ইতিকাফ একটি গুরুত্বপূর্র্ণ ইবাদত। প্রিয়নবী (সা.) ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত নিয়মিত ইতিকাফ করেছেন। পরবর্তী সময় তাঁর সাহাবিরাও এ ধারা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু আফসোসের সঙ্গে বলতে হয়, বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর মাঝে এ ব্যাপারে শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়। অনেকের এ বিষয়ে ন্যূনতম ধারণাও নেই। বিলুপ্তপ্রায় এ আমলটির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ আবারও যেন আগের ধারায় ফিরে আসতে পারে, সেজন্য এ আলোচনা।
ইতিকাফ রমজানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আর রমজানের অন্যান্য করণীয় ইবাদত শেষে একজন রোজাদারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ইতিকাফ করা। তাই রোজার শেষ পর্যায়ে আনয়ন করা হয়েছে ইতিকাফ। সিয়াম সাধনা মানুষকে ত্যাগের ও কৃচ্ছ্রতা সাধনের শিক্ষা দেয়। ইতিকাফ দুনিয়া ত্যাগের প্রবণতা শিক্ষা দেয় আর মহান আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে বান্দাকে মহান আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে দেয়। ফলে মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। আলোচ্য অধ্যায়ে ইতিকাফ সম্পর্কে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে, ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীর জন্য আমার ঘর (বাইতুল্লাহ) পবিত্র রাখতে আদেশ করেছিলাম।’ (সূরা বাকারা : ১২৫)।
উম্মুল মোমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী (সা.) রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন, যতক্ষণ না মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে উঠিয়ে নেন। তারপর তাঁর স্ত্রীরা ইতিকাফ করেছেন। (বোখারি : ১৮৯৯; মুসলিম : ২৬৫০)।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। ১ বছর তিনি ইতিকাফ করতে পারলেন না। অতঃপর যখন পরবর্তী বছর এলো তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করলেন। (তিরমিজি : ৮০৩)।
অভিধানে কোনো স্থানে আটকে পড়া অথবা থেমে যাওয়াকে ইতিকাফ বলা হয়। শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ হলো, কোনো লোকের দুনিয়ার সংশ্রব, সম্পর্ক ও বিবি-বাচ্চা থেকে আলাদা হয়ে মসজিদে অবস্থান করা।
ইতিকাফ হচ্ছে মানুষ দুনিয়াবি কারবার ও সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং সাংসারিক কর্মব্যস্ততা ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চিন্তা-কাজের শক্তি ও যোগ্যতাকে মহান আল্লাহ তায়ালার স্মরণ এবং ইবাদতে লাগিয়ে দেবে। তারপর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতিবেশী হয়ে পড়বে। এ কাজের দ্বারা একদিকে সে ব্যক্তি সব বেহুদা কথাবার্তা ও মন্দকাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে এবং অন্যদিকে মহান আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। সে তার নৈকট্য লাভ করবে এবং তার ইয়াদ ও ইবাদতে মনে শান্তি লাভ করবে। কয়েকদিনের তরবিয়াতের এ আমল তার মনের ওপর এমন গভীর ছাপ ফেলবে যে, চারদিকে দুনিয়ার রঙ তামাশা ও মন ভুলানো বস্তুগুলো দেখার পরও মহান আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রাখতে পারবে।
মহান আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি থেকে বাঁচতে পারবে এবং তাঁর হুকুম পালন করে মনে আনন্দ অনুভব করবে। এমনিভাবে সমগ্র জীবন মহান আল্লাহ তায়ালার বন্দেগিতে কাটিয়ে দেবে।
ইসলামে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্তরকে একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি মনোনিবেশের প্রশিক্ষণ, সুন্নত নিয়মে দুনিয়া বিরাগী হওয়ার এবং লাইলাতুল কদর তালাশ করার ক্ষেত্রে ইতিকাফের বিকল্প নেই। প্রিয়নবী (সা.) প্রতি বছর রমজান মাসে ইতিকাফ করতেন। একদা রমজান মাসে ইতিকাফ ছুটে গেলে প্রিয়নবী (সা.) তা শাওয়াল মাসে কাজা করে নেন। প্রিয়নবী (সা.) এর ইন্তেকালের পর উম্মুল মোমিনিনরা ইতিকাফ করতেন।
উম্মুল মোমিনিন সায়্যিদাতুনা আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর রাসুল (সা.) কে মৃত্যু দান করার আগ পর্যন্ত তিনি নিয়মিতভাবে রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। তার পরে তাঁর পবিত্র আত্মা স্ত্রীরাও ইতিকাফ করতেন। ইতিকাফের সুন্নত হলো, অতি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হবে না। অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাবে না। নারীকে স্পর্শ করবে না।
মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ করবে না, রোজা ছাড়া ইতিকাফ করবে না। (রোজা ও তারাবি : ফাজাইল-মাসাইল, পৃষ্ঠা ১৩৮)।
উম্মুল মোমিনিন সায়্যিদাতুনা আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) রমজানের তৃতীয় দশকে কঠিন পরিশ্রম করতেন, যে রকম কঠোর পরিশ্রম অন্য সময়ে করতেন না। (মুসলিম : ১১৭৫)।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের ইতিকাফের সঠিক মর্ম বোঝার ও সে অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন।