বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এবং এর আওতাধীন কোম্পানিগুলোর প্রায় আড়াই হাজার মামলা আদালতে ঝুলে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ এক বৈঠকে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, দ্রুত মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে সমাধানের পথে যেতে। দেশীয় আদালতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতেও একাধিক মামলা চলমান আছে। বৈঠকে কেন মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না- আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এর কারণগুলো বের করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটস (ইকসিড) শীর্ষক সালিশি আদালতে তিনটি মামলা চলমান আছে। এর মধ্যে নাইকো রিসোর্স (বাংলাদেশ) লিমিটেড এবং তাল্লো বাংলাদেশ লিমিটেডের (বর্তমানে ক্রিস এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড) বিপক্ষে মামলা রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এসব মামলা ঝুলে থাকায় পেট্রোবাংলা এবং এর আওতাধীন কোম্পানিগুলো অর্থ এবং শ্রম ব্যবহার হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে নেতিবাচকর প্রভাব তৈরি করেছে। ওই বৈঠকে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার নির্দেশনা দিয়েছেন বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি ব্যবস্থা করতে। কোম্পানিগুলোর আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, চেয়ারম্যান আরও নির্দেশনা দিয়েছেন বিভিন্ন কোম্পানিতে মামলা সম্পর্কিত নথি নিয়ে যেসব কর্মকর্তা কাজ করছেন, তাদের নিষ্পত্তি করতে ‘ইনোভেটিভ অ্যাপ্রোচে’ যেতে। মামলার মাধ্যমে বকেয়া গ্যাস বিল আদায় এবং অবৈধ গ্যাস সংযোগ যেন বন্ধ হয়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়।
সূত্রে জানা যায়, অনেক বেসরকারি কোম্পানি সরকারি কোম্পানির সঙ্গে মামলায় জিতে যাচ্ছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিশেষ কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তারা যতটা দক্ষতার সঙ্গে মামলা উপস্থাপন করা দরকার, সেটা করছেন না। এমনভাবে করছেন, যাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলো সুবিধা পায়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি কোম্পানিগুলো।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ সমন্বিত হিসাব অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পেট্রোবাংলার নিজের মামলা রয়েছে ৩২টি, এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মামলার সংখ্যা এক হাজার ২৪৮টি, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন আ্যান্ড ট্রান্সমিশন কোম্পানি মামলার সংখ্যা ৫৬৩টি, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মামলার সংখ্যা ১১৫টি, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের মামলার সংখ্যা ৫৪টি, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের মামলার সংখ্যা ৪৩টি, কর্ণফুলী গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মামলা রয়েছে ২৪৩টি। এ ছাড়াও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের মামলার সংখ্যা ৩৬টি, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের মামলার সংখ্যা ৫৬টি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানির (বাপেক্স) মামলার সংখ্যা ৫৬টি, রূপান্তরিত গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) মামলার সংখ্যা ১২টি, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির মামলার সংখ্যা ২৮টি, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের মামলার সংখ্যা ১২টি এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির মামলার সংখ্যা ১৫টি।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এ মন্ত্রণালয়ে নতুন এসেছি। আমাকে বুঝতে একটু সময় দিতে হবে। তবে আমাদের দেশের সরকারি কোম্পানিগুলোর অনেক কিছুই গতানুগতিক পদ্ধতিতে চলে আসছে। বিভিন্ন কোম্পানির মামলাগুলোর ক্ষেত্রেও আমার ধারণা তাই। তিনি বলেন, মামলা হয় সাধারণত কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানির বিরুদ্ধে, যদি কেউ মনে করেন সরকারি কোম্পানির সিদ্ধান্তে বা কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, সেই ক্ষেত্রে কোম্পানি তথা রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানির কর্মকর্তা বা কোম্পানির নিয়োজিত আইনজীবীদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা উচিত। এ কর্মকর্তা বলেন, দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর আইনজীবী নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। ওই সব আইনজীবী নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা কোম্পানির কাছ থেকে তুলে নিলেও কোম্পানির স্বার্থরক্ষায় ততটা তৎপর থাকেন না। এ ছাড়া কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও তেমন সোচ্চার থাকেন না। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেসরকারি কোম্পানিগুলো মামলায় জিতে যাচ্ছে। তবে এটাও সত্য, অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানির কোনো কোনো কর্মকর্তা হীনস্বার্থে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ক্ষতি সাধন করছেন। সেই ক্ষেত্রে বেসরকারি কোম্পানি বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মামলায় যেতেই পারেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের বিভিন্ন সময় আলাদা আলাদা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণেও গ্রাহকরা মামলায় যায়। তিনি বলেন, এক সময় সিএনজি স্টেশন স্থাপনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি সিএনজি স্টেশন স্থাপনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সরকার এর কোনোটির অনুমোদনও দিয়েছে। মালিকরা বিনিয়োগও করে ফেলছে। এখন দেখাগেল মাঝপথে সরকার আবার সিএনজি স্টেশন স্থাপন বন্ধ করে দিল। ফলে বাধ্য হয়ে বিনিয়োগ করে বসে থাকা লোকজন মামলায় চলে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আদালত যদি তার পক্ষে রায় দেন, সেটা মেনে নিতে হবে। তিনি বলেন, এমন নানা ধরনের ঘটনা ও নানা প্রেক্ষাপটে তৈরি হয় বলেই মামলা মোকদ্দমা হয়।