বাংলাদেশে আর কিছুদিন পরেই কোরবানির ঈদ। বিভিন্ন এলাকায় গরুর খামারিরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন হাটে গরু তোলার। তবে এ বছর সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় পশুপালনের খরচও বেড়েছে।
ফলে খামারি ও গরু ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, গরুর দাম বাড়তি থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোরবানির জন্য পশুর যে চাহিদা তার বিপরীতে সরবরাহ কি যথেষ্ট আছ
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় অবশ্য জানাচ্ছে, এ বছর চাহিদার চেয়েও বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে। কিন্তু পণ্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে গরুর দাম।
পশুর চাহিদা কত?
বাংলাদেশে গেলো বছর পশুর চাহিদা ছিল ১ কোটি ২১ লাখ। এর বিপরীতে কোরবানি হয়েছে ৯৯ লাখ।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ বছর চাহিদা ও যোগান দুটোই বাড়বে। মন্ত্রণালয়ের হিসেবে এ বছর কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত আছে ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি। কিন্তু সম্ভাব্য চাহিদা হবে প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ ৯৬ হাজার। সব মিলিয়ে কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকবে ২১ লাখের বেশি।
কোরবানির জন্য যেসব গবাদিপশু প্রস্তুত আছে তার মধ্যে ৪৮ লাখের বেশি হচ্ছে গরু ও মহিষ।
সবমিলিয়ে সম্প্রতি প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম তার দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, কোরবানির ঈদে গবাদিপশুর কোনো সংকট হবে না এবং বিশেষ করে গরুর জোগানও যথেষ্ট আছে।
খামারিরা কী বলছেন?
মাদারীপুরের কৃষক লিটন মিয়া। নিজ বাড়িতে ছোট্ট এক খামারে গরু পালেন তিনি। গেলো কোরবানির ঈদে ৬টি গরু থাকলেও এবার তিনি খামারে রেখেছেন ১০টি গরু। আশা করছেন ১০টি গরুই কোরবানির ঈদে বিক্রি হবে।
তবে দাম কেমন হবে, কতটা লাভ করতে পারবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে লিটনের মনে। তিনি বলছিলেন, ‘দাম তো এইবার বাড়বেই। এখন কেমন বাড়বে সেইটা বুঝতে পারছি না। খরচ যে হারে বাড়ছে, সেইটা উঠাতে পারবো কি-না সন্দেহ আছে।’
লিটন খান জানাচ্ছেন, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। ঘাসের উৎপাদন খরচ বেড়েছে, প্রতিটি পশু খাদ্যের দাম বেড়েছে। শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। সুতরাং গরুর দাম গতবারের তুলনায় এবার তারা বেশি চাইবেন।
লিটন মিয়ার মতো একই চিত্র মাদারীপুরের অন্য খামারগুলোতেও।
মাদারীপুরের আরেকজন গরুর খামারের উদ্যোক্তা সাদ্দাম হোসেন বলছেন, ভারত-মিয়ানমার থেকে গরু না আসলে এবারও গরুর বাজার চড়া থাকবে। আর বাজার চড়া থাকলে খামারিরা খরচ তুলে লাভ করতে পারবেন।
তিনি বলছেন, গত বছর মাঝারি সাইজের যেসব গরু তারা ১ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন, এবার সেই একই আকারের গরুর জন্য তারা দাম চাইছেন ১ লাখ পনেরো থেকে বিশ হাজার। অর্থাৎ প্রতি গরুতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দাম বেশি।
তবে দাম বেশি হলেও গরুর সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই।
মাদারীপুরের প্রাণিসম্পদ দপ্তর বলছে, এবারের ঈদে জেলাটিতে গরুর চাহিদা ৩৬ হাজার। কিন্তু সরবরাহ আছে প্রায় ৩৯ হাজার। অর্থাৎ তিন হাজার গরু উদ্বৃত্ত আছে।
প্রান্তিকভাবে খামার পর্যায়েই যখন গরুর দাম বাড়তি, তখন শেষ পর্যন্ত সেই দাম মধ্যস্বত্তভোগীদের হাত ঘুরে কোরবানির হাটগুলোতে কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
সরবরাহ এবং দাম কেমন?
মাদারীপুরে যে চিত্র, সারাদেশেও সেটা অনেকটা একইরকম। অর্থাৎ গরুর সরবরাহ বেশি কিন্তু দাম কম নেই। বরং দাম গত বছরের তুলনায় বাড়তি।
গাবতলী গরুর হাটে কথা হয় তৈয়ব আলী নামে একজন গরু বেপারীর সঙ্গে। তিনি গরু সংগ্রহ করেন কুষ্টিয়া ও পাবনাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে।
এ বছর তিনি ঢাকায় একশর বেশি গরু হাটে তোলার পরিকল্পনা করেছেন। অর্ধেক গরু ইতোমধ্যে সংগ্রহও করেছেন বিভিন্ন জেলা থেকে।
‘দেখলাম খামারিরা দাম বেশি চায়। গরু অনেক আছে। কিন্তু খরচের কারণে দাম বেশি। ধরেন, ১০ রাখ টাকা দামের গরু এবার ১২ লাখ টাকা। আর মাঝারি গরুতে প্রতি পিসে দাম বাড়তি বিশ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা।’ বলছিলেন, তৈয়ব আলী।
তিনি জানাচ্ছেন, এবার ছোট এবং বড় গরুর দাম তুলনামূলক বেশি হবে। কারণ এসব গরুর চাহিদা বেশি।
কিন্তু প্রান্তিকভাবে খামার পর্যায়েই যখন গরুর দাম বাড়তি, তখন শেষ পর্যন্ত সেই দাম মধ্যস্বত্তভোগীদের হাত ঘুরে কোরবানির হাটগুলোতে কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
সরকার কী বলছে?
এবার যে দাম বাড়বে সেটা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও স্বীকার করছে। তবে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলছেন, দাম যেন অযৌক্তিকভাবে না বেড়ে যায় সে বিষয়ে তারা ‘প্রচেষ্টা’ চালাবেন।
তিনি বলেন, ‘দাম নির্ধারণ তো আমরা করে দিতে পারি না। কিন্তু আমরা বলতে পারি উৎপাদন খরচ কত সেটা। যেমন গবাদি পশুর উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি প্রায় সাড়ে পাঁচশত টাকা। মাঝখানে মধ্যস্বত্ত্বভোগী আছে। তাদেরও খরচ আছে, লাভ ধরতে হয়। সেক্ষেত্রে তারা যৌক্তিক পর্যায়ে একটা দাম নিতে পারে।’
কিন্তু বাংলাদেশে গরুর হাটে দাম অনেকসময়ই হুহু করে বাড়তে দেখা যায়। কৃত্রিমভাবে গরুর সংকট তৈরি করে দাম বেড়ানোর চেষ্টা অতীতে দেখা গেছে। ফলে হাটগুলোতে শেষ পর্যন্ত গরুর দাম যৌক্তিক থাকবে তো?
‘আমরা হাটে প্রচার চালাবো। মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা যেন অতিরিক্ত দাম নিতে না পারে সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে আমরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দাম নিয়ে নজরদারির কথা বললেও বাস্তবে সেটার প্রভাব কতটা থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদিও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মনে করে এবার অনলাইনে, সরাসরি খামার এবং বাড়ি থেকে গরু কেনার পাশাপাশি কেউ চাইলে হাটে নেওয়ার আগে চলতি পথেও গরু বিক্রি করতে পারবে।
সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কিংবা অন্য কেউ যেন বাধা দিতে না পারে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। ফলে গরুর জন্য মানুষ শুধু হাট-বাজারের উপর আগের মতো আর নির্ভরশীল থাকবে না। এতে করে গবাদিপশুর দামের নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়াভাবে কারো হাতে থাকবে না।
তাছাড়া যেহেতু পশুর সরবরাহ বেশি, ফলে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধির সুযোগও কমে যাবে।
খবর বিবিসি বাংলা