হাদিসে নববিতে বিধৃত হয়েছে, প্রত্যেক জাতির কিছু খুশির দিন থাকে, ঈদ আমাদের খুশির দিন। (মুসলিম : ৮৯২)। প্রিয়নবী (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন যে, তাদের দুইটি উৎসবের দিন রয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুইটি দিন কীসের জন্য? তারা বলল, এ দুই দিনে অন্ধকার যুগে আমরা খেলাধুলা করতাম, আমোদ-ফুর্তি করতাম। এ কথা শুনে প্রিয় নবী (সা.) বললেন, আল্লাহ এ দুই দিনের পরিবর্তে অধিকতর উত্তম দুইটি দিন তোমাদের দিয়েছেন, আর তা হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। (সুনানে আবু দাউদ : ১১৩৪)। প্রখ্যাত হাদিস ব্যাখ্যাদাতা আল্লামা হাফিজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ঈদে আনন্দ প্রকাশ করা ধর্মের শিআর বা বৈশিষ্ট্যাবলির অন্যতম। (ফাতহুল বারি : ২/৪৪৩)। আল্লামা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.) বলেন, ঈদের দিন আনন্দ প্রকাশের পূর্ণতা হলো, সুন্দর কাপড় পরিধান করে একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বের হবে এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করবে। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ : ২/৩০)।
আমাদের কোনো কোনো বন্ধু জিজ্ঞেস করেন, ঈদের দিন ‘ঈদ মোবারক’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করার বিধান কী? আদৌ এর কোনো প্রমাণ আছে কিনা?
সংক্ষেপে এতটুকু বলা যায়, এ বিষয়ে নবীজি (সা.) থেকে স্পষ্ট কোনো কথা বর্ণিত হয়নি।
অবশ্য এ সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের আমল কী ছিল, তা বিবৃত হয়েছে। ঈদের দিন তারা পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। এতে তারা কোন বাক্য ব্যবহার করতেন? এর উত্তর শুনুন জুবাইর ইবনে নুফাইর থেকে। তিনি বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিরা ঈদের দিন একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে পরস্পরকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম।’ অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। হাফিজ ইবনে হাজার (রা.) বলেন, বর্ণনাটির সনদ হাসান। (ফাতহুল বারি : ২/৪৪৬)।
ইবনুত তুরকুমানি হানাফি (রা.) বলেন, এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিস আছে; যা বায়হাকি উল্লেখ করেননি। সেটি হলো মুহাম্মদ ইবনু জিয়াদের বর্ণনা। তিনি বলেন, আমি আবু উমামা বাহিলি এবং আরও কয়েকজন সাহাবির সঙ্গে ছিলাম। তারা যখন ঈদগাহ থেকে ফিরতেন তখন একে অপরকে বলতেন, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম। আহমাদ ইবনে হাম্বল (রা.) বলেন, বর্ণনাটির সনদ জায়্যিদ। (আল জাওহারুন নাকি : ৩/৩২০-৩২১)। ইবনে কুদামা (রা.)ও ইমাম আহমাদের এমন মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। (আল মুগনি : ২/২৫৯)।
আলি ইবনে সাবিত থেকে বর্ণিত, আমি ইমাম মালিক (রা.) কে ঈদের সময় ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ বলে লোকদের শুভেচ্ছা বিনিময় সম্পর্কে জিজ্ঞেসা করলাম। তিনি বললেন, আমাদের এখানে তো বিষয়টি এমনই চলে আসছে। (আল মুগনি; ইবনে কুদামা : ২/৫৯, আল হাওয়ি; সুয়ুতি : ১/৮২)।
শায়খুল ইসলাম হাফিজ ইবনে তাইমিয়া (রা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, ঈদ শুভেচ্ছার ক্ষেত্রে লোকমুখে প্রসিদ্ধ ‘ঈদ মোবারক’ বা এ জাতীয় বাক্যগুলোর শরয়ি কোনো ভিত্তি আছে না নাই? যদি থেকে থাকে তবে কী বলা উচিত?
উত্তরে তিনি বললেন, ঈদ শুভেচ্ছায় একজন আরেকজনকে দেখলে সালাতুল ঈদের পরে ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’, ‘আহালাহুল্লাহু আলাইক’Ñ এরকম কিছু বলা যায়। বস্তুত একদল সাহাবি এমনটা করতেন বলে বর্ণনা আছে। ফলে ইমাম আহমাদ প্রমুখ ইমামের দৃষ্টিতে এ ধরনের বলতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে আহমাদ বলেছেন, আমি নিজে থেকে আরম্ভ করি না, কেউ যদি বলে ফেলে তবে আমি উত্তর দিই। কেননা আগ বেড়ে এমন শুভেচ্ছা বিনিময় করা আদিষ্ট কোনো সুন্নাহ নয়। অবশ্য তা নিষিদ্ধ কোনো বিষয়ও নয়। তাই যে করবে তার দলিল রয়েছে। যে করবে না তার নিকটও দলিল রয়েছে। (আল ফাতাওয়াল কুবরা : ২/২২৮)।
আল্লামা আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল তাহতাওয়ি হানাফি (রা.) বলেন, ঈদ শুভেচ্ছায় সিরিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশের লোকেরা ‘ঈদ মোবারক আলাইক’ এ জাতীয় বাক্য বলতে অভ্যস্ত। সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত বাক্যের সঙ্গে এর মর্মগত মিল রয়েছে। ফলে সেটার মতো এটা বলাও জায়েজ ও ভালোকথাÑ এমন মন্তব্য করার সুযোগ আছে। (হাশিয়াতুত তাহতাওয়ি আলা মারাকিল ফালাহ শারহ নুরুল ঈযাহ, পৃ. ৫৩০)।
মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (রা.) বলেন, ঈদের দিন কারও সঙ্গে দেখা হলে মুহাদ্দিস মাকহুল (রা.) সম্ভাষণ জানাতেন ‘ইসফ্লিতা’ বলে। ইয়াহইয়া বলেন, ‘ইসফ্লিতা’ অর্থ আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন। (ইবনে মাঈন : ৪/৪৩৬)।
হাফিজ ইবনে হাজার (রাহ.) ‘তাকাব্বালাল্লাহ’ (আল্লাহ কবুল করুন) বাক্য ব্যবহারের কোরআনিক একটি দলিল পেশ করেছেন। তার ভাষায়, আল্লাহ তায়ালার যে কোনো নির্দেশ পালনের পর সেটা তার কাছে গৃহীত হওয়ার জন্য দোয়া করা চাই। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে নবী ইবরাহিম (আ.) সালাম এবং নবী ইসমাঈল (আ.) কর্তৃক কাবা গৃহ নির্মাণের পরে তাদের অবস্থা তুলে ধরেছেন। সূরা আলে বাকারার ১২৭নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম ও ইসমাঈল কাবা গৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিল, পরওয়ারদেগার! আমাদের থেকে কবুল করো। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ।’ (আত তাহনিয়া ফিল আয়াদ; ইবনে হাজার : ৪৪)।
এসব উদ্ধৃতি থেকে প্রতিভাত হচ্ছে, ঈদের শুভেচ্ছায় ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ বলাই শ্রেয়; যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম এভাবে বলতেন। তবে ঈদ মোবারক, ঈদ সাঈদ ইত্যাদি বাক্য ব্যবহার করলেও কোনো অসুবিধে নেই। কারণ লোকেরা এটা ইবাদত হিসেবে করে না, শুভেচ্ছা ও সম্মান প্রদর্শনের একটি প্রচলিত মাধ্যম এবং অভ্যাস হিসেবেই করে।
প্রসঙ্গত বলা যায়, বর্তমান বিশ্বের অনেক স্বনামধন্য ইসলামিক স্কলারকেও এমন বাক্যে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে আরবের বয়োবৃদ্ধ শায়খ ড. ইউসুফ আল কারযাবি হাফিজাহুল্লাহ এবং শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকি ওসমানি হাফিজাহুল্লাহর কথা তো উল্লেখ করাই যায়।