ঢাকা , শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বানের পানিত তলে আচি কেউ ইলিপ দেয় না

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ  দুই চোখের দৃষ্টির সীমানায় শুধুই পানি আর পানি। আকাশ আর নদী মনে হয় এক হয়ে মিশে আছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক শ’ বন্যার্ত পরিবার। সবার চোখে-মুখে হতাশার ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চুলোয় আগুন নেই। পাতিলে চাল নেই। শিশু এবং বৃদ্ধ মানুষের করুণ চাহনিতে যে কারো চোখ ভিজে যাবে। উপায় নেই। এখানে সবাই নিরুপায়। বানের পানি ঘরের মধ্যে প্রবেশ না করলে হয়তো কেউ এখানে আসতো না। পানি এসেছে তাই তারা ঘর ছেড়েছে। তাদের একজন সাহেব আলী। বললেন, ‘একদিন কামলা না দিলে বউ-ছোলের পেট ভাত দেখে না। যদি অন্য কোনো উপায় থাকলো হিনি তাইলে আগেই জমি কিনে বাড়ি করলেম হিনি। এখন তোমরাই কও দেখি হামরা এখন কুনটি যামু বাপু। বানের পানিত তলে আচি কেউ ইলিপ দিবের আসে না’- কথাগুলো তার একার নয় উপজেলার নদীপারের সব মানুষের।
তাজো বেওয়া শত বছরের সীমা অতিক্রম করেছেন। গায়ে-গতরে জিয়ে থাকা কিঞ্চিত শক্তিতে কোনোমতে চলাফেরা করতে পারেন। চল্লিশ বছর আগে যখন তার বয়স ষাট সেসময় স্বামীকে চিরদিনের জন্য হারান। এরপর একে একে কাছের অনেক স্বজন, নিজের সন্তানকেও হরিয়ে ফেলেন তিনি। বর্তমানে ছোট ছেলে ছাড়া তার আর কেউ নেই। ছেলে বিশা প্রামানিকের সংসারেই এখন তার জীবন কাটছে। ঘরের ভেতর তিন সপ্তাহ আগে পানি ঢুকেছে। এখন তার ঘরের মধ্যে বুক পরিমাণ পানি। ছেলের সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছোট্ট একটি ঘরে এখন তার বাস। শোনালেন তার জীবন কাহিনী। সংসার শুরুর সময় তাদের সবকিছুই ছিল। গোয়াল ভরা গরু, পুকুরে মাছ, জমির ফসল সবই ছিল। সময়ের নির্মম পরিহাসে এসব এখন তার কাছে কেবলই স্মৃতি। অতীতের দিনগুলোর কথা মনে হয়ে এখন তার চোখে কেবলই পানি ঝরে। হাজারো সুখময় দৃশ্য ঝাঁপসা হয়ে ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়। যমুনা নদীর তীর থেকে বেশ দূরেই ছিল তাদের আবাস ভূমি, চাষের মাঠ। যমুনার করালগ্রাস ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে আসতে থাকে। ভাঙতে থাকে মাটি, নদীর পাড়, ফসলের মাঠ। একদিন নদী এসে ঠেকে তাদের উঠান সীমায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্ষুধার্ত নদীর পেটে চলে যায় স্বপ্নে গড়া সংসারের সবকিছু। বুদ্ধি হারিয়ে যায়। বাকরুদ্ধ তাজোর চোখে তখন ফুটে ওঠে হতাশার ছাপ। চরেই আবার গড়ে তোলে থাকার ঘর। বছর দুইয়েক পরে সেই ঘরেও হানা দেয় যমুনা। এভাবে আরো পাঁচবার ভেঙে যায় স্বপ্ন। এক জায়গায় ঘর তুলে বছরের পর বছরও অবস্থান করতে পারে না। নদী এসে বাঁধ সাধে। ভেঙে দেয় ঘর-সংসার। কেড়ে নেয় স্বপ্নের সব রঙ। তার পরেও তারা নদীর কাছেই থেকে যায়। নদী তাদের সঙ্গে শত্রুতা করলেও জীবনের অংশ হিসেবে চরবাসী নদীকে অনেক আপন করে নিয়েছে। সব শেষে সারিয়াকান্দির কুতুবপুর এলাকায় ছেলে বিশা এক টুকরো জমি কিনে ঘর বেঁধেছে। চলতি বন্যায় সেই ঘরের মধ্যে এখন বুক পরিমাণ পানি। নদীর সঙ্গে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করে বাঁচতে হচ্ছে তাদের। উপায় না পেয়ে বাঁধেই বেঁধেছেন বাসা। সারিয়াকান্দির কুতুবপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। উপজেলার মথুরাপাড়া বাজারের দক্ষিণ থেকে শুরু করে কামালপুরের দড়িপাড়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছোট ছোট ঘর তুলে আশ্রয় নিয়েছে তাজো বেওয়াদের মতো কয়েক শ’ পরিবার। ওই পরিবারগুলোয় এখন চলছে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি জ্বালানির তীব্র সংকট। পানি বাহিত রোগ ডায়েরিয়া, আমাশয়, পাচড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। নৌকা যোগে অনেক দূর থেকে টিউবওয়েলের পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। খাবার স্যালাইন, জরুরি ওষুধ হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। অপর দিকে গবাদিপশুর খাদ্যসংকটও দেখা দিয়েছে এসব এলাকায়।
এখানে বসবাসকারী পরিবারের প্রধানদের অধিকাংশ কৃষক। তারা অন্যের জমিতে কাজ করে উপার্জন করে সংসার চালায়। পাশাপাশি পশুপালন করে। বর্তমানে ফসলের জমি পানির নিচে ঢুবে যাওয়ায় তারা বেকার হয়ে পড়েছে। কাজ না থাকায় অর্থসংকটের করুণ দশাও এখন তাদের সামনে হাজির হয়েছে। দু’মুঠো ভাত এক বেলা জুটছে তো দুই বেলা কাটছে না খেয়ে। তাজো বেওয়াদের অসময়ে কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে তিনি জানালেন, ‘ভোটের মদে হাংগেরে কাছোত কত নোক আসে, বানের পানিত তলে যাচ্চি এখন কেউ দেকপারো আসে না’।

বানভাসীদের বসবাস এখন নৌকায়
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, জলমগ্ন হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের চিলমারী। বানভাসী মানুষজনের উঠানে পানি ঘরে পানি চারদিকেও থৈ থৈ করছে পানি আর পানি। ঠাঁইও নেই পরিবেশও নেই উঁচু স্থানে বসবাস করবার। রমনা সোনারীপাড়া, ব্যাকমারা, চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানের সব উঁচু স্থানও ভরে গেছে বেশির ভাগ পরিবারের থাকাও ঠাঁই নেই। শুধু তাই নয় আছে চোর ডাকাতের ভয়। গরু-ছাগল ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতেও পারছে না অনেক পরিবার। তাই বাধ্য হয়েই বিভিন্ন স্থানের বানভাসী মানুষ পরিবারপরিজন নিয়ে নৌকায় পেতেছে বাসতবাড়ি। তাদের রান্নাবান্না, নাওয়া-খাওয়া, থাকার ভরসা এখন নৌকা। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে চিত্রগুলো। বন্যায় আক্রান্ত পরিবারগুলো প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নৌকার ওপরেই বাসা বেঁধে মানবেতর জীবনযাপন করছে; কেউ শুকনা খাবার কেউ একবেলা রান্না করে পার করছে দিনরাত। বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও চিলমারী উপজেলা সদরসহ চলাঞ্চলগুলো জলমগ্ন থাকায় বিস্তীর্ণ জনপদে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। নৌকার ওপর বসবাসরত পরিবারের মহিলারা জানিয়েছেন পরিবারপরিজন নিয়ে ছোট নৌকায় বসবাস করতে তাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণের জন্য চলছে হা-হা কার। এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ বানভাসী মানুষের মাঝে জোটেনি একমুটো ত্রাণের চাল। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে অনেক পরিবারের। এসব ঘর ছাড়া মানুষগুলোর হাতে প্রায় ১ মাস থেকে কাজ না থাকায় খেয়ে না খেয়ে নৌকা বিহীন পরিবারগুলো কেউ মাচা পেতে, কেউ রাস্তার ওপর খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারী পর্যায়ে সীমিত ত্রাণ-তৎপরতা শুরু হলেও বিপুলসংখ্যক বানভাসীর ভাগ্যে জুটছে না তা। রমনা ঘাট সোনারীপাড়া এলাকার রহিমা, ফরিদা জানান, ঘরেও কোমর পানি তাই থাকি এখন নৌকার ওপর খাই খালি শুকনা খাবার। একই এলাকার মমতাজ, ফকির চাঁদ জানান প্রায় ১২ দিন থেকে পানিবন্দি থাকলেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি একমুটো ত্রাণের চাল। উপজেলা বাস্তবায়ন অফিসার মো. সিরাজুদ্দৌলা জানান, এ পর্যন্ত বানভাসী মানুষের মাঝে ৫৫ টন চাল ও ১০০ পরিবারের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ২৪ টন চাল হাতে রয়েছে তা অতিশিগগিরই বিতরণ করা হবে। এদিকে পাউবো সূত্রে জানা গেছে, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমলেও তা বিপদ সীমার ২১ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নৌকাই ভরসা ভল্লবপুরবাসীর
ওসমানীনগর (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, চারদিকে অথৈ পানি। বিশাল হাওরের মাঝে একটি গ্রাম। যে কেউ দেখলে ভাববে এটি একটি ছোট হাওড়। এ বারের বন্যায় সিলেটের ওসমানীনগরের পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নের ভল্লবপুর গ্রাম একটি অঘোষিত হাওড়ে পরিণত হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই গ্রামের  অন্তত আড়াইশ পরিবারের বসবাসকারি মানুষ। কেউ কৃষি কাজ, মাছ ধরা ও দিনমজুরি করে জীবিকানির্বাহ করে থাকেলেও গত আড়াই মাস ধরে এ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কাজ না পেয়ে বড় দুর্ভোগে জীবনযাপন করছে।
জানা গেছে, ওসমানীনগর  উপজেলার পৈলনপুর ইউনিয়নের ভল্লবপুর গ্রামের সাধারণ মানুষ প্রায় আড়াই মাস ধরে পানিবন্দি হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে হলে নৌকা ছাড়া বিকল্প নেই। কাজকর্ম না থাকায় গ্রামের প্রায় সবারই আয় রোজগারের পথ বন্ধ। এখন পর্যন্ত ত্রাণ বলতে ঈদের আগে ৮-১০টি পরিবারের মধ্যে সামান্য গম ও ঈদের পরে ১১টি পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল ও এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য ইয়াহ্‌ইয়া চৌধুরীর উদ্যোগে এক কেজি পরিমাণ চিড়া এবং সিলেট জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে কয়েকটি পরিবারকে ৩০০-৫০০ টাকা এবং সর্বশেষ গত বুধবার ৪৫ জনকে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। এর বাইরে গ্রামের মানুষের বড় একটি অংশ এখনও কোনো ত্রাণ-সহায়তা পায়নি।
গ্রামের একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচন আসলে সবাই পানি ভেঙে আসেন ভোট চাইতে কিন্তু এখন আমরা খেয়ে না খেয়ে আছি তা কোন জনপ্রতিনিধির চোখে পড়ে না।
স্থানীয় ১নং ওয়ার্ড মেম্বার রইছ উল্যা বলেন, এই গ্রামের  আড়াইশ পরিবারের বসবাস। প্রায় আড়াই মাস ধরে বন্যাকবলিত থাকলেও অধিকাংশ লোকের ভাগ্যে কোনো ত্রাণ জোটেনি।
পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, দুদফা বন্যায় পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নের মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ভল্লবপুর গ্রামকে ছোট হাওড় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ গ্রামের প্রায় সবাই গরিব। পর্যাপ্ত ত্রাণ না থাকায় অধিকাংশ পরিবারই সাহায্য থেকে বঞ্চিত।
শাহজাদপুরের সহশ্রাধিক
বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন
শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, শাহজাদপুর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল সোনাতনী ও কৈজুরী ইউনিয়নের পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক ভাঙনে শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গত ২০ দিনে প্রায় এক হাজার বাড়ি-ঘর যমুনা গিলে ফেলেছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কোথায় চলে গেছে তা কেউ বলতে পারে না। সরজমিন এলাকা ঘুরে দেখা যায় সোনাতনী ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের শতাধিক পরিবার, বানতিয়ার ২ শতাধিক, চামতাঁরা ৩ শতাধিক, ধীতপুর ১৫০টি পরিবার এবং কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাচিল গ্রামের শতাধিক পরিবার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যান্যবারের তুলনায় এবার সবচেয়ে বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকার  অনেক মানুষ নৌকায় করে তাদের মাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। তাদের সীমাহীন কষ্ট শুধু চোখে দেখা ছাড়া আর কিছু যেন করার নয়। চামতাঁরা, শ্রীপুর, ধীতপুর গ্রামের হজরত আলী, চাঁন মিয়া ও আব্দুর রাজ্জাক মেম্বার জানান, ছোট চামতাঁরা ও বড় চামতাঁরা গ্রামে প্রায় ৩ হাজার ৫শত ভোটার সম্পূর্ণ গ্রাম ছিল যা এখন নদীগর্ভে বিলীন। শত শত পরিবারের গ্রামের লোকজনেরা যমুনার ভাঙনে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছে। বাব-দাদার পৈতৃক ভিটা ছেড়ে যমুনার ভাঙ্গনের তাড়া খেয়ে শত শত পরিবারের লোকজনেরা এলাকা ছেড়ে কোথায় চলে গেছে তা কেউ বলতে পারে না। সোনাতনী ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান জানান, ভাঙনে ৬/৭টি গ্রাম নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে এবং কৈজুরী ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম জানান, গত ২০ দিনে বন্যার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হলে তারা বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলীমুন রাজীব জানান, ভাঙনকবলিত বিভিন্ন গ্রাম আমরা পরিদর্শন করেছি। বন্যা পরবর্তী পুর্নবাসনের জন্য তালিকা তৈরি করে তাদের বাসস্থান করা হবে। এদিকে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের যে করুণ চিত্র যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ধীতপুর গ্রামের জোমেলা খাতুন (৮০) জানান, দিনের আলোতে ভালো থাকলেও রাতের বেলায় আমাদের যে কষ্ট হয় তা কাউকে বোঝানো যাবে না।

২দিনেও সিরাজগঞ্জে ভাঙা বাঁধ নিয়ন্ত্রণ হয়নি
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জে নির্মাণাধীন নদী তীর রক্ষা বাঁধের ভাঙন স্থান শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি পাউবো। ওই স্থান দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের বাহুকা চৌধুরীবাড়ি এলাকায় নির্মাণাধীন নদী তীর রক্ষা বাঁধের রিং বাঁধের ২০ মিটার ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। ঘটনার পর রাত ২টা থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড়ে অবস্থিত সেনা ক্যাম্পের ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একজন মেজরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ৪৫ সদস্যের একটি টিম বাঁধ সংস্কারে কাজ শুরু করে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত বাঁধের ভাঙন অংশে  ২টি নৌকা দিয়ে পানি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে বাঁশের পাইলিং, বালিভর্তি জিওব্যাগ ও প্লাস্টিকের বস্তা ফেলে ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু বিকালে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় স্রোতের গতি বেড়ে নৌকাসহ ভাঙন স্থানের একটি বড় অংশ আবারও পানিতে ভেসে যায়। শনিবার সকাল থেকে আবারো সংস্কার কাজ শুরু হয়। সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে থাকা পাউবো’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাবুল চন্দ্র শীল জানান, ২০ মিটার ভাঙন স্থান এখনো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি রাত ১০টা নাগাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।   পুরাতন নদী তীর রক্ষা বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় চলতি বছরের মে মাসে ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭৪০ মিটার দীর্ঘ এ রিং বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ইতিমধ্যে বাঁধের ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ভাঙন স্থানটি বাঁধ ও একটি সংযোগ রাস্তার সংযোগস্থল। সঠিক সময়ে নির্মাণাধীন বাঁধের বাকি ২০ ভাগ কাজ শেষ না হওয়ায় এবং বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়ায় পাউবো ও ঠিকাদারকেই দুষছেন স্থানীয়রা। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে যমুনা নদীর পানি প্রবল বেগে প্রবেশ করায় বাহুকা, ইটালি, সিমলা, বালিঘুগরি, চিলগাছা, ভেওয়ামারা, গজারিয়া ও পাঁচ ঠাকুরীসহ আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে এসব এলাকার রাস্তাঘাট ও শত শত বসতবাড়ি। বেশ কিছু আতঙ্কিত লোকজন ইতিমধ্যে বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। অনেকেই বসতভিটা রেখে বাঁধ ও আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।

কুড়িগ্রামে ভাঙন: কর্মহীন মানুষ
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কুড়িগ্রামে কমতে শুরু করেছে সবক’টি নদ-নদীর পানি। এরফলে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এখনো নিম্নাঞ্চলে পানি থাকায় কর্মজীবী মানুগুলো কর্মহীন হয়ে পরেছে। হাতে টাকা না থাকায় ধারদেনা ও ত্রাণের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাদেরকে। ধরলা, তিস্তাসহ সবক’টি নদ-নদীর পানি কমলেও চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শনিবার দুপুরে চিলমারীর কড়াই বরিশাল চরে আলম মিয়ার স্ত্রী আছিয়া বেগম (২৭) সাপের দংশনে মৃত্যুবরণ করেন। এনিয়ে চলতি বন্যায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪ জনে।
পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। গত দুদিনে  রাজীবপুরের কোদালকাটি, রাজারহাটের বিদ্যানন্দ, চিলমাারীর নয়ারহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় আরো দুই শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে। বিশুদ্ধ পানি, শিশু খাদ্যের  সংকটের পাশাপাশি পশুখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এই ইউনিয়নের সর্দারপাড়া গ্রামের কৃষক কাচু মিয়া (৪৫) জানান, গরু-ছাগল বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা খরচ করি ২ বিঘা জমিতে পটল লাগাইছি। ৩০/৩৫ হাজার টাকার পটল বিক্রি করতে পারছি। এরমধ্যে বন্যা আসি সব শেষ করি দিছে। একই কথা জানালেন, হোসেন আলী (৫৬)। তারও ২৪ শতক জমির পটল  ক্ষেতের একই অবস্থা।
জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, নদ-নদীর পানি কমে যাওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বন্যাকবলিত পরিবারের তালিকা করা হচ্ছে। চাহিদা মোতাবেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। কুড়িগ্রামের বন্যা পরস্থিতি দেখতে  রোববার (আজ) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, এ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মহাপরিচালক কুড়িগ্রাম আসছেন। তারা উলিপুর ও চিলমারী উপজেলায় দুর্গত এলাকা পরিদর্শন ও ১ হাজার পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবেন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

বানের পানিত তলে আচি কেউ ইলিপ দেয় না

আপডেট টাইম : ০৪:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ জুলাই ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ  দুই চোখের দৃষ্টির সীমানায় শুধুই পানি আর পানি। আকাশ আর নদী মনে হয় এক হয়ে মিশে আছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক শ’ বন্যার্ত পরিবার। সবার চোখে-মুখে হতাশার ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চুলোয় আগুন নেই। পাতিলে চাল নেই। শিশু এবং বৃদ্ধ মানুষের করুণ চাহনিতে যে কারো চোখ ভিজে যাবে। উপায় নেই। এখানে সবাই নিরুপায়। বানের পানি ঘরের মধ্যে প্রবেশ না করলে হয়তো কেউ এখানে আসতো না। পানি এসেছে তাই তারা ঘর ছেড়েছে। তাদের একজন সাহেব আলী। বললেন, ‘একদিন কামলা না দিলে বউ-ছোলের পেট ভাত দেখে না। যদি অন্য কোনো উপায় থাকলো হিনি তাইলে আগেই জমি কিনে বাড়ি করলেম হিনি। এখন তোমরাই কও দেখি হামরা এখন কুনটি যামু বাপু। বানের পানিত তলে আচি কেউ ইলিপ দিবের আসে না’- কথাগুলো তার একার নয় উপজেলার নদীপারের সব মানুষের।
তাজো বেওয়া শত বছরের সীমা অতিক্রম করেছেন। গায়ে-গতরে জিয়ে থাকা কিঞ্চিত শক্তিতে কোনোমতে চলাফেরা করতে পারেন। চল্লিশ বছর আগে যখন তার বয়স ষাট সেসময় স্বামীকে চিরদিনের জন্য হারান। এরপর একে একে কাছের অনেক স্বজন, নিজের সন্তানকেও হরিয়ে ফেলেন তিনি। বর্তমানে ছোট ছেলে ছাড়া তার আর কেউ নেই। ছেলে বিশা প্রামানিকের সংসারেই এখন তার জীবন কাটছে। ঘরের ভেতর তিন সপ্তাহ আগে পানি ঢুকেছে। এখন তার ঘরের মধ্যে বুক পরিমাণ পানি। ছেলের সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছোট্ট একটি ঘরে এখন তার বাস। শোনালেন তার জীবন কাহিনী। সংসার শুরুর সময় তাদের সবকিছুই ছিল। গোয়াল ভরা গরু, পুকুরে মাছ, জমির ফসল সবই ছিল। সময়ের নির্মম পরিহাসে এসব এখন তার কাছে কেবলই স্মৃতি। অতীতের দিনগুলোর কথা মনে হয়ে এখন তার চোখে কেবলই পানি ঝরে। হাজারো সুখময় দৃশ্য ঝাঁপসা হয়ে ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়। যমুনা নদীর তীর থেকে বেশ দূরেই ছিল তাদের আবাস ভূমি, চাষের মাঠ। যমুনার করালগ্রাস ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে আসতে থাকে। ভাঙতে থাকে মাটি, নদীর পাড়, ফসলের মাঠ। একদিন নদী এসে ঠেকে তাদের উঠান সীমায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্ষুধার্ত নদীর পেটে চলে যায় স্বপ্নে গড়া সংসারের সবকিছু। বুদ্ধি হারিয়ে যায়। বাকরুদ্ধ তাজোর চোখে তখন ফুটে ওঠে হতাশার ছাপ। চরেই আবার গড়ে তোলে থাকার ঘর। বছর দুইয়েক পরে সেই ঘরেও হানা দেয় যমুনা। এভাবে আরো পাঁচবার ভেঙে যায় স্বপ্ন। এক জায়গায় ঘর তুলে বছরের পর বছরও অবস্থান করতে পারে না। নদী এসে বাঁধ সাধে। ভেঙে দেয় ঘর-সংসার। কেড়ে নেয় স্বপ্নের সব রঙ। তার পরেও তারা নদীর কাছেই থেকে যায়। নদী তাদের সঙ্গে শত্রুতা করলেও জীবনের অংশ হিসেবে চরবাসী নদীকে অনেক আপন করে নিয়েছে। সব শেষে সারিয়াকান্দির কুতুবপুর এলাকায় ছেলে বিশা এক টুকরো জমি কিনে ঘর বেঁধেছে। চলতি বন্যায় সেই ঘরের মধ্যে এখন বুক পরিমাণ পানি। নদীর সঙ্গে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করে বাঁচতে হচ্ছে তাদের। উপায় না পেয়ে বাঁধেই বেঁধেছেন বাসা। সারিয়াকান্দির কুতুবপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। উপজেলার মথুরাপাড়া বাজারের দক্ষিণ থেকে শুরু করে কামালপুরের দড়িপাড়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছোট ছোট ঘর তুলে আশ্রয় নিয়েছে তাজো বেওয়াদের মতো কয়েক শ’ পরিবার। ওই পরিবারগুলোয় এখন চলছে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি জ্বালানির তীব্র সংকট। পানি বাহিত রোগ ডায়েরিয়া, আমাশয়, পাচড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। নৌকা যোগে অনেক দূর থেকে টিউবওয়েলের পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। খাবার স্যালাইন, জরুরি ওষুধ হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। অপর দিকে গবাদিপশুর খাদ্যসংকটও দেখা দিয়েছে এসব এলাকায়।
এখানে বসবাসকারী পরিবারের প্রধানদের অধিকাংশ কৃষক। তারা অন্যের জমিতে কাজ করে উপার্জন করে সংসার চালায়। পাশাপাশি পশুপালন করে। বর্তমানে ফসলের জমি পানির নিচে ঢুবে যাওয়ায় তারা বেকার হয়ে পড়েছে। কাজ না থাকায় অর্থসংকটের করুণ দশাও এখন তাদের সামনে হাজির হয়েছে। দু’মুঠো ভাত এক বেলা জুটছে তো দুই বেলা কাটছে না খেয়ে। তাজো বেওয়াদের অসময়ে কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে তিনি জানালেন, ‘ভোটের মদে হাংগেরে কাছোত কত নোক আসে, বানের পানিত তলে যাচ্চি এখন কেউ দেকপারো আসে না’।

বানভাসীদের বসবাস এখন নৌকায়
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, জলমগ্ন হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের চিলমারী। বানভাসী মানুষজনের উঠানে পানি ঘরে পানি চারদিকেও থৈ থৈ করছে পানি আর পানি। ঠাঁইও নেই পরিবেশও নেই উঁচু স্থানে বসবাস করবার। রমনা সোনারীপাড়া, ব্যাকমারা, চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানের সব উঁচু স্থানও ভরে গেছে বেশির ভাগ পরিবারের থাকাও ঠাঁই নেই। শুধু তাই নয় আছে চোর ডাকাতের ভয়। গরু-ছাগল ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতেও পারছে না অনেক পরিবার। তাই বাধ্য হয়েই বিভিন্ন স্থানের বানভাসী মানুষ পরিবারপরিজন নিয়ে নৌকায় পেতেছে বাসতবাড়ি। তাদের রান্নাবান্না, নাওয়া-খাওয়া, থাকার ভরসা এখন নৌকা। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে চিত্রগুলো। বন্যায় আক্রান্ত পরিবারগুলো প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নৌকার ওপরেই বাসা বেঁধে মানবেতর জীবনযাপন করছে; কেউ শুকনা খাবার কেউ একবেলা রান্না করে পার করছে দিনরাত। বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও চিলমারী উপজেলা সদরসহ চলাঞ্চলগুলো জলমগ্ন থাকায় বিস্তীর্ণ জনপদে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। নৌকার ওপর বসবাসরত পরিবারের মহিলারা জানিয়েছেন পরিবারপরিজন নিয়ে ছোট নৌকায় বসবাস করতে তাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণের জন্য চলছে হা-হা কার। এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ বানভাসী মানুষের মাঝে জোটেনি একমুটো ত্রাণের চাল। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে অনেক পরিবারের। এসব ঘর ছাড়া মানুষগুলোর হাতে প্রায় ১ মাস থেকে কাজ না থাকায় খেয়ে না খেয়ে নৌকা বিহীন পরিবারগুলো কেউ মাচা পেতে, কেউ রাস্তার ওপর খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারী পর্যায়ে সীমিত ত্রাণ-তৎপরতা শুরু হলেও বিপুলসংখ্যক বানভাসীর ভাগ্যে জুটছে না তা। রমনা ঘাট সোনারীপাড়া এলাকার রহিমা, ফরিদা জানান, ঘরেও কোমর পানি তাই থাকি এখন নৌকার ওপর খাই খালি শুকনা খাবার। একই এলাকার মমতাজ, ফকির চাঁদ জানান প্রায় ১২ দিন থেকে পানিবন্দি থাকলেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি একমুটো ত্রাণের চাল। উপজেলা বাস্তবায়ন অফিসার মো. সিরাজুদ্দৌলা জানান, এ পর্যন্ত বানভাসী মানুষের মাঝে ৫৫ টন চাল ও ১০০ পরিবারের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ২৪ টন চাল হাতে রয়েছে তা অতিশিগগিরই বিতরণ করা হবে। এদিকে পাউবো সূত্রে জানা গেছে, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমলেও তা বিপদ সীমার ২১ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নৌকাই ভরসা ভল্লবপুরবাসীর
ওসমানীনগর (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, চারদিকে অথৈ পানি। বিশাল হাওরের মাঝে একটি গ্রাম। যে কেউ দেখলে ভাববে এটি একটি ছোট হাওড়। এ বারের বন্যায় সিলেটের ওসমানীনগরের পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নের ভল্লবপুর গ্রাম একটি অঘোষিত হাওড়ে পরিণত হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই গ্রামের  অন্তত আড়াইশ পরিবারের বসবাসকারি মানুষ। কেউ কৃষি কাজ, মাছ ধরা ও দিনমজুরি করে জীবিকানির্বাহ করে থাকেলেও গত আড়াই মাস ধরে এ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কাজ না পেয়ে বড় দুর্ভোগে জীবনযাপন করছে।
জানা গেছে, ওসমানীনগর  উপজেলার পৈলনপুর ইউনিয়নের ভল্লবপুর গ্রামের সাধারণ মানুষ প্রায় আড়াই মাস ধরে পানিবন্দি হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে হলে নৌকা ছাড়া বিকল্প নেই। কাজকর্ম না থাকায় গ্রামের প্রায় সবারই আয় রোজগারের পথ বন্ধ। এখন পর্যন্ত ত্রাণ বলতে ঈদের আগে ৮-১০টি পরিবারের মধ্যে সামান্য গম ও ঈদের পরে ১১টি পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল ও এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য ইয়াহ্‌ইয়া চৌধুরীর উদ্যোগে এক কেজি পরিমাণ চিড়া এবং সিলেট জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে কয়েকটি পরিবারকে ৩০০-৫০০ টাকা এবং সর্বশেষ গত বুধবার ৪৫ জনকে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। এর বাইরে গ্রামের মানুষের বড় একটি অংশ এখনও কোনো ত্রাণ-সহায়তা পায়নি।
গ্রামের একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচন আসলে সবাই পানি ভেঙে আসেন ভোট চাইতে কিন্তু এখন আমরা খেয়ে না খেয়ে আছি তা কোন জনপ্রতিনিধির চোখে পড়ে না।
স্থানীয় ১নং ওয়ার্ড মেম্বার রইছ উল্যা বলেন, এই গ্রামের  আড়াইশ পরিবারের বসবাস। প্রায় আড়াই মাস ধরে বন্যাকবলিত থাকলেও অধিকাংশ লোকের ভাগ্যে কোনো ত্রাণ জোটেনি।
পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, দুদফা বন্যায় পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নের মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ভল্লবপুর গ্রামকে ছোট হাওড় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ গ্রামের প্রায় সবাই গরিব। পর্যাপ্ত ত্রাণ না থাকায় অধিকাংশ পরিবারই সাহায্য থেকে বঞ্চিত।
শাহজাদপুরের সহশ্রাধিক
বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন
শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, শাহজাদপুর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল সোনাতনী ও কৈজুরী ইউনিয়নের পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক ভাঙনে শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গত ২০ দিনে প্রায় এক হাজার বাড়ি-ঘর যমুনা গিলে ফেলেছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কোথায় চলে গেছে তা কেউ বলতে পারে না। সরজমিন এলাকা ঘুরে দেখা যায় সোনাতনী ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের শতাধিক পরিবার, বানতিয়ার ২ শতাধিক, চামতাঁরা ৩ শতাধিক, ধীতপুর ১৫০টি পরিবার এবং কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাচিল গ্রামের শতাধিক পরিবার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যান্যবারের তুলনায় এবার সবচেয়ে বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকার  অনেক মানুষ নৌকায় করে তাদের মাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। তাদের সীমাহীন কষ্ট শুধু চোখে দেখা ছাড়া আর কিছু যেন করার নয়। চামতাঁরা, শ্রীপুর, ধীতপুর গ্রামের হজরত আলী, চাঁন মিয়া ও আব্দুর রাজ্জাক মেম্বার জানান, ছোট চামতাঁরা ও বড় চামতাঁরা গ্রামে প্রায় ৩ হাজার ৫শত ভোটার সম্পূর্ণ গ্রাম ছিল যা এখন নদীগর্ভে বিলীন। শত শত পরিবারের গ্রামের লোকজনেরা যমুনার ভাঙনে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছে। বাব-দাদার পৈতৃক ভিটা ছেড়ে যমুনার ভাঙ্গনের তাড়া খেয়ে শত শত পরিবারের লোকজনেরা এলাকা ছেড়ে কোথায় চলে গেছে তা কেউ বলতে পারে না। সোনাতনী ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান জানান, ভাঙনে ৬/৭টি গ্রাম নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে এবং কৈজুরী ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম জানান, গত ২০ দিনে বন্যার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হলে তারা বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলীমুন রাজীব জানান, ভাঙনকবলিত বিভিন্ন গ্রাম আমরা পরিদর্শন করেছি। বন্যা পরবর্তী পুর্নবাসনের জন্য তালিকা তৈরি করে তাদের বাসস্থান করা হবে। এদিকে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের যে করুণ চিত্র যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ধীতপুর গ্রামের জোমেলা খাতুন (৮০) জানান, দিনের আলোতে ভালো থাকলেও রাতের বেলায় আমাদের যে কষ্ট হয় তা কাউকে বোঝানো যাবে না।

২দিনেও সিরাজগঞ্জে ভাঙা বাঁধ নিয়ন্ত্রণ হয়নি
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জে নির্মাণাধীন নদী তীর রক্ষা বাঁধের ভাঙন স্থান শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি পাউবো। ওই স্থান দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের বাহুকা চৌধুরীবাড়ি এলাকায় নির্মাণাধীন নদী তীর রক্ষা বাঁধের রিং বাঁধের ২০ মিটার ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। ঘটনার পর রাত ২টা থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড়ে অবস্থিত সেনা ক্যাম্পের ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একজন মেজরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ৪৫ সদস্যের একটি টিম বাঁধ সংস্কারে কাজ শুরু করে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত বাঁধের ভাঙন অংশে  ২টি নৌকা দিয়ে পানি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে বাঁশের পাইলিং, বালিভর্তি জিওব্যাগ ও প্লাস্টিকের বস্তা ফেলে ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু বিকালে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় স্রোতের গতি বেড়ে নৌকাসহ ভাঙন স্থানের একটি বড় অংশ আবারও পানিতে ভেসে যায়। শনিবার সকাল থেকে আবারো সংস্কার কাজ শুরু হয়। সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে থাকা পাউবো’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাবুল চন্দ্র শীল জানান, ২০ মিটার ভাঙন স্থান এখনো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি রাত ১০টা নাগাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।   পুরাতন নদী তীর রক্ষা বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় চলতি বছরের মে মাসে ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭৪০ মিটার দীর্ঘ এ রিং বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ইতিমধ্যে বাঁধের ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ভাঙন স্থানটি বাঁধ ও একটি সংযোগ রাস্তার সংযোগস্থল। সঠিক সময়ে নির্মাণাধীন বাঁধের বাকি ২০ ভাগ কাজ শেষ না হওয়ায় এবং বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়ায় পাউবো ও ঠিকাদারকেই দুষছেন স্থানীয়রা। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে যমুনা নদীর পানি প্রবল বেগে প্রবেশ করায় বাহুকা, ইটালি, সিমলা, বালিঘুগরি, চিলগাছা, ভেওয়ামারা, গজারিয়া ও পাঁচ ঠাকুরীসহ আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে এসব এলাকার রাস্তাঘাট ও শত শত বসতবাড়ি। বেশ কিছু আতঙ্কিত লোকজন ইতিমধ্যে বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। অনেকেই বসতভিটা রেখে বাঁধ ও আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।

কুড়িগ্রামে ভাঙন: কর্মহীন মানুষ
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কুড়িগ্রামে কমতে শুরু করেছে সবক’টি নদ-নদীর পানি। এরফলে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এখনো নিম্নাঞ্চলে পানি থাকায় কর্মজীবী মানুগুলো কর্মহীন হয়ে পরেছে। হাতে টাকা না থাকায় ধারদেনা ও ত্রাণের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাদেরকে। ধরলা, তিস্তাসহ সবক’টি নদ-নদীর পানি কমলেও চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শনিবার দুপুরে চিলমারীর কড়াই বরিশাল চরে আলম মিয়ার স্ত্রী আছিয়া বেগম (২৭) সাপের দংশনে মৃত্যুবরণ করেন। এনিয়ে চলতি বন্যায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪ জনে।
পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। গত দুদিনে  রাজীবপুরের কোদালকাটি, রাজারহাটের বিদ্যানন্দ, চিলমাারীর নয়ারহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় আরো দুই শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে। বিশুদ্ধ পানি, শিশু খাদ্যের  সংকটের পাশাপাশি পশুখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এই ইউনিয়নের সর্দারপাড়া গ্রামের কৃষক কাচু মিয়া (৪৫) জানান, গরু-ছাগল বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা খরচ করি ২ বিঘা জমিতে পটল লাগাইছি। ৩০/৩৫ হাজার টাকার পটল বিক্রি করতে পারছি। এরমধ্যে বন্যা আসি সব শেষ করি দিছে। একই কথা জানালেন, হোসেন আলী (৫৬)। তারও ২৪ শতক জমির পটল  ক্ষেতের একই অবস্থা।
জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, নদ-নদীর পানি কমে যাওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বন্যাকবলিত পরিবারের তালিকা করা হচ্ছে। চাহিদা মোতাবেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। কুড়িগ্রামের বন্যা পরস্থিতি দেখতে  রোববার (আজ) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, এ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মহাপরিচালক কুড়িগ্রাম আসছেন। তারা উলিপুর ও চিলমারী উপজেলায় দুর্গত এলাকা পরিদর্শন ও ১ হাজার পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবেন।