ঢাকা , শনিবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিরাত সাহিত্যে আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.)

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) উপমহাদেশের এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। আল্লাহর মনোনীত জীবনবিধান ইসলামের প্রচার-প্রসার, হেফাজত এবং চর্চা, অধ্যয়ন, গবেষণা তথা দ্বীন ইসলামকে প্রবহমান রাখার পেছনে যাদের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ইতিহাসের আলোকে তাই তিনি এক মহান কর্মতৎপর মহাপুরুষ হিসেবে নন্দিত। মানবসমাজের জীর্ণ, ঘুণে ধরা কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি অমিত তেজধারী বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত, শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়, হৃদয় গভীরে বরণীয়। তার পুরো নাম শায়খ আবদুল হক সাইফুদ্দিন ইবনে সাদুল্লাহ ইবনে আগা মুহাম্মদ তুর্ক আল-বোখারি আদ-দেহলভি আল-হানাফি (রহ.)। ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ শহর দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করার কারণেই তাকে দেহলভি বলা হয়। তিনি ৯৫৮ হিজরি মতান্তর ১৫৫১ সালে ইসলাম শাহ শুরির রাজত্বকালে দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

সিরাত সাহিত্যে আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) এর অবদান অনেক বেশি। সিরাত বা মহানবী (সা.) এর জীবন চরিত ওপর আবদুল হক দেহলভি (রহ.) ‘মাদারেজুন নবুওয়াত’ নামক বিশাল ও ব্যাপক গ্রন্থ রচনা করে কালোত্তীর্ণ মর্যাদা লাভ করেন। তদানীন্তন ভারতের আলোড়ন সৃষ্টিকারী সুবৃহৎ সিরাতগ্রন্থ এটি। এতে তিনি মহানবী (সা.) এর জীবনের বিভিন্ন দিক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আকবর কর্তৃক ইসলামের অবমাননা লক্ষ্য করে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেন। এতে খতমে নবুয়তের ওপর বলিষ্ঠ যুক্তি ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া রাসুল (সা.) এর আখলাক-উপদেশগুলো, পরিবার-পরিজন এবং তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনার বিবরণও এতে বিধৃত হয়েছে। এ গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় রচিত।

আবদুল হক দেহলভি (রহ.) যখন ‘মাদারেজুন নবুওয়াত’ গ্রন্থ রচনা করেন, তখন ভারতের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। এ সময় সম্রাট আকবরের ফেতনা মুসলিম মিল্লাতের জন্য অনেক বড় ক্ষতি ডেকে আনে। আকবর রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দ্বীনবিরোধী বিভিন্ন কর্মকা-ে লিপ্ত হন। মোল্লা মুবারক নাগোরি ও তার পুত্রদ্বয় আবুল ফজল ও ফৈজি আকবরের এ ভ্রান্ত পরিকল্পনায় সহায়তা করেন। তিনি অন্যদের কাছ থেকেও নতুন ধর্ম প্রবর্তনের বুদ্ধি-পরামর্শ গ্রহণ করেন। এ দ্বীন-ই-ইলাহীর মূলমন্ত্র ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবারু খলিফাতুল্লাহ।’ আকবর স্বকল্পিত ধারণা অনুযায়ী স্থির করেন যে, মুহাম্মদ (সা.) এর দ্বীনের সময়সীমা ১ হাজার বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আর তার এ মতবাদকে ‘আলফি’ মতবাদ বলা হয়।

আকবরের এ দ্বীন-ই-ইলাহী এবং আলফি মতবাদের ছদ্মাবরণে শিরক ও ধর্মহীন কার্যকলাপ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে মুসলিম সমাজ ভ্রষ্টতার ধূম্রজালে পরিবেষ্টিত হয়। ঠিক এ সময় আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) মাদারেজুন নবুওয়াত গ্রন্থ রচনা করে এ মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার এ বলিষ্ঠ লেখনী ছিল এক বিরাট আন্দোলন। তিনি মাদারেজুন নবুওয়াত গ্রন্থে আকবরের আলফি মতবাদকে ভ্রান্ত ও অসার প্রমাণিত করেন। রাসুল (সা.) এর শেষ নবী হওয়া এবং তার রিসালাত কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকাকে অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত করেছেন। কেননা খতমে নবুয়ত বিষয়টি এমন অকাট্য যে, এর ওপর প্রত্যেক মুসলমানের ঈমান আনা ফরজ। তিনি প্রমাণ করেন, পূর্ববর্তী আসমানি কিতাব তথা তাওরাত ও ইনজিলে রাসুল (সা.) এর শেষ নবী হওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং অন্যান্য নবী তার উম্মত হওয়ার বাসনাও প্রকাশ করেছেন।

তদানীন্তন যুগে আলফি মতবাদ যেহেতু খতবে নবুয়তের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাই আবদুল হক দেহলভি (রহ.) কোরআন-সুন্নাহর আলোকে খতমে নবুয়তকে প্রতিষ্ঠা করে এ ভ্রান্ত মতবাদ খ-ন করেন। তিনি এ মর্মে কোরআন থেকে বহু আয়াত প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তন্মধ্যে কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো ‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী।’ (সূরা আহজাব : ৪০)। ‘আর আল্লাহ যখন নবীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন, আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি কিতাব ও জ্ঞান এবং অতঃপর তোমাদের কাছে কোনো রাসুল আসেন তোমাদের কিতাবকে সত্য বলে দেওয়ার জন্য, তখন সে রাসুলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তার সাহায্য করবে।’

তিনি বললেন, ‘তোমার কি অঙ্গীকার করছ এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহণ করে নিয়েছ? তারা বলল, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছি।’ তিনি বললেন, তাহলে এবার সাক্ষী থাক। আর আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী রইলাম।’ (সূরা আলে ইমরান : ৮১)। আবদুল হক দেহলভি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন সব নবী থেকে নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.) এর নবুয়তের প্রতি এ মর্মে অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে যে, তার জীবদ্দশা থেকে কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে এবং যারা তার আগে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন তারাও নবুয়তের অধীন। তিনি এ মতের সমর্থনে কোরআনের নিম্নে আয়াতটি উল্লেখ করেন। ‘হে রাসুল! আপনি বলুন, হে মানবজাতি! তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসুল।’ (সূরা আরাফ : ১৫৮)।

আবদুল হক দেহলভি (রহ.) মাদারেজুন নবুওয়াতের বিভিন্ন স্থানে ঈসা (আ.) এর বাণী, ইনজিলের উদ্ধৃতি এবং পূর্ববর্তী নবীদের সহিফার বাক্যাগুলো উল্লেখ করে খতমে নবুয়ত প্রমাণ করেছেন। আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) এ গ্রন্থে খতমে নবুয়তের প্রমাণস্বরূপ অনেক হাদিস দ্বারা বিন্যাস ঘটিয়েছেন। কয়েকটি হাদিস নিম্নরূপ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার ও আমার পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্ত হলো ওই ব্যক্তির মতো, যিনি উত্তমরূপে একটি ঘর বানিয়েছেন এবং সুন্দরভাবে তা সাজিয়েছেন। তবে ফাঁকা রেখেছেন এক কোণে একটি ইটের জায়গা। তখন লোকেরা তা প্রদক্ষিণ করতে লাগল এবং অভিভূত হয়ে বলতে লাগল, এই ইটটি কেন লাগানো হলো না? নবীজি বললেন, আমি হলাম সে ইটটি। আর আমিই শেষ নবী।’ (বোখারি : ৩৫৩৫)।

আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রিসালাত ও নবুয়তের ধারা সমাপ্ত হয়েছে। সুতরাং আমার পরে কোনো রাসুল নেই এবং আমার পরে কোনো নবীও নেই।’ (তিরমিজি : ২২৭২)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব দিতেন নবীরা। কোনো নবীর ইন্তেকাল হলে আরেক নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোনো নবী নেই। তবে অচিরেই অনেক খলিফা হবেন, যারা সংখ্যায় থাকবেন অনেক।’ (বোখারি : ৩৪৫৫)। জুবাইর ইবনে মুতঈম (রা.) তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি হলাম ‘আক্কিব’। আর ‘আক্কিব তিনিই, যার পরে আর কোনো নবী নেই।’ (মুসলিম : ২৩৫৪)।

তিনি মাদারেজুন নবুওয়াত গ্রন্থে আকবরের আলফি মতবাদ বা সহস্রাব্দ চিন্তাভাবনা অসার প্রমাণ করেন। এভাবে আবদুল হক (রহ.) এর লেখনীর দ্বারা দ্বীন-ই-ইলাহী মুখ থুবড়ে পড়ে এবং ভারতীয় মুসলমান এ ফেতনা থেকে রক্ষা পায়। অনুরূপভাবে মাদারেজুন নবুওয়াত গ্রন্থে মহানবী (সা.) এর জীবনের সব দিক বিস্তারিত আলোচনা করায় মুসলমান সবাই দ্বীন সম্পর্কীয় তাদের ভ্রান্ত আকিদা শুদ্ধ করে নেয়। কারণ কোন কাজ শরিয়ত সমর্থিত আর কোন কাজ শরিয়তবিরোধী এ গ্রন্থ পাঠে তারা সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) এই ব্যাপক ও বিশাল সিরাত গ্রন্থ রচনা করে ভারতীয় মুসলমান তথা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর বিরাট উপকার সাধন করেন। এ গ্রন্থ সমগ্রকালের ও সব যুগের মানুষের এক মহামূল্যবান সম্পদ। এ মহান সাধক ও সংস্কারক ১০৫২ হিজরি মতান্তর ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

লেখক : শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা, ঢাকা

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

সিরাত সাহিত্যে আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.)

আপডেট টাইম : ০২:৫৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) উপমহাদেশের এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। আল্লাহর মনোনীত জীবনবিধান ইসলামের প্রচার-প্রসার, হেফাজত এবং চর্চা, অধ্যয়ন, গবেষণা তথা দ্বীন ইসলামকে প্রবহমান রাখার পেছনে যাদের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ইতিহাসের আলোকে তাই তিনি এক মহান কর্মতৎপর মহাপুরুষ হিসেবে নন্দিত। মানবসমাজের জীর্ণ, ঘুণে ধরা কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি অমিত তেজধারী বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত, শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়, হৃদয় গভীরে বরণীয়। তার পুরো নাম শায়খ আবদুল হক সাইফুদ্দিন ইবনে সাদুল্লাহ ইবনে আগা মুহাম্মদ তুর্ক আল-বোখারি আদ-দেহলভি আল-হানাফি (রহ.)। ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ শহর দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করার কারণেই তাকে দেহলভি বলা হয়। তিনি ৯৫৮ হিজরি মতান্তর ১৫৫১ সালে ইসলাম শাহ শুরির রাজত্বকালে দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

সিরাত সাহিত্যে আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) এর অবদান অনেক বেশি। সিরাত বা মহানবী (সা.) এর জীবন চরিত ওপর আবদুল হক দেহলভি (রহ.) ‘মাদারেজুন নবুওয়াত’ নামক বিশাল ও ব্যাপক গ্রন্থ রচনা করে কালোত্তীর্ণ মর্যাদা লাভ করেন। তদানীন্তন ভারতের আলোড়ন সৃষ্টিকারী সুবৃহৎ সিরাতগ্রন্থ এটি। এতে তিনি মহানবী (সা.) এর জীবনের বিভিন্ন দিক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আকবর কর্তৃক ইসলামের অবমাননা লক্ষ্য করে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেন। এতে খতমে নবুয়তের ওপর বলিষ্ঠ যুক্তি ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া রাসুল (সা.) এর আখলাক-উপদেশগুলো, পরিবার-পরিজন এবং তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনার বিবরণও এতে বিধৃত হয়েছে। এ গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় রচিত।

আবদুল হক দেহলভি (রহ.) যখন ‘মাদারেজুন নবুওয়াত’ গ্রন্থ রচনা করেন, তখন ভারতের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। এ সময় সম্রাট আকবরের ফেতনা মুসলিম মিল্লাতের জন্য অনেক বড় ক্ষতি ডেকে আনে। আকবর রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দ্বীনবিরোধী বিভিন্ন কর্মকা-ে লিপ্ত হন। মোল্লা মুবারক নাগোরি ও তার পুত্রদ্বয় আবুল ফজল ও ফৈজি আকবরের এ ভ্রান্ত পরিকল্পনায় সহায়তা করেন। তিনি অন্যদের কাছ থেকেও নতুন ধর্ম প্রবর্তনের বুদ্ধি-পরামর্শ গ্রহণ করেন। এ দ্বীন-ই-ইলাহীর মূলমন্ত্র ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবারু খলিফাতুল্লাহ।’ আকবর স্বকল্পিত ধারণা অনুযায়ী স্থির করেন যে, মুহাম্মদ (সা.) এর দ্বীনের সময়সীমা ১ হাজার বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আর তার এ মতবাদকে ‘আলফি’ মতবাদ বলা হয়।

আকবরের এ দ্বীন-ই-ইলাহী এবং আলফি মতবাদের ছদ্মাবরণে শিরক ও ধর্মহীন কার্যকলাপ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে মুসলিম সমাজ ভ্রষ্টতার ধূম্রজালে পরিবেষ্টিত হয়। ঠিক এ সময় আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) মাদারেজুন নবুওয়াত গ্রন্থ রচনা করে এ মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার এ বলিষ্ঠ লেখনী ছিল এক বিরাট আন্দোলন। তিনি মাদারেজুন নবুওয়াত গ্রন্থে আকবরের আলফি মতবাদকে ভ্রান্ত ও অসার প্রমাণিত করেন। রাসুল (সা.) এর শেষ নবী হওয়া এবং তার রিসালাত কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকাকে অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত করেছেন। কেননা খতমে নবুয়ত বিষয়টি এমন অকাট্য যে, এর ওপর প্রত্যেক মুসলমানের ঈমান আনা ফরজ। তিনি প্রমাণ করেন, পূর্ববর্তী আসমানি কিতাব তথা তাওরাত ও ইনজিলে রাসুল (সা.) এর শেষ নবী হওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং অন্যান্য নবী তার উম্মত হওয়ার বাসনাও প্রকাশ করেছেন।

তদানীন্তন যুগে আলফি মতবাদ যেহেতু খতবে নবুয়তের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাই আবদুল হক দেহলভি (রহ.) কোরআন-সুন্নাহর আলোকে খতমে নবুয়তকে প্রতিষ্ঠা করে এ ভ্রান্ত মতবাদ খ-ন করেন। তিনি এ মর্মে কোরআন থেকে বহু আয়াত প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তন্মধ্যে কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো ‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী।’ (সূরা আহজাব : ৪০)। ‘আর আল্লাহ যখন নবীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন, আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি কিতাব ও জ্ঞান এবং অতঃপর তোমাদের কাছে কোনো রাসুল আসেন তোমাদের কিতাবকে সত্য বলে দেওয়ার জন্য, তখন সে রাসুলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তার সাহায্য করবে।’

তিনি বললেন, ‘তোমার কি অঙ্গীকার করছ এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহণ করে নিয়েছ? তারা বলল, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছি।’ তিনি বললেন, তাহলে এবার সাক্ষী থাক। আর আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী রইলাম।’ (সূরা আলে ইমরান : ৮১)। আবদুল হক দেহলভি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন সব নবী থেকে নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.) এর নবুয়তের প্রতি এ মর্মে অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে যে, তার জীবদ্দশা থেকে কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে এবং যারা তার আগে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন তারাও নবুয়তের অধীন। তিনি এ মতের সমর্থনে কোরআনের নিম্নে আয়াতটি উল্লেখ করেন। ‘হে রাসুল! আপনি বলুন, হে মানবজাতি! তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসুল।’ (সূরা আরাফ : ১৫৮)।

আবদুল হক দেহলভি (রহ.) মাদারেজুন নবুওয়াতের বিভিন্ন স্থানে ঈসা (আ.) এর বাণী, ইনজিলের উদ্ধৃতি এবং পূর্ববর্তী নবীদের সহিফার বাক্যাগুলো উল্লেখ করে খতমে নবুয়ত প্রমাণ করেছেন। আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) এ গ্রন্থে খতমে নবুয়তের প্রমাণস্বরূপ অনেক হাদিস দ্বারা বিন্যাস ঘটিয়েছেন। কয়েকটি হাদিস নিম্নরূপ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার ও আমার পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্ত হলো ওই ব্যক্তির মতো, যিনি উত্তমরূপে একটি ঘর বানিয়েছেন এবং সুন্দরভাবে তা সাজিয়েছেন। তবে ফাঁকা রেখেছেন এক কোণে একটি ইটের জায়গা। তখন লোকেরা তা প্রদক্ষিণ করতে লাগল এবং অভিভূত হয়ে বলতে লাগল, এই ইটটি কেন লাগানো হলো না? নবীজি বললেন, আমি হলাম সে ইটটি। আর আমিই শেষ নবী।’ (বোখারি : ৩৫৩৫)।

আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রিসালাত ও নবুয়তের ধারা সমাপ্ত হয়েছে। সুতরাং আমার পরে কোনো রাসুল নেই এবং আমার পরে কোনো নবীও নেই।’ (তিরমিজি : ২২৭২)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব দিতেন নবীরা। কোনো নবীর ইন্তেকাল হলে আরেক নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোনো নবী নেই। তবে অচিরেই অনেক খলিফা হবেন, যারা সংখ্যায় থাকবেন অনেক।’ (বোখারি : ৩৪৫৫)। জুবাইর ইবনে মুতঈম (রা.) তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি হলাম ‘আক্কিব’। আর ‘আক্কিব তিনিই, যার পরে আর কোনো নবী নেই।’ (মুসলিম : ২৩৫৪)।

তিনি মাদারেজুন নবুওয়াত গ্রন্থে আকবরের আলফি মতবাদ বা সহস্রাব্দ চিন্তাভাবনা অসার প্রমাণ করেন। এভাবে আবদুল হক (রহ.) এর লেখনীর দ্বারা দ্বীন-ই-ইলাহী মুখ থুবড়ে পড়ে এবং ভারতীয় মুসলমান এ ফেতনা থেকে রক্ষা পায়। অনুরূপভাবে মাদারেজুন নবুওয়াত গ্রন্থে মহানবী (সা.) এর জীবনের সব দিক বিস্তারিত আলোচনা করায় মুসলমান সবাই দ্বীন সম্পর্কীয় তাদের ভ্রান্ত আকিদা শুদ্ধ করে নেয়। কারণ কোন কাজ শরিয়ত সমর্থিত আর কোন কাজ শরিয়তবিরোধী এ গ্রন্থ পাঠে তারা সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) এই ব্যাপক ও বিশাল সিরাত গ্রন্থ রচনা করে ভারতীয় মুসলমান তথা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর বিরাট উপকার সাধন করেন। এ গ্রন্থ সমগ্রকালের ও সব যুগের মানুষের এক মহামূল্যবান সম্পদ। এ মহান সাধক ও সংস্কারক ১০৫২ হিজরি মতান্তর ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

লেখক : শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা, ঢাকা