন, না প্রকল্প দেখবেন? দেখলেও টাকার জন্যই দেখবেন। তাঁদের তো এ বিষয়ে যোগ্যতা নেই। তাই এ খাতে প্রকল্প দক্ষ জনবল বা উপযুক্ত প্রকৌশলী দরকার।’

এ বিষয়ে সম্প্রতি সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এক অনুষ্ঠানে বলেন, এখানে অনেক বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীও ব্লাংক চেক দেওয়ার মতো বরাদ্দ দেন, যা খরচ করার করা হোক। কিন্তু যেসব চিকিৎসক প্রকল্পের দায়িত্বে থাকেন, তাঁরা মূল কাজ ফেলে প্রকল্পে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটাতে কী করা দরকার, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।

এ বিষয়ে উন্নয়ন প্রকল্প মনিটরিং ও যাচাইয়ের দায়িত্বে থাকা আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাস্থ্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কম থাকে, এটা ঠিক। অর্থ ছাড় কম হওয়ার কারণেও প্রকল্প শেষ হতে দেরি হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজনও আসলে চায় না বাইরের কেউ প্রকল্প বাস্তবায়ন করুক বা প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হোক। তবে পিডি একটু অ্যাকটিভ হলে প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

চিকিৎসকের বদলে প্রকৌশলী নিয়োগ করলে প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুত সম্পন্ন হবে কি না, জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব বলেন, এখানে প্রকৌশলী বা চিকিৎসক বিষয় নয়। চিকিৎসক হয়ে পিডির দায়িত্ব নিলে তো কাজ করতে হবে। একটু পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পে সময় দিলেই যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের তো একই রকম কাজ। তবে আমাদের প্রকল্পে অনেক ভিন্নতা রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি আইন-কানুন মেনে কাজ করতে গেলে সময় বেশি লাগে। বিভিন্ন কারণে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প পড়ে থাকে। এ কারণেও দেরি হয়।’

স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনের বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সমন্বিত টিম ম্যানেজমেন্ট দরকার। সেই টিমে সিএমএসডি, মন্ত্রণালয়, এজি অফিস, অধিদপ্তরের সব কর্মকর্তার সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। তা ছাড়া এটার কোনো সমাধান হবে না। মন্ত্রণালয়ের সহায়তা যদি অধিদপ্তর না পায়, তাহলে কাজ করা খুব কঠিন।