বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মানবসমাজে বর্ণবৈষম্য সর্বাপেক্ষা কদর্য ও অর্থহীন ব্যাপার। বর্ণ শুধু দেহের একটি বাহ্যিক গুণমাত্র; কিন্তু মনে রাখতে হবে, মানুষ মনুষ্যত্বের মর্যাদা তার দেহের জন্য লাভ করেনি, তার আত্মা ও মানবিকতাই হচ্ছে এ মর্যাদা লাভের একমাত্র কারণ। অথচ এর রঙ বা বর্ণ বলতে কিছু নেই। এ অবস্থায় মানুষের মধ্যে লাল, হলুদ, কৃষ্ণ ও শ্বেত প্রভৃতি বর্ণের দিক দিয়ে পার্থক্য করার কী যুক্তি থাকতে পারে?
মালকম এক্স একবার প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘আমেরিকাকে ইসালম পূর্ণরূপে বুঝতে হবে। কেননা ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা আমেরিকান সমাজ থেকে বর্ণবৈষম্য সমস্যা দূরীকরণে কার্যকরী সমাধান দিতে পারে।’
আসল কথা হলো, বর্ণবৈষম্যের সমাধানকল্পে ইসলামের হাতে রয়েছে সমূহ চাবি ও জরুরি উপাদান। যেমন
এক. ইসলাম একথা ভালো করে শিখিয়ে দিয়েছে যে, মানবশরীরের রঙ কিংবা গোষ্ঠী কারও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে না। পক্ষান্তরে এসব রঙ ও গোষ্ঠী বৈচিত্র্য মূলত একজন অপরজনকে পরিচয়ের উপাদানমাত্র। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে মানব, আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩)। এ আয়াত থেকে প্রতিভাত হয় যে, এ জাতীয় বৈচিত্র্য মূলত বৈষম্যের উপাদান নয়, বরং জ্ঞানের উপকরণমাত্র।
দুই. মানবশরীরে চামড়ার রঙ এবং আমাদের বৈচিত্র্যময় ভাষা ও স্বভাব মূলত আল্লাহরই দান; কেউ এগুলো নিজে থেকে করতে পারে না। আর এসব বৈচিত্র্য প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনাদির অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোম-ল ও ভূম-লের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সূরা রুম : ২২)।
তিন. ইসলাম এটাও শিক্ষা দেয় যে, পুরো মানবগোষ্ঠী মাটি থেকে সৃষ্ট। তো যেখানে আমরা সবাই একই উপকরণ থেকে সৃষ্ট, সেখানে একজন অপরজনের ওপর গর্ব করার কী আছে? সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আদমকে এক মুষ্টি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, যা তিনি সমগ্র জমিন থেকে সংগ্রহ করেছেন। ফলে আদম সন্তানরা জমিনের বিভিন্নতার মতোই এসেছে। তাদের মধ্যে সবই আছে লাল, সাদা, কালো, তাছাড়া নরম, শক্ত এবং ভালো ও মন্দ।’ (সুনানে তিরমিজি : ২৯৫৫)।
চার. আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে আমাদের চামড়ার রঙ কিংবা জাতিগোষ্ঠীর কোনো বিশেষত্ব কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। উপরন্তু আমাদের কার্যকলাপ এবং আমল-আখলাকই হলো পরস্পরের মাঝে বিশেষত্বের প্রমাণ। বিদায় হজের ভাষণে নবীজি (সা.) এ প্রসঙ্গটি খুব পরিষ্কার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমাদের পালনকর্তা এক আল্লাহ। তোমাদের আদি পিতা এক আদম (আ.)। মনে রেখো! অনারবের ওপর আরবের, আরবের ওপর অনারবের এবং শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের ও কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনোই বিশেষত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শুধু আল্লাহভীতি ও ধর্মপালনের দিক দিয়েই এ বিশেষত্ব হতে পারে। আমি কি আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিলাম? সাহাবিরা সমস্বরে বলে উঠলেন হ্যাঁ, আপনি আল্লাহর বাণী আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। (মুসনাদে আহমাদ : ২২৯৭৮)।
পাঁচ. সাহাবি জাবির ইবনে মুতঈম (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আভিজাত্যবোধ ও হিংসাদ্বেষের জন্য যে লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়, যে লোক সেদিকে অন্যদের আহ্বান জানায় এবং সেজন্য যে যুদ্ধ-সংগ্রাম করে, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হতে পারে না।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৫১২১)।
ছয়. উপর্যুক্ত শিক্ষাগুলো প্রিয় নবী (সা.) মুখে বলে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং তাঁর গোটা জীবনে এসব বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন। চিন্তা করুন! যে আরব সমাজে অনারবদের ঘৃণারপাত্র বানিয়ে রাখা হয়েছিল, যেখানে কালোরঙের মানুষগুলোকে অমানুষ ভাবা হতো, সেই সমাজে নবীজি (সা.) ইথিওপিয়ান সাহাবি হজরত বিলাল (রা.) কে ইসলামের সর্বপ্রথম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন বায়তুল্লাহর ছাদের ওপর নবীজির নির্দেশে বিলাল যখন আজান দিতে শুরু করলেন, মক্কাবাসী মোশরেকরা যেন লজ্জায় ও ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। তারা বলছিল, মুহাম্মদ কি এ কৃষ্ণাঙ্গ কাক ছাড়া আর কাউকে আজান দেয়ার মতো পেলেন না?! কিন্তু প্রিয় নবী (সা.) দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, ‘মানুষ হিসেবে সবাই সমান। বর্ণের ভিত্তিতে নয়, শুধু তাকওয়া বা আল্লাহভীতির বিচারেই শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত হয়।’ (দালায়িলুন নুবুওয়াহ; বায়হাকি : ৫/৭৮)।
সাত. পার্থিব বিচারে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পেশার চেয়ে কি নিম্নমানের আর কোনো পেশা আছে? সেই পেশার একজন কর্মীর প্রতি নবীজির গুরুত্ব প্রদান হয়তো অনেককে অবাক করবে। কিন্তু নবীজি তাঁর শিক্ষা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন। সমাজের কাউকে হেয় করতে নেই। কালো বর্ণের একজন মহিলা মসজিদে নববিতে ঝাড়– দিতেন এবং পরিচ্ছন্নতার কাজ আঞ্জাম দিতেন। সেই মহিলা মারা গেলে সাহাবায়ে কেরাম এই ভেবে যে, তার মৃত্যুর সংবাদ নবীজিকে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়, তারা নবীজিকে অবগত করলেন না। কিছুদিন পর নবীজি সেই মহিলার খোঁজ নিলে তারা বলেন, সে তো মারা গেছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তবে কেন তোমরা আমাকে জানালে না? তিনি সোজা মহিলার কবরের দিকে ছুটলেন। নিয়মের ঊর্ধ্বে নবীজির বিশেষত্ব হিসেবে তার কবর পাশে ফের জানাজার নামাজ পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলে দিলেন, ‘যে কোনো মুসলমান মারা গেলে তোমরা অবশ্যই আমাকে জানাবে।’ (সহিহ ইবনে খুজায়মা : ১২৯৯, আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি : ৬৯৮১)।