ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রভাবশালী ১১ মন্ত্রী, ৬ জন সাবেক সংসদ সদস্যের (এমপি) নামে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। তারা প্রত্যেকেই নিজের ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি তাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজন বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব থেকে মাত্রাতিরিক্ত নগদ টাকা উত্তোলন করেছেন। এসব অর্থ তারা কেন, কীভাবে তুলেছেন, কোথায় খরচ করেছেন, কোথায় রেখেছেন, পাচার করেছেন কিনা সেসব তথ্য এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)সহ সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে।
যে ১১ জন সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীর নামে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রী- শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও জাহিদ মালেক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ।
এছাড়া যে ৬ এমপির বিরুদ্ধে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে- বাগেরহাট-১ আসনের এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন, জামালপুর-৩ আসনের মির্জা আজম, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের জান্নাত আরা হেনরী, ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, নাটোর-২ আসনের শফিকুল ইসলাম শিমুল ও পিরোজপুর-১ আসনের মহিউদ্দিন মহারাজ।
উলিখিত ১১ মন্ত্রী ও ৬ এমপি নিজেদের ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্রাতিরিক্ত নগদ অর্থ উত্তোলন করেছেন। এছাড়া সরকারের আরও কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও এমপির সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো এখন পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। অচিরেই এদের বিষয়েও ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর কাছে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হবে।
জানা গেছে, সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে বিভিন্ন দেশে বিপুল সম্পদের তথ্য মিলেছে। ওইসব সম্পদ তারা দেশ থেকে কীভাবে পাচার করেছেন সে বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জুলাইয়ের শেষদিক থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত এসব লেনদেন করেছেন।
সূত্র জানায়, বিএফআইইউর বিধান অনুযায়ী কোনো গ্রাহক ব্যাংক থেকে নগদ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন করলে তাকে স্বাভাবিক লেনদেন হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। ১০ লাখ টাকার বেশি নগদ লেনদেন করলেই তাকে সন্দেহজনক লেনদেন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এসব লেনদেনের তথ্য বিএফআইইউতে সন্দেহজনক লেনদেন বা এসটিআর হিসাবে পাঠাতে হয়। সংস্থাটি সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য প্রতিদিন সংগ্রহ করছে। এগুলো এখন বিশ্লেষণ করে যেসব ব্যক্তির নামে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য বেশি তাদের ব্যাপারে বিশদ তদন্ত করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার আমলে দলটির নেতারা ব্যাংকের পাশাপাশি এটিএম বুথগুলো থেকেও মাত্রাতিরিক্ত টাকা উত্তোলন করেছেন। নিজের হিসাবের পাশাপাশি পরিবারের হিসাব থেকেও তারা টাকা তুলেছেন। এসব টাকা নিয়ে অনেক নেতা দেশ ত্যাগ করেছেন। অনেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা তোলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর মধ্যে প্রথমে এটিএম বুথ থেকে ২০ হাজার টাকার বেশি তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকার বেশি তোলা যাবে- এ মর্মে নির্দেশনা জারি করে। পরে তা বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়। চলতি সপ্তাহে তা আরও বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা তুলতে পারছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সারা দেশে এখনো নগদ টাকা স্থানান্তর স্বাভাবিকভাবে করা যাচ্ছে না। জরুরি প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তায় নগদ টাকা স্থানান্তর করা হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।