অন্যান্য বছর রমজান মাসে ছোলা, ডাল, তেল, চিনি, খেজুর, পেঁয়াজসহ সব ধরনের দরকারি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলে। তবে এবার দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। এবার রোজায় এসব পণ্যের দাম অনেকটাই স্থিতিশীল রয়েছে; কিছু পণ্যের দাম নিম্নমুখী। এর ব্যতিক্রম চালের বাজারে। সরু, মাঝারি, এমনকি মোটা চালও হিসাব করে কিনতে হচ্ছে। সরু চালের দাম নতুন করে বেড়েছে। চালে এই বাড়তি খরচের চাপ নিয়ে বেকায়দায় রয়েছেন সাধারণ ভোক্তারা।
মালিবাগ বাজারে গতকাল চাল কিনতে এসে মিনিকেটের দাম শুনে রীতিমতো ভড়কে গেলেন যেন মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মিনিকেটের দাম সম্প্রতি আরও বেড়েছে। দশ-পনেরো দিন আগে যে মিনিকেটের কেজি ছিল ৮৪ টাকা, এখন তা বেড়ে ৮৮ টাকা হয়েছে। এক লাফে কেজিতে ৪ টাকা করে বেড়ে গেছে।
কারওয়ানবাজারে চালের ক্রেতা মো. ইমতিয়াজ আলী বলেন, বিগত বছরগুলোর মতো এবার রোজায় নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়েনি। এটা অবশ্যই অনেক স্বস্তির। কিন্তু চালের বাজারে সে স্বস্তি মিলছে না। উল্টো দাম ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। অন্য সব পণ্যের মতো চালের বাজারও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে সরকারকে।
রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি সরু চালের দাম ৮০ থেকে ৯০ টাকা, মাঝারি চাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং মোটা চাল ৫৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা জানান, মোটা ও মাঝারি চালে নতুন করে সেভাবে
দাম না বাড়লেও কমেনি। মিনিকেটের দাম বেড়েছে; অনেক বাজারে ৮৮ টাকার নিচে মিনিকেট পাওয়াই যাচ্ছে না।
মালিবাগ বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. সোলেমান হোসেন বলেন, পনেরো দিন আগে যে মিনিকেটের ২৫ কেজি বস্তা ২ হাজার টাকায় কেনা গেছে, এখন তা কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ১৫০ টাকা। কেজিপ্রতি কেনা দাম পড়ছে ৮৬ টাকা। এ চাল বিক্রি করতে হচ্ছে ৮৮-৯০ টাকা। মাঝারি চালের কেজি খুচরায় ৬৫ টাকার নিচে বিক্রি করা যাচ্ছে না। মূলত মিলগুলোতে দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরাতেও বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারের চাল বিক্রেতারাও জানান, মিনিকেটের ২৫ কেজির বস্তায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। ভালো মানের মাঝারি চালের দামও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে। মোটা চালের দাম অনেকটা অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে যে দামে বিক্রি হচ্ছে তা অনেক দরিদ্র পরিবারের পক্ষে কিনে খাওয়া কষ্টকর।
বাজার চিত্র বলছে, গত বছরের এ সময়ের তুলনায় বর্তমানে সব ধরনের চালে খরচ অনেক বেড়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও নজর দিলে দেখা যায়, গত এক বছরের ব্যবধানে সরু চালে ১৩.১৪ শতাংশ, মাঝারি চালে ১৩.৮৯ শতাংশ এবং মোটা চালে ৫ শতাংশ দাম বেড়েছে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক প্রতিবেদনও উঠে এসেছে, গতবারের তুলনায় এবারের রোজায় বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী। গত পাঁচ মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বহুলাংশে কমেছে। তবে চালের বাজারে কমার বদলে উল্টো বেড়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে গত রোজার তুলনায় এবার রোজায় নাজিরশাইলে কেজিপ্রতি ৮ টাকা, মিনিকেটে ১০ টাকা, বিআর আটাশে ৬ টাকা, গুটি চালে ৮ টাকা ও পাইজাম চালে ৬ টাকা বেশি রয়েছে।
দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে খুচরা বিক্রেতা, পাইকারি ব্যবসায়ী এবং মিল-মালিকরা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। তাদের দাবি, একদিকে ধানের দাম বাড়তি দেখিয়ে মিলমালিকরা দাম বাড়াচ্ছেন; অন্যদিকে আমদানি করা হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে চালের উঁচু দাম ও ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানি খরচ বেশি পড়ছে।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, চাল আমদানির খবরে আশা করা হয়েছিল দাম কমে আসবে। কিন্তু এবার তেমনটা হয়নি। বাজার আগের মতোই চড়া রয়েছে। সম্প্রতি সরু চালের দাম বাড়তি। মিলগেট থেকেই বাড়তি দামে ছাড়া হচ্ছে। এর প্রভাব বাজারেও পড়ছে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি আবু ইউসূফ বাচ্চু বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এতে ধানের দামও বাড়তি। এর প্রভাব চালের দামেও পড়েছে।
বিক্রেতা কিংবা মিল মালিক যাই বলুন না কেন, বাড়তি দামের পেছনে চালের বাজারে নজরদারির ঘাটতিই অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, আমরা দেখি ভরা মৌসুমে ভালো ফলনেও চালের দাম কমে না। উল্টো বাড়ে। এটা খুবই হতাশাজনক। মিল মালিকরা আমাদের বলছেন, করপোরেটরা বাজারে আসায় দাম বেশি বাড়ছে। আবার বলা হয়, ধানের দাম বেড়েছে। ধানের দাম বাড়লে কৃষকরা উপকৃত হবেন। কিন্তু সরকারকে দেখতে হবে যে, মাঝ দিয়ে কোনো চক্র অতিরিক্ত মুনাফা করছে কিনা। ধান-চালের বাজারে সরকারের নজরদারি নেই বললেই চলে। আর বারবার এর সুযোগ নেন অসাধুরা। তাই মিলগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। অন্যান্য পণ্যের বাজারে যেভাবে নজরদারি করা হয়, ধান-চালের বাজারে সেভাবে হয় না। মিলগুলোতে নজরদারি নেই।
তিনি আরও বলেন, দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সবকিছুর পরিবর্তন হলেও চালের বাজারে যেসব বড় খেলোয়াড় রয়েছে তাদের প্রভাব কমছে না। তারা এখনও তাদের প্রভাব খাটিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু যারাই বড় খেলোয়াড়, তারাই আবার আমদানিকারক। ফলে বাজারে তাদের প্রভাব রয়ে গেছে।