ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহররম মাস প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) যা বলেছেন

আরবি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। ইসলামে মাসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। ইসলামপূর্ব যুগেও এ মাসকে মর্যাদাপূর্ণ বিবেচনা করা হতো। নবীজি (সা.) এ মাসকে আল্লাহর মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন।

তা ছাড়া এটি পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত সম্মানিত চারটি মাসের একটি। এ প্রসেঙ্গে  ইরশাদ হয়েছে, ‘আসমান ও জমিন সৃষ্টির সময় থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২। এর মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।
বিদায় হজের খুতবায় রাসুল (সা.) সম্মানিত এ মাসগুলোকে চিহ্নিত করে বলেন, তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক—জিলকদ, জিলহজ ও মহররম, অন্যটি হলো রজব। (বুখারি, হাদিস : ৩১৯৭, মুসলিম, হাদিস : ১৬৭৯)

এ মাসের অন্যতম একটি ফজিলতপূর্ণ দিবস হলো আশুরা। মুসলিম সমাজে মহররম এবং এই আশুরাকেন্দ্রিক নানা ভ্রান্তি ও রসম রেওয়াজের প্রচলন আছে, যা পরিহারযোগ্য। তাই এই মাসের করণীয় ও বর্জনীয় ১০টি বিষয় এ লেখায় তুলে ধরা হলো—

গুনাহ বর্জন করা

মহররম সম্মানিত চার মাসগুলোর একটি।

এই মাসগুলোতে নিজেদের ওপর জুলুম করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতার চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে? আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এই চার মাসের মধ্যে তোমরা (গোনাহ করে) নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)নফল রোজা রাখা

নফল রোজা রাখা এ মাসের অন্যতম আমল। নবীজি এই মাসের নফল রোজাকে সর্বোত্তম ঘোষণা করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।)

তাওবা-ইস্তিগফার করা

নফল রোজার পাশাপাশি মহররমের বিশেষ আমল হলো তওবা ইস্তিগফার করা। কেননা রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, মহররম আল্লাহর মাস। এই মাসে এমন একটি দিন রয়েছে, যেদিন আল্লাহ তায়ালা একটি সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করেছেন। (আশা করা যায়) সেদিন অন্যান্য সম্প্রদায়ের তাওবাও কবুল করা হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৪১)

তাই ক্ষমা পাওয়ার আশায় বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করা উচিত।

আশুরার রোজা রাখা

এ মাসের বিশেষ ফজিলতপূর্ণ দিন হচ্ছে দশম দিন, তথা আশুরা। আশুরার রোজা রাখা মুস্তাহাব আমল। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আশুরার এক দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে এই আশা করি যে তিনি এ রোজার অসিলায় বান্দার আগের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)

৯ বা ১১ মহররমে রোজা রাখা

শরিয়তে আশুরার রোজা দুটি। মহররমের ৯ ও ১০ তারিখ কিংবা ১০ ও ১১ তারিখ। তবে কোনো কোনো আলেম এ বিষয়ে বর্ণিত সব হাদিসের ওপর আমলের সুবিধার্থে ৯, ১০ ও ১১—এ তিন দিন রোজা রাখার কথা বলেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আশুরার দিন (মহররমের দশম দিবস) রোজা রাখো এবং তাতে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ করো। আশুরার আগে এক দিন বা পরে এক দিন রোজা রাখো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৫৪)

বিধর্মীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করা

মহররমের দশম দিবসে ইহুদিরা রোজা রাখত। এ দিনটিকে তারা ঈদের মতো উদযাপন করত। তাই নবীজি ওই দিনের সঙ্গে আরেকটি রোজা পালনের নির্দেশ দিয়ে বিধর্মীদের বিরোধিতার শিক্ষা দিয়েছেন। ইবাদতের মতো বৈধ বিষয়ে এমন বিরোধিতা হতে পারলে বিধর্মীদের নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতির বিরোধিতা করার বিধান কত কঠোর হতে পারে! হাদিস শরিফে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, কিয়ামতের দিন সে ওই জাতির দলভুক্ত হবে। অর্থাৎ ওই দল জান্নাতবাসী হলে সে-ও জান্নাতবাসী হবে। আর ওই দল জাহান্নামবাসী হলে সে-ও জাহান্নামবাসী হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৩১)

তাই জীবনের সব ক্ষেত্রে বিধর্মীদের সাদৃশ্য পরিহার করা মুসলমানদের আবশ্যকীয় কর্তব্য।

মাতম মর্সিয়া পরিহার করা

হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে আশুরা নিয়ে বেশ বাড়াবাড়ি রয়েছে। আছে অনেক কুসংস্কার। অন্যতম একটি হলো—মাতম মর্সিয়া গাওয়া। মর্সিয়া মানে নবী দৌহিত্রের শোক প্রকাশে নিজের শরীরে আঘাত করা ও জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা। ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। নবী করিম (সা.) এ ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি (শোকে-দুঃখে) চেহারায় চপেটাঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলি যুগের মতো হা-হুতাশ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১২৯৭)

ভিত্তিহীন ঘটনা বলা থেকে বিরত থাকা

আশুরার দিনের গুরুত্ব বোঝাতে অনেকে মিথ্যা ও জাল হাদিসের আশ্রয় নিয়ে থাকে। যেমন—এদিন ইউসুফ (আ.) এর জেল থেকে মুক্তি। ইয়াকুব (আ.)-এর চোখের জ্যোতি ফিরে পাওয়া। ইউনুস (আ.)-এর মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ। হজরত ইদরিস (আ.)-কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া ইত্যাদি। আবার এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে এমন ধারণা করা। এসব ঘটনা ও ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। (আল আসারুল মারফুআ, পৃষ্ঠা, ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফি আয়্যামিস সানাহ, পৃষ্ঠা, ২৫৩-২৫৭)

রসম-রেওয়াজ থেকে বিরত থাকা

রোজা ও তওবা ইস্তিগফারের গুরুত্ব ছাড়া বিশেষ কোনো আমল নেই মহররম মাসে। অথচ আশুরাকেন্দ্রিক মনগড়া আমল ও রসম বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত আছে। ধর্মীয় কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের প্রথা, প্রচলন ও কুসংস্কার বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। কিছু কুসংস্কার শিরকের নামান্তর। এগুলো গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা। আর আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পথভ্রষ্ট লোক আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ থাকে।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৫৬)

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৩৫)

আশুরাকে ‘কারবালা দিবস’ মনে না করা

আশুরা মানেই কারবালা নয়। আশুরার মর্যাদা ও ঐতিহ্য ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই স্বীকৃত। ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে নবীজি (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারের মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ আশুরার সঙ্গে মিলে যাওয়া কাকতালীয়। হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির লোকের শোক প্রকাশের অযৌক্তিক নানা আয়োজনের কারণে আশুরা ও কারবালাকে একাকার মনে করে থাকে অনেকে। অথচ জাহেলি যুগেও আশুরার রোজার প্রচলন ছিল। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) হিজরত করে মদিনায় এলেন এবং তিনি মদিনার ইহুদিদের আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখলেন। তাদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল, এটা সেই দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাঈলকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে ডুবিয়ে মেরেছেন। তাঁর সম্মানার্থে আমরা রোজা রাখি। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমরা তোমাদের চেয়েও মুসা (আ.)-এর বেশি নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৪৮)

তাই ফজিলতপূর্ণ ঐতিহ্যের এই আশুরাকে শুধু কারবালা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা মূর্খতা ও দুরভিসন্ধি।

আল্লাহ তাআলা সব ধরনের বিভ্রান্তি ও বিদাআত থেকে আমাদের হেফাজত করুন। কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

মহররম মাস প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) যা বলেছেন

আপডেট টাইম : ০৪:৫৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ জুলাই ২০২৪
আরবি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। ইসলামে মাসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। ইসলামপূর্ব যুগেও এ মাসকে মর্যাদাপূর্ণ বিবেচনা করা হতো। নবীজি (সা.) এ মাসকে আল্লাহর মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন।

তা ছাড়া এটি পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত সম্মানিত চারটি মাসের একটি। এ প্রসেঙ্গে  ইরশাদ হয়েছে, ‘আসমান ও জমিন সৃষ্টির সময় থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২। এর মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।
বিদায় হজের খুতবায় রাসুল (সা.) সম্মানিত এ মাসগুলোকে চিহ্নিত করে বলেন, তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক—জিলকদ, জিলহজ ও মহররম, অন্যটি হলো রজব। (বুখারি, হাদিস : ৩১৯৭, মুসলিম, হাদিস : ১৬৭৯)

এ মাসের অন্যতম একটি ফজিলতপূর্ণ দিবস হলো আশুরা। মুসলিম সমাজে মহররম এবং এই আশুরাকেন্দ্রিক নানা ভ্রান্তি ও রসম রেওয়াজের প্রচলন আছে, যা পরিহারযোগ্য। তাই এই মাসের করণীয় ও বর্জনীয় ১০টি বিষয় এ লেখায় তুলে ধরা হলো—

গুনাহ বর্জন করা

মহররম সম্মানিত চার মাসগুলোর একটি।

এই মাসগুলোতে নিজেদের ওপর জুলুম করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতার চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে? আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এই চার মাসের মধ্যে তোমরা (গোনাহ করে) নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)নফল রোজা রাখা

নফল রোজা রাখা এ মাসের অন্যতম আমল। নবীজি এই মাসের নফল রোজাকে সর্বোত্তম ঘোষণা করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।)

তাওবা-ইস্তিগফার করা

নফল রোজার পাশাপাশি মহররমের বিশেষ আমল হলো তওবা ইস্তিগফার করা। কেননা রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, মহররম আল্লাহর মাস। এই মাসে এমন একটি দিন রয়েছে, যেদিন আল্লাহ তায়ালা একটি সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করেছেন। (আশা করা যায়) সেদিন অন্যান্য সম্প্রদায়ের তাওবাও কবুল করা হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৪১)

তাই ক্ষমা পাওয়ার আশায় বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করা উচিত।

আশুরার রোজা রাখা

এ মাসের বিশেষ ফজিলতপূর্ণ দিন হচ্ছে দশম দিন, তথা আশুরা। আশুরার রোজা রাখা মুস্তাহাব আমল। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আশুরার এক দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে এই আশা করি যে তিনি এ রোজার অসিলায় বান্দার আগের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)

৯ বা ১১ মহররমে রোজা রাখা

শরিয়তে আশুরার রোজা দুটি। মহররমের ৯ ও ১০ তারিখ কিংবা ১০ ও ১১ তারিখ। তবে কোনো কোনো আলেম এ বিষয়ে বর্ণিত সব হাদিসের ওপর আমলের সুবিধার্থে ৯, ১০ ও ১১—এ তিন দিন রোজা রাখার কথা বলেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আশুরার দিন (মহররমের দশম দিবস) রোজা রাখো এবং তাতে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ করো। আশুরার আগে এক দিন বা পরে এক দিন রোজা রাখো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৫৪)

বিধর্মীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করা

মহররমের দশম দিবসে ইহুদিরা রোজা রাখত। এ দিনটিকে তারা ঈদের মতো উদযাপন করত। তাই নবীজি ওই দিনের সঙ্গে আরেকটি রোজা পালনের নির্দেশ দিয়ে বিধর্মীদের বিরোধিতার শিক্ষা দিয়েছেন। ইবাদতের মতো বৈধ বিষয়ে এমন বিরোধিতা হতে পারলে বিধর্মীদের নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতির বিরোধিতা করার বিধান কত কঠোর হতে পারে! হাদিস শরিফে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, কিয়ামতের দিন সে ওই জাতির দলভুক্ত হবে। অর্থাৎ ওই দল জান্নাতবাসী হলে সে-ও জান্নাতবাসী হবে। আর ওই দল জাহান্নামবাসী হলে সে-ও জাহান্নামবাসী হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৩১)

তাই জীবনের সব ক্ষেত্রে বিধর্মীদের সাদৃশ্য পরিহার করা মুসলমানদের আবশ্যকীয় কর্তব্য।

মাতম মর্সিয়া পরিহার করা

হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে আশুরা নিয়ে বেশ বাড়াবাড়ি রয়েছে। আছে অনেক কুসংস্কার। অন্যতম একটি হলো—মাতম মর্সিয়া গাওয়া। মর্সিয়া মানে নবী দৌহিত্রের শোক প্রকাশে নিজের শরীরে আঘাত করা ও জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা। ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। নবী করিম (সা.) এ ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি (শোকে-দুঃখে) চেহারায় চপেটাঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলি যুগের মতো হা-হুতাশ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১২৯৭)

ভিত্তিহীন ঘটনা বলা থেকে বিরত থাকা

আশুরার দিনের গুরুত্ব বোঝাতে অনেকে মিথ্যা ও জাল হাদিসের আশ্রয় নিয়ে থাকে। যেমন—এদিন ইউসুফ (আ.) এর জেল থেকে মুক্তি। ইয়াকুব (আ.)-এর চোখের জ্যোতি ফিরে পাওয়া। ইউনুস (আ.)-এর মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ। হজরত ইদরিস (আ.)-কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া ইত্যাদি। আবার এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে এমন ধারণা করা। এসব ঘটনা ও ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। (আল আসারুল মারফুআ, পৃষ্ঠা, ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফি আয়্যামিস সানাহ, পৃষ্ঠা, ২৫৩-২৫৭)

রসম-রেওয়াজ থেকে বিরত থাকা

রোজা ও তওবা ইস্তিগফারের গুরুত্ব ছাড়া বিশেষ কোনো আমল নেই মহররম মাসে। অথচ আশুরাকেন্দ্রিক মনগড়া আমল ও রসম বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত আছে। ধর্মীয় কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের প্রথা, প্রচলন ও কুসংস্কার বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। কিছু কুসংস্কার শিরকের নামান্তর। এগুলো গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা। আর আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পথভ্রষ্ট লোক আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ থাকে।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৫৬)

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৩৫)

আশুরাকে ‘কারবালা দিবস’ মনে না করা

আশুরা মানেই কারবালা নয়। আশুরার মর্যাদা ও ঐতিহ্য ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই স্বীকৃত। ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে নবীজি (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারের মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ আশুরার সঙ্গে মিলে যাওয়া কাকতালীয়। হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির লোকের শোক প্রকাশের অযৌক্তিক নানা আয়োজনের কারণে আশুরা ও কারবালাকে একাকার মনে করে থাকে অনেকে। অথচ জাহেলি যুগেও আশুরার রোজার প্রচলন ছিল। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) হিজরত করে মদিনায় এলেন এবং তিনি মদিনার ইহুদিদের আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখলেন। তাদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল, এটা সেই দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাঈলকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে ডুবিয়ে মেরেছেন। তাঁর সম্মানার্থে আমরা রোজা রাখি। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমরা তোমাদের চেয়েও মুসা (আ.)-এর বেশি নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৪৮)

তাই ফজিলতপূর্ণ ঐতিহ্যের এই আশুরাকে শুধু কারবালা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা মূর্খতা ও দুরভিসন্ধি।

আল্লাহ তাআলা সব ধরনের বিভ্রান্তি ও বিদাআত থেকে আমাদের হেফাজত করুন। কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন।