আইন অমান্য করে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে বাড়ছে উত্তেজনা। প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) আধুনিক প্রযুক্তিসহ সীমান্তে তৎপরতা বাড়িয়েছে। দেশের স্বার্থে বাংলাদেশও কোনো ধরনের ছাড় দেবে না বলে জানিয়েছে। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম সীমান্তে অতিরিক্ত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। দেশের সীমান্ত রক্ষায় বিজিবির সঙ্গে কাস্তে হাতে বাংলাদেশি কৃষকরাও পাহারা দিচ্ছেন। সীমান্তের প্রতি ইঞ্চি মাটি রক্ষায় তৎপরতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের জিরো লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে ভারতকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হবে না। এর মধ্যে ৩টি জেলার পাঁচটি সীমান্তে বিএসএফকে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের তিনটি জেলার কয়েকটি সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কয়েকটি স্থাপনার নির্মাণকাজ নিয়ে বিজিবি আপত্তি তোলার পর সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হয়। সীমান্তের কয়েকটি জায়গায় স্থাপনা নিয়ে নির্মাণ-বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে দুই দেশ এবং এতে উভয়পক্ষেই নিজ-নিজ সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসীদেরও যোগ দিতে দেখা গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকো সীমান্তে সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে গ্রামবাসীদেরও জড়ো হওয়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষক বাবুল আলীর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা গেছে, কাস্তে হাতে মাটির বাংকারে বিজিবির সঙ্গে তিনিও অবস্থান করছেন। বিজিবি নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে সীমান্ত থেকে চলে যেতে বললেও তিনি সরে যাননি। পরে বাবুল আলী গণমাধ্যমকে বলেন, বিএসএফ যদি আমাদের সীমান্তে চলে আসে, তার জন্য কাস্তে নিয়ে সেখানে প্রস্তুত ছিলাম। জীবন দিয়ে দেশের মাটি রক্ষা করব। তিনি আরও বলেন, বিএসএফ তার অনেক ফসলি জমির ক্ষতি করেছে। তারা চাষিদের গুলি করে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ার কাছে নিয়ে ফেলে রাখে।
বিজিবি বলছে, সেখানে সীমান্তের ১২০০ গজের মতো অংশে কোনো কাঁটাতারের বেড়া ছিল না এবং সেই বেড়া তৈরির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে ১০০ গজ ভেতরে মাটি খোঁড়া হচ্ছিল। এ কারণে বাংলাদেশের তীব্র আপত্তির মুখে ভারতীয়দের কাজটি বন্ধ করতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে জনগণও যুক্ত হয়েছে। সীমান্তে যেন উত্তেজনা না বাড়ে, সে জন্য বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুই দেশকেই কূটনৈতিক তৎপরতার দিকে জোর দিতে হবে। উত্তেজনা যাতে না বাড়ে সে জন্য উদ্যোগী হতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, যে কোনো চুক্তিতে উভয়পক্ষের লাভ না হলে সেই চুক্তি টেকে না। দুই দেশের সম্পর্ক জনগণকেন্দ্রিক করতে হবে। তাহলে পরিস্থিতি বদলে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ-ভারত যুগ্ম সীমান্ত নির্দেশাবলি-১৯৭৫ অনুযায়ী উভয় দেশের শূন্য লাইনের ১৫০ গজের মধ্যে প্রতিরক্ষা সংবলিত যে কোনো কাজ করা যাবে না। শূন্য লাইন থেকে ১৫০ গজের ভেতরে কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে হলেও একে অপরের কাছ থেকে সম্মতি নিতে হবে।
জানা গেছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৩২৭১ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারত। ভারত বাকি ৮৮৫ কিলোমিটারজুড়ে বিভিন্ন অংশে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছে। আইন অমান্য করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, তিন বিঘা করিডোর, নওগাঁর পত্নীতলা ও লালমনিরহাটে ভারতের পক্ষ থেকে জিরো লাইনের ১৫০ গজের মধ্যেই নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলছেন, ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল সময়ের মধ্যে কতগুলো অসম কাজ করা হয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে সীমান্তে বেড়া দেওয়া নিয়ে যেসব অসম সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, সেগুলো বাতিলের বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। বিজিবি ও স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদের কারণে তিন বিঘা করিডোর ও নওগাঁর পত্নীতলাসহ কয়েকটি জায়গায় ভারত যে কাজ শুরু করেছিল, তা বন্ধ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বিএসএফ সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বারবার সেটি ভঙ্গ করছে। গত বুধবার সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মাছিমপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক সাইদুল ইসলাম নিহত হন। একই দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ শহিদুল ইসলাম গুরুতর আহত হয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে বিএসএফ ৩০ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে ২৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পিটিয়ে মারা হয়েছে ৪ বাংলাদেশিকে। সবচেয়ে বেশি রংপুর সীমান্তে ১১ জনকে হত্যা এবং ৯ জনকে গুরুতর আহত করা হয়েছে।
জানা গেছে, ভারতের দিক থেকে নতুন সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন এবং একই সঙ্গে নজরদারির জন্য একাধিক বৈদ্যুতিক যন্ত্র এবং অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সঙ্গে প্রহরীদের সতর্ক করার জন্য কিছু যন্ত্রও লাগানো হয়েছে। যেখানে নদী বা অন্য কোনো কারণে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে নজরদারির জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাসহ বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে।
বিজিবি জানিয়েছে, ২০২৪ সালে সীমান্তে ১৫ হাজার ৯১ বিদেশি নাগরিক আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ১৫৫ জন ভারতীয় নাগরিক এবং ১৪ হাজার ৩৩৬ জন মিয়ানমারের নাগরিককে আটক করেছে বিজিবি।
থমথমে দহগ্রাম সীমান্ত: গত শুক্রবার সকাল থেকে বাংলাদেশ-ভারত প্রধান পিলার ডিএমপি ৮ নম্বরের উপপিলার ৪৬ থেকে ৩৭ নম্বর সীমান্তের প্রায় অর্ধকিলোমিটারের মধ্যে বিএসএফ ৩০ থেকে ৩৫ জন নির্মাণশ্রমিককে দিয়ে লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি খুঁটির মধ্যে প্রায় ৪ ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করে। শূন্যরেখার দেড় শত গজের শেষ অংশে বেড়া স্থাপন করায় ৫১ রংপুর বিজিবি ব্যাটালিয়নের পানবাড়ি ও দহগ্রাম ক্যাম্পের সদস্যরা বাধা দেন। লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফ অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করেছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সীমান্তের বাংকারে অবস্থান নিয়েছে। সীমান্তে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বিজিবি বলছে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিএসএফকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। বেড়া উঠিয়ে নিতে হবে এ বিষয়ে বিএসএফকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে বাড়তি ফোর্স।