আল্লাহর এ নেয়ামতও কখনও আমাদের বিপদের কারণ হয় আমাদেরই অব্যবস্থাপনা ও খামখেয়ালিপনার দরুন। আল্লাহ সব বন্যাদুর্গত মানুষকে হেফাজত করুন। আমাদের তৌফিক দিন তাদের পাশে দাঁড়াতে
পানি জীবনের অন্যতম উৎস। আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য বিশাল এক নেয়ামত। দুনিয়া-আখেরাতে পানির বিশিষ্ট ভূমিকা থাকায় পবিত্র কোরআনে পানিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ৪৬টি স্থানে পানির ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। আকাশ, মাটি সৃষ্টি করার পর মহান আল্লাহ পানি সৃষ্টি করেছেন। পানি থেকেই আল্লাহ তায়ালা সব প্রাণবান বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তো পানি থেকেই সব প্রাণবন বস্তুকে সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ৩০)।
পানি শুধু জীবনের উৎস নয়, আল্লাহ তায়ালা যে ইবাদত করার জন্য আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো পবিত্রতা। পবিত্রতার প্রথম ও প্রধান উপকারণ হলো পানি। এ পানি আল্লাহ মানুষের প্রশান্তির জন্য আকাশ থেকে অবতরণ করেন যাতে মানুষ পবিত্র হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তিনি আরোপ করেন তোমাদের ওপর তন্দ্রাচ্ছন্ন তা নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রশান্তির জন্য এবং তোমাদের ওপর আকাশ থেকে পানি অবতরণ করেন যাতে তোমাদের পবিত্র করে দেন এবং যাতে তোমাদের থেকে অপসারিত করে দেন শয়তানের পবিত্রতা।’ (সূরা আনফাল : ১১)।
পানি ব্যতীত এ সুন্দর বায়ুম-ল অস্তিত্বহীন হয়ে যেত। তাই পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পানির অবদান অনস্বীকার্য। পানির মাধ্যমে বৃক্ষ জন্মে এবং যার মাধ্যমে আমরা পশুচারণ করে থাকি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন। এতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা থেকে বৃক্ষ জন্মে যাতে তোমরা পশুচারণ করে থাক।’ (সূরা নাহল : ১০)।
পানি জান্নাতবাসীদের উপহার দেয়া হবে এবং জাহান্নামবাসীদের পানি থেকে বঞ্চিত করা হবে। জাহান্নামবাসীরা তাদের অত্যাচারের কষ্টে পানির পিপাসায় জান্নাতি ব্যক্তিদের কাছে পানি চাইবে, কিন্তু তারা যেহেতু অবিশ্বাসী তাই তাদের পানি দেয়া হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ডেকে বলবে দোজখবাসীরা জান্নাতবাসীদের, আমাদের ওপর কিছু পানি বা খাদ্য ফেলে দাও বা আল্লাহ তায়ালা তোমাদের যা দিয়েছেন তা থেকে। তারা বলবে, আল্লাহ এ দুইটি অবিশ্বাসীদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন।’ (সূরা আরাফ : ৫০)।
পানি বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে অপচয় হচ্ছে। পানি অপচয় করা আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন। অপচয় ইসলামের দৃষ্টিতে একটি মারাত্মক গর্হিত কাজ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আহার করো ও পান করো কিন্তু অপচয় করো না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ : ৩১)।
রাসুল (সা.) পরিমাণ মতো পানি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। পরিমাণ মতো পানি ব্যবহার করা, অজু, গোসল কিংবা বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হবে। গোসল করার সময় আমরা মাত্রাতিরিক্ত পানি ব্যবহার করি, আবার মসজিদে অজু করতে গিয়ে পানির কল ছেড়ে দীর্ঘ সময় অজু করি। মাথা, কান, গর্দান মাসেহ করার সময় যদি পানির ট্যাপ বন্ধ রাখি এবং স্বাভাবিকভাবে ট্যাপ ছেড়ে অজু করলে পানির অপচয় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) একসময় সাদ (রা.) কে অতিক্রম করছিলেন। সাদ (রা.) তখন অজু করছিলেন। রাসুল (সা.) বললেন, পানি অপব্যয় করছ কেন? সাদ (রা.) বললেন, অজুতেও পানি কি অপব্যয় হয়। রাসুল (সা.) বললেন, প্রবহমাণ নদীতেও যদি তুমি অজু করো তবুও অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা যাবে না।’ (মুসনাদ আহমদ)।
কেয়ামতের মাঠে আল্লাহ তায়ালা সব নেয়ামত সম্পর্কে একে একে হিসাব নেবেন। সেখানে পানির ব্যবহার সম্পর্কে হিসাব চাওয়া হবে। আল্লাহর নিয়োজিত ফেরেশতারা এ পানি ব্যবহার সম্পর্কে লিখে রাখছেন, সামান্য অপচয় করলেও সেদিন হিসাব দিতে হবে। যেহেতু প্রতিটি বিষয় আল্লাহর দেয়া ফেরেশতারা লিপিবদ্ধ করে রাখছেন। তাই আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ মেনে চলে তার প্রদত্ত রিজিক থেকে খাওয়া পান করতে হবে। এ পৃথিবীর জমিনে কোনো অবস্থাতে কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না। মহান আল্লাহ আমাদের আদেশ করেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রিজিক থেকে খাও এবং পান করো; কিন্তু পৃথিবীর বুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে না।’ (সূরা বাকারা : ৬০)।
পানি কীভাবে পান করতে হবে, সেই আদব প্রিয়নবী (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন। বসে ডান হাত দিয়ে বিসমিল্লাহির রাহ্্মানির রাহিম বলে পানি পান করা রাসুল (সা.) এর সুন্নত। তিন শ্বাসে পানি পান করা উত্তম। প্রত্যেকবার পাত্র থেকে মুখ পৃথক করা, পাত্রের ভেতরে শ্বাস কিংবা ফুঁক না দেয়া কাম্য। পানি পান করার পর পড়তে হবে, আলহামদুলিল্লাহ। চা, কফি কিংবা পানীয় জাতীয় পান করলেও আলহামদুলিল্লাহ পড়া সুন্নত। রাসুল (সা.) পানি সম্পর্কে যে শিক্ষা দিয়েছেন সেগুলো শুধু সুন্নত নয় বরং এর প্রতিটিতে রয়েছে শরীর সুস্থ রাখার নিদর্শন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পানির পাত্রকে ঢেকে রাখ এবং বাসনগুলোকে উল্টে রাখ।’ (মুসলিম)।
পানি ব্যবহারের নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে ইসলামে সীমাবদ্ধ নয়, ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যকে পানি পান করানোর তাগিদ দিয়েছে এবং এটি একটি পুণ্যের কাজ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন লোক রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তার ভীষণ পিপাসা পেল, সে কূপে নেমে পানি পান করল। পানি পান করে বের হয়ে সে দেখতে পেল একটি কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল কুকুরটিরও আমার মতো পানির পিপাসা পেয়েছে। সে কূপের মধ্যে নামল এবং স্বীয় মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে সেটি ধরে উপরে উঠে এসে কুকুরটিকে পানি পান করাল। মহান আল্লাহ তার কাজে সন্তুষ্ট হলেন এবং তার গোনাহগুলো ক্ষমা করে দিলেন। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর প্রিয় রাসুল (সা.) চতুষ্পদ জন্তুর উপকার করলে সাওয়াব হবে? রাসুল (সা.) বললেন, প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করলেই পুণ্য পাওয়া যাবে।’ (মুসলিম)।
আল্লাহর এ নেয়ামতও কখনও আমাদের বিপদের কারণ হয় আমাদেরই অব্যবস্থাপনা ও খামখেয়ালিপনার দরুন। আল্লাহ সব বন্যাদুর্গত মানুষকে হেফাজত করুন। আমাদের তৌফিক দিন তাদের পাশে দাঁড়াতে।