বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী ও পুলিশের বর্বর নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা নাফ নদী ও স্থল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন। তাদের বেশিরভাগই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। তাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে, আগে গড়ে ওঠা অস্থায়ী বস্তিতে এবং নতুনভাবে গড়ে ওঠা বস্তিগুলোতে তারা গাদাগাদি করে অবস্থান নিচ্ছেন। তারা চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে ভুগছেন। এক কথায় তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।
অনুপ্রবেশকারী কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের যেখানে পাচ্ছে, গুলি করে মারছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকায় ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অনাহারে, অর্ধাহারে, বিনা চিকিৎসায় বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ায় আমরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছি। কিন্তু এখানে খাবার ও পানির সংকট থাকায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তবে আহত ও বৃদ্ধ মানুষ চিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা বলেন, উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে স্থান সংকুলন না হওয়ায় নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন এলাকায়। বিশেষ করে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের অদূরে টিভি টাওয়ার সংলগ্ন পাহাড়, থাইংখালীর তাজনিমার খোলা, হাকিমপাড়া, টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের পাহাড়সহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে নতুন বস্তি। রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
উখিয়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি একরামুল হক জানান, এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের চাপ আমাদের ওপর এসে পড়েছে। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। গত কয়েকদিনে চালের দাম বেড়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের কারণে গাড়ি ভাড়া দ্বিগুণ বেড়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে সংকট প্রকট হবে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, কয়েকদিনে ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছেন। তারা চরম খাদ্য ও পানি সংকটে রয়েছেন। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের জন্য খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
কক্সবাজার শহরের বাসিন্দা রেজাউল করিম জানান, কক্সবাজারের মতো এই ছোট শহরে এত রোহিঙ্গার আশ্রয় কেমনে হবে। তাদের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে আমদের ওপর।
ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) নির্বাহী কর্মকর্তা ইব্রাহীম খলিল মামুন বলেন, পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রেখে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু তারা যেখানে-সেখানে অবস্থান নিচ্ছেন। বিশেষ করে বনভূমি ধ্বংস করে বসতি নির্মাণ করায় পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সাইফুল্লাহ কোম্পানী বলেন, আমার ধারণা উখিয়া-টেকনাফে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অল্প ভূমিতে অতিরিক্ত লোক আসায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে আবাসস্থল ও খাদ্যদ্রব্যের সংকট দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পানিবাহিত রোগব্যাধি বৃদ্ধি পাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
কক্সবাজার সিভিল সার্জন আবদুস ছালাম বলেন, রোহিঙ্গা সম্পৃক্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে জেলায় হাম ও ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিতে পারে। রোহিঙ্গা শিশুদের কোনো টিকা দেয়া থাকে না। বিধায় রুবেলা রোগের আশঙ্কাও রয়েছে। ফলে অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গা শিশুদের টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যমজ শিশু জন্ম দিলেন মা : রেহেনা বেগম (২২) মংডুর রাশিডাং এলাকার পেঠান আলীর স্ত্রী। তারা দুইজন তিন দিন আগে পালিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। প্রসব বেদনা তীব্র হওয়ায় ঠাঁই হয় টেকনাফ উপজেলার নতুন শরণার্থী শিবির হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকার রইক্ষ্যংয়ে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ ক্যাম্পের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অস্থায়ী মেডিকেল টিমের সহযোগিতায় ডেলিভারি করানো হয়। রেহেনা জন্ম দেন যমজ সন্তান। তবে একটি মারা গেছে। তাদের আবদুল হাফেজ নামের আড়াই বছরের ছেলে রয়েছে।
টেকনাফজুড়ে রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা : কক্সবাজারের টেকনাফজুড়ে এখন শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকে কেবল রোহিঙ্গার ঢল। গ্রামে, রাস্তাঘাটে, পাহাড়ে এবং নদীর ধারে শুধু রোহিঙ্গাদের বিচরণ। শহীদ এ টি এম জাফর সড়ক (কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক) ও মেরিন ড্রাইভ সড়কে রোহিঙ্গাদের কারণে যানবাহন চলাচলে বেগ পেতে হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মোঃ মাইন উদ্দিন খান জানান, এখানকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বিশেষ টিম দিনরাত কাজ করছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না যেতে পারে সেজন্য তাদের আপাতত বিজিবির তত্ত্বাবধানে হোয়াইক্যংয়ের রইক্ষ্যং এলাকার অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হচ্ছে।