ঢাকা , সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন

ফের উত্তপ্ত হচ্ছে ঢাকার ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’। এতদিন কারাগারে বসে ও বিদেশে থেকে রাজধানীর অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর ছয়জন। এক থেকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে তারা ছিলেন কারাঅন্তরীণ। আধিপত্য ধরে রাখতে কারামুক্ত হয়েই তাদের কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ পর্দার অন্তরালে বসে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া ছয় শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে অন্যতম সানজিদুল ইসলাম ইমন। গত ১৫ আগস্ট বিকালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। অভিযোগ উঠেছে, মুক্তি পেয়েই আধিপত্য বিস্তারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ইমন ও তার ক্যাডাররা। জোন ভাগ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে গড়ে তুলেছেন চাঁদাবাজির বলয়। ঢাকা দক্ষিণের প্রায় সব এলাকার টেন্ডার (ময়লা অপসারণ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ-সংস্কার) বাণিজ্য, ডিশ-ইন্টারনেট ব্যবসা, পরিবহন, ফুটপাত, বাজার, ঝুট ব্যবসা, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল, ভবন নির্মাণ (ডেভেলপার) প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাত থেকে আসা কোটি কোটি টাকার

চাঁদাবাজির নাটাই এখন ইমনের হাতে। ফুটপাতের চা-দোকানি থেকে বহুতল ভবনের ব্যবসায়ীকেও মাসিক চাঁদার হার বেঁধে দিয়েছে তার ক্যাডাররা। দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দিলেই সদলবলে অস্ত্র নিয়ে হামলে পড়ছে ব্যবসায়ীদের ওপর।

সর্বশেষ চাঁদার টাকা না পেয়ে গত শুক্রবার মধ্যরাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনের সড়কে প্রকাশ্যে দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ী নেতাকে কুপিয়েছে ইমনের মুখোশধারী ক্যাডাররা। ওই হামলায় আহত এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. ওয়াহিদুল হাসান দীপু হাসপাতাল ছাড়লেও আইসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের (ইসিএস কম্পিউটার সিটি) যুগ্ম সদস্য সচিব মো. এহতেসামুল হক। নৃশংস এই হামলার ঘটনায় পুলিশ আসিফ ঝন্টু ও কাউসার উদ্দিন নামে দুই যুবককে আটক করেছে। তবে গতকাল রাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, তার সহযোগী মুন্না, একেএম চঞ্চল, খোকন, সাঈদ আসাদ, জসিম ওরফে কলা জসিম, তুষার ওরফে কিলার তুষার, তৌফিক এহসান এবং জাহিদসহ কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গতকাল আতিক নামে একজনের গ্রেপ্তারের খবর এলেও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কেউই এর সত্যতা নিশ্চিত করেননি।

জানা গেছে, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার থেকে

মাসে কয়েক কোটি টাকার চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য দখলে মরিয়া ছিল ইমন গ্রুপ। গত ২২ ডিসেম্বর দাবিকৃত চাঁদার টাকা না পেয়ে মার্কেটে সশস্ত্র হামলা চালায় তারা। তবে ছাত্র-জনতা ও ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় সুবিধা করতে পারেনি। এ ঘটনায় থানায় জিডি করেন মার্কেটের এক ব্যবসায়ী। এই ক্ষোভ থেকে গত শুক্রবার মধ্যরাতে টার্গেট করে কোপানো হয় জিডি সংশ্লিষ্ট দুই ব্যবসায়ীকে। এ ঘটনায় ইমন ছাড়াও নতুন করে সামনে আসে অপরাধ জগতের আরেক মাফিয়া মোহাম্মদপুরের পিচ্চি হেলালের নাম। তারা এতদিন জেলে বসেই নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকার অপরাধ জগৎ। জামিনে বের হয়ে ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠেন দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী। ইমনের নামে সম্প্রতি একাধিক জিডি ও একটি হত্যাচেষ্টা মামলা আর পিচ্চি হেলালের নামে জোড়া খুনের মামলা ছাড়াও হয়েছে একাধিক জিডি। মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে হামলার নেপথ্যে এ দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির বিষয়টি খতিয়ে দেখছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল দুপুরে এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় চাঁদাবাজির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে। নতুন বাংলাদেশে যাতে আর চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব না থাকে, এ জন্য সব মহলকে কাজ করতে হবে। আমরা চাই দেশের প্রত্যেকটা সেক্টর যেন চাঁদাবাজ-দখলদারমুক্ত থাকে। কেউ যদি চাঁদা চায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাবেন।

জানা গেছে, চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জোনভেদে ক্যাডার বাহিনীকে সাজিয়েছেন ইমন। এর মধ্যে নগর ভবনের টেন্ডার বাণিজ্যের দায়িত্বে আছেন তাহের ও আলমগীর। নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, ঝিগাতলা, রায়েরবাজার, এলিফ্যান্ট রোডসহ আশপাশের এলাকার মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে সবগুলো বিপণিবিতাণ, কাঁচাবাজার, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন সেক্টরের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রকও ইমনের সিন্ডিকেট। সম্প্রতি চাঁদার টাকা না পেয়ে নিউমার্কেটের টয়লেটের টেন্ডার নিয়ে হামলা করে ইমন গ্রুপ। আগে দক্ষিণের সাবেক মেয়র তাপসের ছত্রছায়ায় কারাগারে বসে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অনুর সঙ্গে সিন্ডিকেট পাকিয়ে এসব এলাকার অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন ইমন ও তার অনুসারীরা। সম্প্রতি দুই রবির (রবিউল আলম ও রবিউল ইসলাম) কাঁধে ভর করে অপরাধের নতুন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। গত ১০ অক্টোবর হাতিরঝিল থানাধীন মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে দীপ্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা তানজিল জাহান ইসলাম তামিম হত্যাকাণ্ডে জড়িতরাও ইমনের ঘনিষ্ঠ বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। তিন সপ্তাহ আগে চাঁদার টাকা না পেয়ে রায়েরবাজার গদিঘর এলাকায় একটি দোকানে তালা মেরে দেয় ইমনের লোকজন। এদিকে, নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনিচকসহ স্থানীয় বিপণিবিতানগুলোয় ইন্ডিয়ান মালামাল নিয়ে রাতে আসা প্রতি ট্রাক থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করেন ইমনের সহযোগী এহসান। হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় চাঁদাবাজি ও দখলবাজির সাম্রাজ্য দেখভাল করেন তাহের; নিউপল্টন এলাকায় চাচা জাহিদ; নবাবগঞ্জ এলাকায় মুক্তার ও সেন্টু; ফুটপাতে মাদক ব্যবসার চাঁদা আদায় করেন টুন্ডা আনোয়ার; কামরাঙ্গীরচর-ডুরি-আঙ্গুল লেন ও নবাবগঞ্জ এলাকায় আলমগীর ও জাহাঙ্গীর; লালবাগ এলাকায় নাসির। গত ৫ জানুয়ারি জিগাতলা ধানমন্ডি ১৪ নম্বর এবং ৭/এ তিনটি বাড়িতে একযোগে ইমনের সহযোগী ডাক্তার মিলন, হ্যজাজ, ইব্রাহিম এবং কালা সাইফুল তাণ্ডব চালিয়ে বহুতল নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। চাঁদা না পেয়ে গত ১০ জানুয়ারি রাতে তার মুখোশধারী ক্যাডাররা তিনটি নির্মাণাধীন ভবনে একযোগে হামলা চালায়। ককটেল নিক্ষেপ ও এলোপাতাড়ি গুলিতে একজন লেবার গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া নিউপল্টন ও নবাবগঞ্জ বাজার এলাকায় চাঁদাবাজি সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন ইমনের ক্যাডার কামরুজ্জামান সুজন, চাচা জাহিদ এবং ২৩নং ওয়ার্ডে ফায়সাল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন পিচ্চি ও খলিলুর রহমান ওরফে মোল্লা রিপন। এ ছাড়া টাকি সোহেল ও মুক্তার হোসেন নবাবগঞ্জ বেড়িবাঁধ সংলগ্ন সেকশন ইজিবাইক স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ করেন ইমনের হয়ে।

গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের দক্ষিণের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনের সড়কে দুই ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কোপানোর ঘটনায় মামলা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্তের কাজ চলছে। আসামিদের শনাক্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে। নিউমার্কেট থানার ওসি মুহসীন উদ্দিন বলেন, কে বা কারা কী কারণে হামলা করেছে, সেটি এখনও জানা যায়নি। তদন্তের পর এই বিষয়ে বলা যাবে।

মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের একাধিক ব্যবসায়ী জানায়, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে মূলত কম্পিউটারের ব্যবসা। সেখানে মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। ছোট বিজ্ঞাপন দিতে গেলেও চাঁদা দিতে হয়। সার্ভিস চার্জের নামে মার্কেটে থাকা ৮ শতাধিক দোকান থেকে কমপক্ষে ৫ হাজার করে চাঁদা তোলা হয়, যা বেশিরভাগই যায় সমিতির নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের ব্যক্তিদের পকেটে। গত ৫ আগস্টের পর মাল্টিপ্ল্যান কম্পিউটার সিটি মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নতুন গ্রুপের হাতে চলে যায়। তারাই মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতি দখল করে। এই গ্রুপটি মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের আশীর্বাদপুষ্ট। তাদেরই প্রতিপক্ষ ইমনের গ্রুপ। মূলত চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই এই হামলা।

ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, এক মাস আগে ওই মার্কেটে একটি নির্বাচন হয়। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিরোধ ছিল। নির্বাচনের কারণে বা অন্য কোনো কারণে এ হামলা হতে পারে। তবে আসামিদের না ধরা পর্যন্ত এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন

আপডেট টাইম : ৩ ঘন্টা আগে

ফের উত্তপ্ত হচ্ছে ঢাকার ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’। এতদিন কারাগারে বসে ও বিদেশে থেকে রাজধানীর অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর ছয়জন। এক থেকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে তারা ছিলেন কারাঅন্তরীণ। আধিপত্য ধরে রাখতে কারামুক্ত হয়েই তাদের কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ পর্দার অন্তরালে বসে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া ছয় শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে অন্যতম সানজিদুল ইসলাম ইমন। গত ১৫ আগস্ট বিকালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। অভিযোগ উঠেছে, মুক্তি পেয়েই আধিপত্য বিস্তারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ইমন ও তার ক্যাডাররা। জোন ভাগ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে গড়ে তুলেছেন চাঁদাবাজির বলয়। ঢাকা দক্ষিণের প্রায় সব এলাকার টেন্ডার (ময়লা অপসারণ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ-সংস্কার) বাণিজ্য, ডিশ-ইন্টারনেট ব্যবসা, পরিবহন, ফুটপাত, বাজার, ঝুট ব্যবসা, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল, ভবন নির্মাণ (ডেভেলপার) প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাত থেকে আসা কোটি কোটি টাকার

চাঁদাবাজির নাটাই এখন ইমনের হাতে। ফুটপাতের চা-দোকানি থেকে বহুতল ভবনের ব্যবসায়ীকেও মাসিক চাঁদার হার বেঁধে দিয়েছে তার ক্যাডাররা। দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দিলেই সদলবলে অস্ত্র নিয়ে হামলে পড়ছে ব্যবসায়ীদের ওপর।

সর্বশেষ চাঁদার টাকা না পেয়ে গত শুক্রবার মধ্যরাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনের সড়কে প্রকাশ্যে দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ী নেতাকে কুপিয়েছে ইমনের মুখোশধারী ক্যাডাররা। ওই হামলায় আহত এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. ওয়াহিদুল হাসান দীপু হাসপাতাল ছাড়লেও আইসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের (ইসিএস কম্পিউটার সিটি) যুগ্ম সদস্য সচিব মো. এহতেসামুল হক। নৃশংস এই হামলার ঘটনায় পুলিশ আসিফ ঝন্টু ও কাউসার উদ্দিন নামে দুই যুবককে আটক করেছে। তবে গতকাল রাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, তার সহযোগী মুন্না, একেএম চঞ্চল, খোকন, সাঈদ আসাদ, জসিম ওরফে কলা জসিম, তুষার ওরফে কিলার তুষার, তৌফিক এহসান এবং জাহিদসহ কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গতকাল আতিক নামে একজনের গ্রেপ্তারের খবর এলেও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কেউই এর সত্যতা নিশ্চিত করেননি।

জানা গেছে, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার থেকে

মাসে কয়েক কোটি টাকার চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য দখলে মরিয়া ছিল ইমন গ্রুপ। গত ২২ ডিসেম্বর দাবিকৃত চাঁদার টাকা না পেয়ে মার্কেটে সশস্ত্র হামলা চালায় তারা। তবে ছাত্র-জনতা ও ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় সুবিধা করতে পারেনি। এ ঘটনায় থানায় জিডি করেন মার্কেটের এক ব্যবসায়ী। এই ক্ষোভ থেকে গত শুক্রবার মধ্যরাতে টার্গেট করে কোপানো হয় জিডি সংশ্লিষ্ট দুই ব্যবসায়ীকে। এ ঘটনায় ইমন ছাড়াও নতুন করে সামনে আসে অপরাধ জগতের আরেক মাফিয়া মোহাম্মদপুরের পিচ্চি হেলালের নাম। তারা এতদিন জেলে বসেই নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকার অপরাধ জগৎ। জামিনে বের হয়ে ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠেন দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী। ইমনের নামে সম্প্রতি একাধিক জিডি ও একটি হত্যাচেষ্টা মামলা আর পিচ্চি হেলালের নামে জোড়া খুনের মামলা ছাড়াও হয়েছে একাধিক জিডি। মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে হামলার নেপথ্যে এ দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির বিষয়টি খতিয়ে দেখছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল দুপুরে এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় চাঁদাবাজির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে। নতুন বাংলাদেশে যাতে আর চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব না থাকে, এ জন্য সব মহলকে কাজ করতে হবে। আমরা চাই দেশের প্রত্যেকটা সেক্টর যেন চাঁদাবাজ-দখলদারমুক্ত থাকে। কেউ যদি চাঁদা চায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাবেন।

জানা গেছে, চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জোনভেদে ক্যাডার বাহিনীকে সাজিয়েছেন ইমন। এর মধ্যে নগর ভবনের টেন্ডার বাণিজ্যের দায়িত্বে আছেন তাহের ও আলমগীর। নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, ঝিগাতলা, রায়েরবাজার, এলিফ্যান্ট রোডসহ আশপাশের এলাকার মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে সবগুলো বিপণিবিতাণ, কাঁচাবাজার, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন সেক্টরের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রকও ইমনের সিন্ডিকেট। সম্প্রতি চাঁদার টাকা না পেয়ে নিউমার্কেটের টয়লেটের টেন্ডার নিয়ে হামলা করে ইমন গ্রুপ। আগে দক্ষিণের সাবেক মেয়র তাপসের ছত্রছায়ায় কারাগারে বসে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অনুর সঙ্গে সিন্ডিকেট পাকিয়ে এসব এলাকার অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন ইমন ও তার অনুসারীরা। সম্প্রতি দুই রবির (রবিউল আলম ও রবিউল ইসলাম) কাঁধে ভর করে অপরাধের নতুন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। গত ১০ অক্টোবর হাতিরঝিল থানাধীন মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে দীপ্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা তানজিল জাহান ইসলাম তামিম হত্যাকাণ্ডে জড়িতরাও ইমনের ঘনিষ্ঠ বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। তিন সপ্তাহ আগে চাঁদার টাকা না পেয়ে রায়েরবাজার গদিঘর এলাকায় একটি দোকানে তালা মেরে দেয় ইমনের লোকজন। এদিকে, নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনিচকসহ স্থানীয় বিপণিবিতানগুলোয় ইন্ডিয়ান মালামাল নিয়ে রাতে আসা প্রতি ট্রাক থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করেন ইমনের সহযোগী এহসান। হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় চাঁদাবাজি ও দখলবাজির সাম্রাজ্য দেখভাল করেন তাহের; নিউপল্টন এলাকায় চাচা জাহিদ; নবাবগঞ্জ এলাকায় মুক্তার ও সেন্টু; ফুটপাতে মাদক ব্যবসার চাঁদা আদায় করেন টুন্ডা আনোয়ার; কামরাঙ্গীরচর-ডুরি-আঙ্গুল লেন ও নবাবগঞ্জ এলাকায় আলমগীর ও জাহাঙ্গীর; লালবাগ এলাকায় নাসির। গত ৫ জানুয়ারি জিগাতলা ধানমন্ডি ১৪ নম্বর এবং ৭/এ তিনটি বাড়িতে একযোগে ইমনের সহযোগী ডাক্তার মিলন, হ্যজাজ, ইব্রাহিম এবং কালা সাইফুল তাণ্ডব চালিয়ে বহুতল নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। চাঁদা না পেয়ে গত ১০ জানুয়ারি রাতে তার মুখোশধারী ক্যাডাররা তিনটি নির্মাণাধীন ভবনে একযোগে হামলা চালায়। ককটেল নিক্ষেপ ও এলোপাতাড়ি গুলিতে একজন লেবার গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া নিউপল্টন ও নবাবগঞ্জ বাজার এলাকায় চাঁদাবাজি সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন ইমনের ক্যাডার কামরুজ্জামান সুজন, চাচা জাহিদ এবং ২৩নং ওয়ার্ডে ফায়সাল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন পিচ্চি ও খলিলুর রহমান ওরফে মোল্লা রিপন। এ ছাড়া টাকি সোহেল ও মুক্তার হোসেন নবাবগঞ্জ বেড়িবাঁধ সংলগ্ন সেকশন ইজিবাইক স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ করেন ইমনের হয়ে।

গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের দক্ষিণের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনের সড়কে দুই ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কোপানোর ঘটনায় মামলা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্তের কাজ চলছে। আসামিদের শনাক্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে। নিউমার্কেট থানার ওসি মুহসীন উদ্দিন বলেন, কে বা কারা কী কারণে হামলা করেছে, সেটি এখনও জানা যায়নি। তদন্তের পর এই বিষয়ে বলা যাবে।

মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের একাধিক ব্যবসায়ী জানায়, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে মূলত কম্পিউটারের ব্যবসা। সেখানে মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। ছোট বিজ্ঞাপন দিতে গেলেও চাঁদা দিতে হয়। সার্ভিস চার্জের নামে মার্কেটে থাকা ৮ শতাধিক দোকান থেকে কমপক্ষে ৫ হাজার করে চাঁদা তোলা হয়, যা বেশিরভাগই যায় সমিতির নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের ব্যক্তিদের পকেটে। গত ৫ আগস্টের পর মাল্টিপ্ল্যান কম্পিউটার সিটি মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নতুন গ্রুপের হাতে চলে যায়। তারাই মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতি দখল করে। এই গ্রুপটি মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের আশীর্বাদপুষ্ট। তাদেরই প্রতিপক্ষ ইমনের গ্রুপ। মূলত চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই এই হামলা।

ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, এক মাস আগে ওই মার্কেটে একটি নির্বাচন হয়। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিরোধ ছিল। নির্বাচনের কারণে বা অন্য কোনো কারণে এ হামলা হতে পারে। তবে আসামিদের না ধরা পর্যন্ত এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।