জাতীয় পার্টি দুর্বল হয়ে পড়েছে কেন

১৯৯০ সালে এইচ এম এরশাদের সরকারের পতনের পরও তাঁর দল জাতীয় পার্টি (জাপা) বেশির ভাগ সময় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গেই ছিল। এর পরও ক্রমে দলটি এতটাই দুর্বল হয়েছে যে এককভাবে নির্বাচন করার সামর্থ্যও এখন আর সে রকম নেই। বিশ্লেষকদের মতে, জাপা শুধু দুর্বলই হয়নি, পথও হারিয়েছে। সরকারঘনিষ্ঠ হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা দলটিকে ‘জনবিচ্ছিন্ন’ করে ফেলছে।

জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন দুটি বিষয় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। একটি হচ্ছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দলটি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না? অন্যটি হচ্ছে, রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের রাজনৈতিক জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে পড়েছেন। এরপর দলটির নেতৃত্বে কে আসবেন? গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

এরশাদপত্নী রওশন এরশাদ তাঁর নেতৃত্বে জাপাকে বিভক্ত করেছেন। দলের নেতাদের একাংশ দলীয় চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে নির্বাচনে যাওয়া, সমঝোতার পরও বিগত নির্বাচনে মাত্র ১১ আসনে বিজয়ী হওয়া এবং দলের শীর্ষ পর্যায়ে দ্বন্দ্ব-কোন্দলের কারণে জাপায় সন্দেহ-অবিশ্বাস বেড়েছে। কোন্দল নিরসন করে দলকে এখন ঐক্যবদ্ধ রাখাটাই দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা

জাপা নেতা ও রাজনৈতিক পর্যবক্ষেকদের অনেকে বলছেন, ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাপা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। নির্বাচনপ্রক্রিয়ার শুরু থেকে জাপা নেতৃত্ব সরকার ও নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সমালোচনা করে জনগণের মধ্যে যে ধারণা তৈরি করেছে, শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারেনি। ফলে মাঠ পর্যায়ে তাদের জনপ্রিয়তা আরো কমেছে।

কেন জাপা দুর্বল হয়েছে, এর অন্তর্নিহিত কারণ সম্পর্কে রাজনৈতিক বোদ্ধা, দলীয় নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে দলীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে জাপা নেতৃত্ব। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য দলটিতে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

এ ছাড়া বারবার দলে ভাঙন, শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতা, নেতৃত্বের কোন্দল, সরকারঘেঁষা রাজনৈতিক চরিত্র, গতিহীন সংগঠন, মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্বের দুর্বলতা, নেতৃত্বের উত্থান-পতন এবং দলগতভাবে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চরিত্র তৈরি করতে না পারায় বিরোধী দল হয়েও জাপা এখন খুবই দুর্বল।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন, ১৯৯০ সালের পর জাতীয় পার্টি ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাঁর দলে সরকারি দলের এজেন্ট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি শীর্ষ নেতৃত্ব

এরশাদ আমলে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এমন দুজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে জাপাকে ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন মামলার ভয় দেখিয়ে এরশাদকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। ফলে জীবনের শেষ বেলায় এসে জেলের জীবন থেকে বাঁচতে ক্ষমতাধর দলগুলোর সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। এরশাদের পরবর্তী নেতৃত্বও ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার লোভ সংবরণ করতে পারেনি। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার আড়ালে রাজনৈতিক সমঝোতা করেছে তারা।

রওশন এরশাদকে বিএনপি সরকারের আমলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ বলে জানত সবাই। তিনি ওই সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন এমন কথা বলাবলি ছিল রাজনৈতিক মহলে। বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সখ্য হয় রওশনের। জাতীয় পার্টিকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিতে আওয়ামী লীগ সরকার রওশনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে আলোচনা আছে।

তবে শুধু রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও ব্যক্তিস্বার্থের কারণেই জাপা দুর্বল হয়নি বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সার্বিকভাবে দেশকে বিরাজনৈতিকীকরণের যে প্রক্রিয়া, তার অংশীদার হয়েছে জাপা। বিরাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়ায় সামনে সব বিরোধী দলই হারিয়ে যাবে। রাজনীতি বলতে দেশে কিছু থাকবে না।

সাত দফা ভাঙন

এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ভেঙে জন্ম নিয়েছে জেপি, বিজেপি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নামের তিনটি নিবন্ধিত দল। জাতীয় পার্টি (জাফর) নামের আরেকটি অনিবন্ধিত দল সক্রিয় রয়েছে। অতীতে সক্রিয় ছিল জাতীয় পার্টি (জা-মো) এবং জাতীয় পার্টি (না-ফি) নামের দুটি অংশ। সর্বশেষ গত ৯ মার্চ রওশন এরশাদ সম্মেলন করে নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা দেন। ফলে আরেকবার ভাঙন তৈরি হয় জাপায়। বারবার ভাঙনে দলের ভিত নষ্ট হয়েছে বলে মনে করছেন জাপা নেতারা।

তাঁরা মনে করেন, ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে গিয়ে এসব ভাঙন হয়েছে। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাপা প্রতিষ্ঠা করেন তখনকার সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, প্রতিষ্ঠার ৩৮ বছর পর জাপা এখন ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দলের নেতাকর্মীদের নীতি-আদর্শ ও দায়বদ্ধতার খুবই অভাব। শীর্ষ নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত। এ ছাড়া রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের পর জাপার হাল ধরার মতো যোগ্য উত্তরসূরিও দেখা যাচ্ছে।

জানতে চাইলে জি এম কাদের কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দল ভাঙার চেষ্টা করে। জাতীয় পার্টির বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সঠিক রাজনীতি করতে গেলেই সরকার বারবার দল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এ ছাড়া দমন-পীড়নসহ বিভিন্ন কারণে বিরোধী দলগুলোর রাজনীতির সুযোগ এখন সংকুচিত হয়ে এসেছে।

সংসদে আসন কমছে, ভূমিকাও দুর্বল

এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে জাপা। এর দুই বছরের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই ভোট বর্জন করায় জাপা ২৫১ আসন নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। কিন্তু এর পর থেকে জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা কমতে থাকে।

১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জয়ী হয় ৩৫ আসনে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পায় ৩২টি; ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে জোট করে জাতীয় পার্টি পায় মাত্র ১৪ আসন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে ২৭টি; ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেটি আরো কমে দাঁড়ায় ২২-এ। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মাত্র ১১ আসন পায় জাপা।

গত কয়েকটি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে থেকেও তাদের ভূমিকা স্পষ্ট নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরে একই সঙ্গে সরকারে এবং বিরোধী দলে ছিল জাপা। ফলে সংসদে তাদের কার্যকর কোনো ভূমিকা ছিল না। সরকারের মন্ত্রিসভায় থেকে কিভাবে বিরোধী দলের কার্যক্রম চালাবে জাপা তা নিয়ে ওই সময় অনেক সমালোচনা হয়েছে। এরপর ২০১৮ সালের সরকারে না থাকলেও সরকারের সঙ্গে তাদের এক ধরনের বোঝাপড়া ছিল।

সমঝোতার মাধ্যমে সরকার তাদের ২৬ আসনে ছাড় দেয়। ফলে ওই সংসদেও জাপা প্রধান বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকায় ছিল না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জাতীয় সংসদে তাদের এই ভূমিকা দল হিসেবে জাপাকে আরো গুরুত্বহীন করে তোলে। এর আগে ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের অংশ ছিল জাপা। মন্ত্রিসভায় ছিলেন তাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য। যদিও তখন প্রধান বিরোধী দল ছিল বিএনপি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিকে কবর দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে সংসদে বিরোধী দল বলতেও কেউ থাকবে না।

দুর্গেও দুর্বল জাপা

জাপার দুর্গ বলে পরিচিত বৃহত্তর রংপুরেও তাদের অবস্থা আগের মতো নেই। একসময় ওই অঞ্চলে জাপা প্রার্থী মানেই বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ থাকলেও এখন সেই অবস্থান বদল হয়েছে। রাজনৈতিক নানা সমীকরণে তাদের প্রার্থীদের বিজয়ী হতে হয়। এবার রওশনপন্থী নেতা রংপুর-১ আসনে মসিউর রহমান রাঙ্গা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে গেছেন; রংপুর-২, ৪, ৫ ও ৬ আসনেও বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। গাইবান্ধায় হেরে গেছেন জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারীর মতো আলোচিত প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতা হলেও বেশির ভাগ আসনে হেরেছে দলটি। জামানত হারিয়েছেন জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদেরসহ বেশির ভাগ প্রার্থী।

ওয়ান-ইলেভেনের পর ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ১৮ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি সরকারের দমন-পীড়নে বেশ বিপর্যস্ত। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল হলেও জাতীয় সংসদে নেই। বিএনপির এই অনুপস্থিতিতে জাপা কেন অবস্থান তৈরি করতে পারল না তা নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক সমালোচনা আছে।

জি এম কাদের কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারের নানা প্রতিবন্ধকতা, বারবার দল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়নের কারণে জনগণের কাছে গিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ সেভাবে থাকে না। ফলে জনগণও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা।

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর