‘ঈমানদারদের জন্য কী
এখনও সময় আসেনি যে, কোরআন, আল্লাহর জিকির এবং সত্যদ্বীনের প্রতি তাদের অন্তর ঝুঁকে যাবে। আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর সদাকম্পিত হবে। অতঃপর নম্র দিলে তারা ক্রন্দনরত থাকবে। মুসলমানরা কি এখনও আলস্যে ডুবে আছে? যদি এমনই হয়, তাহলে পূর্ববর্তী উম্মতদের মতো অবস্থা তোমাদেরও হবে। সুতরাং নির্জনে ও লোকালয়েÑ সর্বাবস্থায় আল্লাহর ভয়ে তোমাদের ক্রন্দন করা উচিত।’
তিনটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস থেকে মুক্তি দেয়Ñ ১. ক্রোধ-গোস্বা এবং হাসি-আনন্দ উভয়াবস্থায় ইনসাফের সঙ্গে মেপে মেপে কথা বলা। ২. দুরবস্থা এবং সচ্ছলতা উভয় সুরতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। ৩. লোকালয় ও নির্জনতা উভয় স্থানে আল্লাহকে ভয় করে চলা। (আল মুজামুল আওসাত : ৬/২৫১)।
ক্রোধ এবং আনন্দ উভয়াবস্থায় ইনসাফের সঙ্গে হক কথা বলা। ক্রোধের সময় মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না। কখনও ভুল পথে অগ্রসর হয়। সুতরাং এ অবস্থায় ইনসাফের সঙ্গে হক কথা বলাই শ্রেয়। যদিও এটি খুব কষ্টকর, তথাপি মানুষ চেষ্টা করলে সবই পারে। নিজ চাহিদা-উদ্দেশ্যকে দমিয়ে রাখা, প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাবকে দূরে ঠেলে দেয়া; যদিও সহজ নয়, অনেক বড় কোরবানি ও ত্যাগের কাজ। এজন্যই তো আল্লাহ তায়ালা এ ত্যাগ স্বীকারকে মুক্তির মাধ্যম বানিয়েছেন।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘ক্রোধ ঈমানকে এভাবে নষ্ট করে দেয়, যেভাবে ইলওয়া (একপ্রকার তিক্ত ওষুধবিশেষ) মধুতে পতিত হওয়ার কারণে তার স্বাদ বিনষ্ট হয়ে যায়।’ (শুআবুল ঈমান : ৬/৩১২)। ক্রোধ শয়তানের পক্ষ থেকে অঙ্গারস্বরূপ, যা কখনও মানুষের চোখ এবং রগ থেকে প্রকাশ পেয়ে থাকে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ক্রোধ শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। তার সৃষ্টি হয়েছে আগুন থেকে। আর আগুনকে পানি দিয়ে নেভানো হয়। সুতরাং তিনি ক্রোধ দমানোর জন্য অজু-গোসলের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও দুইটি জিনিসের নির্দেশ করেছেন, ক্রোধের সময় দাঁড়ানো অবস্থায় থাকলে বসে পড়া এবং বসা অবস্থায় থাকলে শুয়ে পড়া। এতে যদি ক্রোধ প্রশমিত না হয়, সঙ্গে সঙ্গে ‘আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম’ অথবা ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিনাশ শায়তানির রাজিম’ পড়ে নেয়া। এসব কাজ করার দ্বারা ইনশাআল্লাহ ক্রোধ প্রশমিত হয়ে যাবে।
ক্রোধ হজমকারীকে বীর-বাহাদুর, পালোয়ান বলা হয়েছে। এর ফজিলতও রাসুল (সা.) বর্ণনা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হকের ওপর থাকাবস্থায়ও নিজ ক্রোধকে দমন করে, আল্লাহর ভয়ে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কোনো সীমালঙ্ঘন না করে বসে, কেয়ামত দিবসে সব সৃষ্টির সামনে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের যে কোনো হুরকে ইচ্ছেমতো পছন্দ করে নিজের জন্য নিয়ে নেয়ার স্বাধীনতা দেবেন।’ (আবু দাউদ : ২/৬৫৯)।
আল্লাহর কাছে চার ধরনের মানুষ অনেক প্রিয় হয়ে থাকে। তাদের একজন ‘ক্রোধ দমনকারী’। এ থেকে বড় সুসংবাদ আর কী হতে পারে যে, ক্রোধ দমনের বিনিময়ে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন হবে…?
দ্বিতীয় বিষয় হলো, দুরবস্থা ও সচ্ছলতা উভয়াবস্থায় ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থী হওয়া। অর্থাৎ সুখ-সচ্ছলতা ও ধনাঢ্যতা উভয়াবস্থায় আল্লাহর পথে ব্যয় করা। দুরবস্থা ও সম্পদহীনতার সময়েও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে ভুলে না যাওয়া। বরং সর্বাবস্থায় আল্লাহর পথে ব্যয় করার অভ্যাস ধরে রাখা।
যেমনিভাবে সুখ-সচ্ছলতার সময়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করা হয়, অনুরূপ দরিদ্রতার সময়ও নিজ সাধ্যানুযায়ী ব্যয় করা উচিত যৎসামান্যই হোক না কেন! এমন যেন না হয়, ধনাঢ্যতার সময় লাগামহীন-গাছাড়া হয়ে ব্যয় করতে থাকল, আর অভাবের সময় হাত গুটিয়ে অন্তঃসার হয়ে বসে রইল। এমনটি করা একেবারেই অনুচিত, বরং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় মধ্যমপন্থী হওয়া চাই। তবে তা মুক্তির উপায় হবে।
তৃতীয় বিষয় হলো, লোকালয় ও নির্জনতা উভয় স্থানে আল্লাহকে ভয় করে চলা। অর্থাৎ লোকালয়ে-জনসমক্ষে হোক কিংবা একাকিত্বে-নির্জনতায়, আল্লাহ তায়ালা যেসব বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন, যদিও সেগুলো বৈধ-অবৈধের মাঝে সংশয়যুক্ত হয় (মুশতাবাহ), সেগুলো থেকেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত। যদি সেগুলোর কোনোটির প্রতি অন্তরের দুর্বলতা চলে আসে, তাহলে আল্লাহর শাস্তির কথা স্মরণ করে সেগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখবে। পূর্ববর্তী উম্মতদের অবস্থা তো এরূপ ছিল যে, আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলরা তাদের কাছে কিতাব ও নতুন শরিয়তসহ প্রেরিত হলে তাদের আনুগত্যে নতশির থাকত। কিন্তু তাদের ওফাতের কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর সত্য-দ্বীনের ব্যাপারে তাদের অন্তর কঠোর হয়ে যেত।
নবীর আনীত কিতাব ও শরিয়ত ছেড়ে উল্টোপথে চলা আরাম্ভ করত। এ ধারাবাহিকতা চলে আসছিল। এক পর্যায়ে সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) আগমন করেন। এবার উম্মতে মুহাম্মাদির ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো হয়ে গেল। তারা আল্লাহর জিকিরে অন্তরের প্রশান্তি খুঁজে পেল। তাকওয়া-পরহেজগারিতে অনেক উঁচুতে স্থান করে নিল। যে স্থানের স্বপ্নও পূর্ববর্তী উম্মতরা দেখতে পেত না! অতঃপর উম্মতে মুহাম্মাদিকে উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ঈমানদারদের জন্য কী এখনও সময় আসেনি যে, কোরআন, আল্লাহর জিকির এবং সত্যদ্বীনের প্রতি তাদের অন্তর ঝুঁকে যাবে। আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর সদাকম্পিত হবে। অতঃপর নম্র দিলে তারা ক্রন্দনরত থাকবে। মুসলমানরা কি এখনও আলস্যে ডুবে আছে? যদি এমনই হয়, তাহলে পূর্ববর্তী উম্মতদের মতো অবস্থা তোমাদেরও হবে। সুতরাং নির্জনে ও লোকালয়েÑ সর্বাবস্থায় আল্লাহর ভয়ে তোমাদের ক্রন্দন করা উচিত।’ (সূরা হাদিদ : ১৬)।
লেখক : শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত