মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণের মতো মহৎ কাজ হলেও তা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হবে। নবী করিম (সা.) তখনই এ মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে ময়লার স্তূপ বানানোর নির্দেশ দেন। ইসলামের ইতিহাসের এত বড় ঘটনা প্রমাণ করে, মিথ্যা, কপটতা ও উদ্দেশ্য খারাপ হলে ইবাদতের কাজও ইসলামের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে যায়
মদিনার একদল কপট মোনাফেকের কথা কোরআনে সবিস্তারে উল্লেখ আছে। তারা মনের দিক থেকে কাফের ও ইসলামের চরম শত্রু ছিল; তবে বাহ্যিকভাবে মুসলিম পরিচয় বহন করত। মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আখড়া হিসেবে তারা একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিল। ইতিহাসে এর নাম মসজিদে জেরার। বর্তমান কুবা মসজিদের কাছাকাছি নতুন মসজিদটি নির্মাণের পর মোনাফেকরা নবী করিম (সা.) এর খেদমতে এসে বিনয় ও কাকুতির সঙ্গে আরজ করে, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা দ্বীনের স্বার্থে মসজিদখানা নির্মাণ করেছি। অঝোরে বর্ষা নামলে আমাদের মহল্লার অনেকের পক্ষে মসজিদে নববিতে জামাতে শরিক হওয়া সম্ভব হয় না। তাদের ইবাদতের সুবিধার্থে এ মসজিদ নির্মাণ করেছি। এছাড়া আমরা মসজিদের প্রতিবেশী হতে পারব, এতো বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। কাজেই আপনার খেদমতে বিনীত আবেদন, আপনি একবার আমাদের মসজিদে তশরিফ রাখুন, অন্তত এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মসজিদের উদ্বোধন করে আমাদের কৃতার্থ করুন।
তারা আরও জানাল, এ মসজিদ ইবাদত-বন্দেগি ছাড়াও অসহায় মানুষের আশ্রয় হবে। গরিব-দুঃখী সেবা পাবে, দ্বীনের ঝা-া বুলন্দ হবে। কাজেই দয়া করে কিছুক্ষণের জন্য আপনি যদি তশরিফ আনেন আর আমাদের হেদায়েত দেন, আমরা ধন্য হব। আপনার পদার্পণে মসজিদ আর মসজিদের প্রতিবেশীদের ভাগ্যে পূর্ণিমা চাঁদ আলো ছড়াবে। কারণ আমাদের অবস্থা আঁধার রাত আর আপনি হলেন সেই রাতের আকাশে উজ্জ্বল চাঁদনি। আপনার সৌন্দর্যে অন্ধকার রজনী হয়ে যাবে উজ্জ্বল দিনের সমান। কেননা যে সূর্যের আলোয় মানুষের অন্তর্জগৎ আলোকিত হয়, সে তো আপনি। মওলানা রুমি বলেন, হায়! কথাগুলো যদি তারা নিষ্ঠার সঙ্গে বলত, তাহলে হয়তো তাদের মনের কুটিলতা দূর হয়ে যেত। অথচ তাদের কথাগুলো ছিল কপটতার ছলচাতুরী।
লুতফ কায়দ বী দিল ও জা’ন দর যবা’ন
হামচো সবজায় তুন বুয়াদ আই দূস্তা’ন
প্রাণহীন অন্তঃসারশূন্য যে ভক্তি মুখে উচ্চারিত
তার উপমা ময়লার স্তূপে উদগত সবজির মতো।
হাম যে দূরশ বেনগর ও আন্দর গুযার
খোরদন ও বূ রা’ নশা’য়দ আয় পেসার
দূর থেকে দেখে তা সরে যাও সংযত সতর্কতায়
এমন সবজি খাওয়ার যোগ্য নয়, দুর্গন্ধ ছড়ায়।
সূয়ে লুতয়ে বেওফায়া’ন হীন মরো
কা’ন পুলে ওয়েইরা’ন বুয়াদ নীকূ শুনো
যাদের বিশ^স্ততা নেই, তাদের দরদে মজবে না, সাবধান!
তারা বিরান ভঙ্গুর পুলে উঠলেই ভেঙে হবে জীবনাবসান।
যা-ই হোক, আল্লাহর রাসুলকে রাজি করানোর জন্য নানা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কথা বলতে থাকে। রাসুল (সা.) ছিলেন দয়ার সাগর। তিনি তাদের প্রতারণা আর কথার ফুলঝুরি ঠিকই বুঝতে পারেন। কিন্তু মুখের কোলে মুচকি হাসি ছাড়া আর কোনো জবাব দেন না।
তিনি মনে মনে হাসেন আর বলেন, হায়! কীভাবে এত কূটচালে তোমরা আমার সঙ্গে প্রতারণার জাল বিস্তার করছ। অথচ আমি তোমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য হরদম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাদের অনুরোধে বিরক্ত হয়ে একবার মনস্থ করলেন, হয়তো সেখানে যাবেন। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে দেয়া হলো, খবরদার! হে আল্লাহর রাসুল! এদের উদ্দেশ্য খারাপ। এরা সাহাবিদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য সিরিয়া থেকে সেই চিহ্নিত ইহুদিকে নিয়ে আসবে। ষড়যন্ত্রের গোট পাকানোর এটি আখড়া হিসেবে গড়ে তুলবে। নবীজি তাদের জঘন্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হলেও তিনি চাননি, তারা লজ্জিত হোক। তাদের ষড়যন্ত্রের কথা এত তাড়াতাড়ি ফাঁস হয়ে যাক। তাই তিনি বলেন, আমি তো তাবুক যুদ্ধে রওনা হওয়ার পথে আছি। এখন তো আমার সময় হবে না। যুদ্ধ থেকে ফিরে এলে দেখা যাবে। তোমাদের দাবি হয়তো তখন পূরণ করব।
নবী করিম (সা.) যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর দেখেন একই অবস্থা। কপট লোকেরা তাদের মসজিদে নিয়ে এর বৈধতা প্রমাণের জন্য যেন প্রাণপাত করবে। তারা যেন নাছোড়বান্দা। এবার আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে, হে নবী, তাদের গভীর ষড়যন্ত্রের কথা আপনি ফাঁস করে দিন। নির্দেশ পেয়ে নবীজি বলেন, ‘তোমরা মসজিদ নির্মাণ করেছ সত্য; কিন্তু এটি তো মসজিদ নয়, ষড়যন্ত্রের আখড়া। আমি তো সেখানে যেতে পারি না।’ এ কথা শুনে তাদের মাথায় যেন বাজ পড়ল। এমন মন্তব্য, এ ধরনের অভিযোগ মানতে রাজি হলো না মোনাফেকরা। তাদের মনের স্বচ্ছতার ব্যাপারে শপথ করে কোরআনের দোহাই দিতে লাগল। মওলানা রুমি বলেন, তাদের মধ্যে শপথের হিড়িক পড়ে গেল। কোরআনের দোহাই দিতে লাগল। আসলে কপট লোকদের অভ্যাসটাই হলো নিজেদের মতলব হাসিলের জন্য কথায় কথায় শপথ করা। আবার সেই শপথ ভঙ্গ করা তাদের জন্য কোনো ব্যাপার নয়।
শপথের এত হিড়িকের মধ্যে নবীজি দেখেন, তাদের দোষ গোপন করে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার যে পলিসি তিনি নিয়েছিলেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। তাই অগত্যা তাদের জব্দ করে বলেন, আমি কি তোমাদের শপথ বিশ^াস করব, নাকি আল্লাহর কথা সত্য বলে গ্রহণ করব? আমার কাছে যে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি আসে, তা উপলব্ধি করার শক্তি তোমাদের নেই। তাই এভাবে মিথ্যার ওপর ধৃষ্টতা দেখাতে পারছ।
মুফাসসির ও ইতিহাসবেত্তারা বলেন, মদিনার একটি গোত্র বনি আমর ইবনে উফ বিখ্যাত কুবা মসজিদ নির্মাণ করে এবং নবীজির কাছে মসজিদ উদ্বোধনের আবেদন জানায়। নবীজি তাদের অনুরোধে কুবা মসজিদে নামাজ পড়েন। এ দৃশ্য দেখে বনি গনম ইবনে উফের একটি গোত্রের লোকদের মধ্যে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। তারা ছিল কপট মুসলমান অর্থাৎ মোনাফেক। তারাও কুবা মসজিদের পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ইসলামের প্রতি শত্রুতা পোষণকারীরা সেখানে জড়ো হবে। তারা অপেক্ষায় ছিল আবু আমের ইহুদি রোম সম্রাটের কাছ থেকে ফিরে আসবে এবং এ মসজিদকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করবে। তিনি রোম সম্রাটের কাছে গিয়েছিলেন, মদিনায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাতে সম্রাটকে রাজি করানোর জন্য, যাতে তারা নবীজি ও মুসলমানদের মদিনা থেকে উৎখাত করতে পারে। কিন্তু মোনাফেকরা নবীজির কাছে গিয়ে একেবারে সাধু সেজে মসজিদ উদ্বোধন করার জন্য অনুরোধ জানায়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা তওবার ১১০ থেকে ১১৭ আয়াত নাজিল হয় এবং আল্লাহ তায়ালা পরিষ্কার বলে দেন, নামে মসজিদ হলে কী হবে এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দোজখের পুলের ওপর। সেই পুল হলো মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির কুমতলব।
বোঝা গেল, মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণের মতো মহৎ কাজ হলেও তা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হবে। নবী করিম (সা.) তখনই এ মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে ময়লার স্তূপ বানানোর নির্দেশ দেন। ইসলামের ইতিহাসের এত বড় ঘটনা প্রমাণ করে, মিথ্যা, কপটতা ও উদ্দেশ্য খারাপ হলে ইবাদতের কাজও ইসলামের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে যায়। কাজেই যে কোনো কাজে মনের স্বচ্ছতা, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হওয়া ও নিয়তের বিশুদ্ধতা অনিবার্য শর্ত।
(মসনবি শরিফ, দ্বিতীয় খ- ব-২৮২৫-২৯১০)