প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় এক বছর অতিক্রম হলেও কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি পাট। বরং এটাকে এ পণ্যের তালিকায় (লিস্ট) নিতে তৈরি হয়েছে জটিলতা। আর এ জটিলতার জন্ম দিয়েছে খোদ বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। তারা নতুন পণ্য তালিকাভুক্তির এখতিয়ার কোন মন্ত্রণালয়ের অধীন, তা না জেনেই ভুল জায়গায় চিঠি চালাচালি করছেন।
পাটপণ্যকে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের তালিকাভুক্তির বিষয়ে কয়েক ধাপে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পর সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুরোধ করেছে বস্ত্র মন্ত্রণালয়। এবারও তাদের আবেদন সঠিক জায়গায় হয়নি। কারণ এ সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই এ বিষয়ে বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে হবে। তবেই সার্কুলার জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গেল বছরের মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ এর সফল বাস্তবায়ন উপলক্ষে সম্মাননা প্রদান এবং বহুমুখী পাটপণ্য মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, পাট কৃষিজাত পণ্য। অন্যসব পণ্য, যার সঙ্গে কৃষির একটু সম্পর্ক সেগুলোও কৃষিপণ্য হিসেবে বিশেষ সুবিধা পায়, আর পাট পায় না, এটা তো বোঝানো যায় না। আমি ঘোষণা দিতে চাই, আমাদের পাটপণ্য ও পাটকে আমরা কৃষিজাত পণ্য হিসেবেই বিবেচনা করব।
এরপরই মূলত পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্তির আলোচনা শুরু হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত পাট পণ্যকে প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্যকরণ সংক্রান্ত সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার আলোকে অবিলম্বে পাটজাত পণ্যকে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যে তালিকাভুক্ত করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে পুনরায় অনুরোধ জানাতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গেল ৪ মে অনুষ্ঠিত সভায় ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মোঃ হায়দার আলী মোল্লা স্বাক্ষরিত চিঠিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে পাটজাত পণ্যকে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যে তালিকাভুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। তখন কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, এটি তাদের আওতায় নয়, এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব।
জানা গেছে, বর্তমানে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রফতানির বিপরীতে এ খাতের উদ্যোক্তারা সরকার থেকে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা (ভর্তুকি) পাচ্ছেন। কিন্তু পাট দ্রব্যাদি রফতানি খাতে ভর্তুকি মিলছে কম। বর্তমানে বৈচিত্র্যময় পাটজাত পণ্য রফতানির বিপরীতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা মিললেও পাটজাত চূড়ান্ত দ্রব্য তথা হেসিয়ান, সেকিং ও সিবিসি রফতানিতে নগদ সহায়তা মিলছে সাড়ে ৭ শতাংশ। এছাড়া পাট সুতা রফতানিতে এ সহায়তা মিলছে মাত্র ৫ শতাংশ। কাজেই পাট প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেই এ খাতের সব পণ্যে উদ্যোক্তারা ২০ শতাংশ নগদ সহায়তার সুবিধা লাভ করবেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আগে থেকেই পাট দ্রব্যদি রফতানি খাতের উদ্যোক্তারা নগদ সহায়তা পেয়ে আসছেন। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক সার্কুলারও রয়েছে। এখন তা প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের তালিকাভুক্ত হলে পৃথক সার্কুলার জারির প্রয়োজন হবে। কিন্তু তার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা প্রয়োজন। কারণ বিভিন্ন খাতে যেসব নগদ সহায়তা দেয়া হয়, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়, সরকার থেকেই দেয়া হয়। তাই সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত আসতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো ফিরতি চিঠিতে বলা হয়েছে, যেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে নতুন নতুন পণ্যকে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং সে মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করা হয়ে থাকে। বিষয়টি বিবেচনায় পাট পণ্যকে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এম বারিক খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, পাটকে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করা দীর্ঘদিনের দাবি। এটি এখন বাস্তবায়ন হওয়ার পথে। এতে যে শুধু ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন সেটি সত্য নয়। কারণ পাটের সঙ্গে কৃষক জড়িত। পাটকে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হলে এ খাতের ভর্তুকির হার বাড়বে। ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে পাটের লড়াইয়ের উদ্যোক্তা নাসিমূল আহসান বলেন, পাট প্রকৃত পক্ষেই কৃষিপণ্য। এটি মাঠের ফসল হলেও কৃষকের পণ্য এটি। ফলে কৃষিপণ্য হিসেবে পাটকে আরও আগেই ঘোষণা করা উচিত ছিল।
তিনি বলেন, পাটের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। পাটে সুযোগ সুবিধা বাড়লে এসব মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে পাট যে এক সময় বাংলাদেশের সোনালী আঁশ ছিল এটি আবার পুনরুজ্জীবিত হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় ৬৪ ধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রয়েছে। সব ধরনের পাটপণ্য কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে এ সংখ্যা উন্নীত হবে ৬৫টিতে।